আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ভারতে কে আসতে চলেছে আগামী পাঁচ বছরের ক্ষমতায়? এই আলোচনার তুঙ্গে রয়েছেন বর্তমান ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি নাকি দেশটির অন্যতম বিরোধী শক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রভাগের দল কংগ্রেস। এরই মধ্যে চূড়ান্ত ফল জানতে ভারতের সপ্তদশ জাতীয় সংসদ (লোকসভা) নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে ৪ হাজার কেন্দ্রে শুরু হয়েছে ভোট গণনা। তবে কিছু এলাকায় খানিকটা দেরিতে শুরু হয়েছে গণনা। এই কার্যক্রম শেষেই জানা যাবে কে এই বার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনগোষ্ঠী এবং সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের রাষ্ট্র ভারতে।
গত ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ১৯ মে পর্যন্ত ৭ ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচন। ২৯টি রাজ্য ও ৭টি কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ৫৪২টি আসনে এ ভোটের আয়োজনে ভারতজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। ৫৪৩টি আসনে ভোট হওয়ার কথা থাকলেও একটি আসনে নির্বাচন স্থগিত করা হয়।
প্রায় ১৩২ কোটি জনগোষ্ঠীর ভারতে এবার ভোটার ছিলেন প্রায় ৯০০ মিলিয়ন বা ৯০ কোটি। ভোটকেন্দ্র ছিল ১০ লাখেরও বেশি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৮১ কোটি ৪৫ লাখ ভোটার। এবার নতুন অর্থাৎ ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী ভোটার ছিলেন প্রায় দেড় কোটি। ২০১২ সাল থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে আসা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী থেকে এবার ভোটার ছিলেন ৩৮ হাজার ৩২৫ জন। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, সব মিলিয়ে এবার ভোট পড়েছে ৬৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
ভারতের সংসদ দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট। এর মধ্যে একটি হলো লোকসভা, এটি নিম্নকক্ষ; আরেকটি রাজ্যসভা, সেটি উচ্চকক্ষ। লোকসভায় মোট আসন ৫৪৫। এর মধ্যে ৫৪৩ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। বাকি দু’টি আসনে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রতিনিধিকে মনোনীত করে আনা হয়। সরকার গঠনের জন্য লোকসভায় ২৭২ আসনের প্রয়োজন। রাজ্যসভার সদস্য সংখ্যা ২৫০। এরা রাজ্য বা অঞ্চলগুলোর বিধানসভার সদস্যদের ভোটে রাজ্যসভায় আসেন।
নির্বাচনের সপ্তম ও শেষ দফা ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন সংস্থা এবার জানাতে থাকে বুথফেরত জরিপের (এক্সিট পোল) ফলাফল। বেশিরভাগ সংস্থার জরিপ মতে, এবারও নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি প্রায় ৩০০ আসন পেয়ে সরকার গঠন করতে চলেছে। অর্থাৎ আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। তবে বুথফেরত জরিপের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক দলগুলোর জোট ফেডারেল ফ্রন্ট। কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী সরাসরিই জরিপগুলোকে ‘ভুয়া’ আখ্যা দিয়ে নেতাকর্মীদের আত্মপ্রত্যয়ী থেকে ফলাফলে চোখ রাখতে বলেছেন। মাটি কামড়ে ফলের অপেক্ষা করতে বলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা বন্দোপাধ্যায়ও।
ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবর অনুযায়ী দেশটির নির্বাচন কমিশন বলছে, ফলাফলে এবার কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, আসন প্রতি পাঁচটি করে বুথের ইভিএম আর ভিভিপ্যাটের ফল মেলানোর কথা। ভিভিপ্যাট হলো এক ধরনের প্রিন্টার। ইভিএমে ভোট দেওয়ার পর ভোটার নিজেই ওই প্রিন্টার থেকে ছাপা হয়ে বের হওয়া কাগজের স্লিপে দেখে নিতে পারেন যে- তিনি যেখানে ভোট দিয়েছেন, সেখানেই ভোট পড়েছে কি-না। এই স্লিপটি ভোটার নিতে পারেন না, কেবল দেখতে পারেন।
তবে ইভিএম এ ভোট গ্রহণের বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে চলছে সমালোচনা। ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছে বিরোধী দলগুলো। এমনকি ভোট গণনার সময় বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে এমন আশঙ্কায় সরকার থেকে সব রাজ্যে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্র বা ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে অনেক দিন ধরেই সরব বিরোধী দলগুলো। ইভিএম বাতিল করে ব্যালটে ফেরার দাবি জানিয়ে আসছিল অনেক দিন ধরেই বিরোধী দলগুলো। তবে বিরোধীদের সেই দাবি নির্বাচন কমিশন বার বারই প্রত্যাখ্যান করেছে। কমিশন থেকে বার বারই ইভিএম হ্যাক করা যায় না বলে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ‘হ্যাকাথন’ কর্মসূচির বন্দোবস্ত করে কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ইভিএম হ্যাক করে দেখানোর চ্যালেঞ্জও ছুড়েছে। সেই চ্যালেঞ্জে নির্বাচন কমিশনকে টেক্কা দেওয়া যায়নি ঠিকই। কিন্তু ইভিএমে কারচুপির আশঙ্কা নিয়ে অভিযোগ এবং বিতর্ক থামেনি।
সবশেষ বিরোধীরা দাবি তুলে ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার আগে ইভিএমে কোনো প্রার্থীর ভোটপ্রাপ্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে ভিভিপ্যাট স্লিপে ভোটপ্রাপ্তির হিসেবও। সব বুথেই এই পদ্ধতি অবলম্বনের দাবি তোলা হয়েছিল প্রথমে। তবে দেশটির নির্বাচন কমিশন বিরোধীদের এই দাবিও প্রত্যাখ্যান করে।
প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রে ৫টি করে বুথের ভিভিপ্যাট স্লিপ এবং ইভিএম মিলিয়ে দেখা হবে— কমিশন এই সিদ্ধান্তেই নেই। বিরোধীরা কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করেছিল। অন্তত ৫০ শতাংশ বুথে ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট স্লিপ মেলাতে হবে, এই দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতও সেই দাবি মানেনি। নির্বাচন কমিশনের উপরেই আস্থা রাখে সুপ্রিম কোর্ট।
এই চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির মধ্যে বিরোধী শিবিরে অক্সিজেন জুগিয়েছে ভোট গ্রহণ শেষে ট্রাকে করে ইভিএম বহনের কিছু ছবি বা ভিডিও। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে এই সব ছবি-ভিডিও উঠে এসেছে বলে বিরোধী দলগুলো জানিয়েছে।
তার পরিপ্রেক্ষিতে ২১টি দলের প্রতিনিধিরা মঙ্গলবার দেখা করেন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ইভিএম বদলের আশঙ্কা প্রকাশ করে স্ট্রং রুমের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবি তো তারা জানিয়েছেনই। গণনার প্রক্রিয়াতেও বদল আনার দাবি করেছেন। গণনার শুরুতেই প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রের যে কোনও পাঁচটি বুথের ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট স্লিপ মিলিয়ে দেখতে হবে, কোনও গোলমাল ধরা পড়লে ওই বিধানসভা কেন্দ্রের সব বুথের ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনতে হবে— এই রকমই দাবি তুলেছেন বিরোধী নেতারা।
তবে ভারতীয় গণমাধ্যম কমিশন সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, বিরোধী দলগুলোর এই দাবি নিয়ে বুধবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনা করেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। বৈঠকে এই দাবিও খারিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইভিএমে ভোটপ্রাপ্তির গণনা হয়ে যাওয়ার পরে লটারির মাধ্যমে প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রের যে কোনও ৫টি করে বুথকে বেছে নিয়ে ওই সব বুথের ইভিএমের হিসেবের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপ মিলিয়ে দেখা হবে বলে যে সিদ্ধান্তের কথা কমিশন আগে জানিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্তই বহাল থাকছে বলে জানানো হয়েছে।
কমিশন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে বা সুপ্রিম কোর্ট বিরোধীদের আর্জি খারিজ করে দিয়েছে বলে বিতর্ক থেমে গিয়েছে, এমন নয়। প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ তথা বর্তমানে কংগ্রেস নেতা উদিত রাজ বুধবার প্রশ্ন তুলেছেন, সুপ্রিম কোর্টও এই ‘ইভিএম কারচুপি ষড়যন্ত্রে’ সামিল হয়েছে কি না!
অন্যদিকে ইভিএম নিয়ে বিরোধীদের নানা অভিযোগের পাল্টা জবাব দিয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপিও। দলটির দাবি, বিরোধীরা হারের আভাস পেয়েই ইভিএম নিয়ে নানা সংশয় প্রকাশ করছে। নিজেদের হতাশা ঢাকতে দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে বিরোধীরা বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে— বলছেন বিজেপি নেতারা।
বাংলায় বিজেপি নেতাদের স্বর আরও চড়া। ইভিএম পাহারা দেওয়ার নামে বিভিন্ন গণনাকেন্দ্রের বাইরে বা স্ট্রং রুমের কাছে তৃণমূল কর্মীরা যে ভাবে জমায়েত শুরু করেছেন, বিজেপি বুধবার তার তীব্র সমালোচনা করেছে। কমিশনে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে বিজেপি। তার পরে সংবাদ সম্মেলন করে রাজ্য বিজেপির সহসভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, গণনাকেন্দ্রের সামনে এই ভাবে কর্মীদের জড়ো করার মধ্যে তৃণমূলের কোনও দুরভিসন্ধি রয়েছে। যেখানেই তৃণমূল পিছিয়ে পড়বে, সেখানেই এঁরা গোলমাল পাকাবেন— আশঙ্কা জয়প্রকাশের।
বাংলায় বিজেপির এই আশঙ্কাকে যে দেশের সরকার উড়িয়ে দিচ্ছে না, তার প্রমাণ মিলেছে এ দিন সন্ধ্যায়। ভোটগণনা চলাকালীন বিভিন্ন এলাকায় অশান্তি হতে পারে এবং হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া হতে পারে— এই আশঙ্কা করে সবকটি রাজ্যকে এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সতর্ক করা হয়েছে মুখ্যসচিবদের। কিন্তু বিরোধী দলগুলিও গণনাকেন্দ্র বা স্ট্রং রুমের সামনে জমায়েত বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর।
ভোট গ্রহণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে এই রকম তীব্র ভাবে সমালোচনা, ভোটগণনা শুরু হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এমন প্রবল তিক্ততা দুই শিবিরের মধ্যে— এই পরিস্থিতি ভারতীয় গণতন্ত্র কখনও দেখেনি সম্ভবত।
পরিস্থিতি এমনই যে, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইভিএম বদলের চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ তার। দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার গায়ে যাতে অস্বচ্ছতার কালি একটুও না লাগে, সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন প্রণব। ইভিএমের নিরাপত্তা এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্বটা যে কমিশনের কাঁধেই সবচেয়ে বেশি, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ প্রকাশ্যে আসছে ভারতের রায়। প্রায় বেনজির এই উত্তাপের মাঝে কতটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় ভোটগণনার প্রক্রিয়া, সে দিকে নজর তো থাকছেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে যে সংশয় প্রকাশ করেছে বিরোধী দলগুলো, ভোটগণনার প্রক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য রাখার সময় ভারতবাসীর মাথায় থাকবে সেই বিষয়গুলোও।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে নজিরবিহীন জয় পেয়ে সরকার গড়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবারের মতো একক দল হিসেবে সরকার গঠনের মতো আসন পেয়ে যায় বিজেপিই। পদ্মফুল ফুটেছিল ২৮২ আসনে। বিজেপি জোটের অন্য দলগুলো পেয়েছিল ৫৫ আসন। অন্যদিকে আগের সরকার চালানো সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পায় মাত্র ৪৪টি আসন। তাদের জোটের দলগুলো পায় ১৫ আসন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস পায় ৩৪ আসন। তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে পায় ৩৭ আসন।
ওডি/এআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড