• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আসামের মুসলিমদের মধ্যে তীব্র উৎকণ্ঠা

মোদী সরকারে কী শঙ্কায় মুসলিম ও বাংলাদেশ?

পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একই মানদণ্ডে বিচার করে বিজেপি

  এস এম সোহাগ

২০ মে ২০১৯, ১৮:৩৩
ভারতের লোকসভা নির্বাচন
ক্ষমতায় আসছে মোদী সরকার, আতঙ্কে ভারতের মুসলিম ও সংখ্যালঘুরা। ছবি : সংগৃহীত

অপেক্ষা শেষের দিকে, ভারতের ম্যারাথন নির্বাচনের ভোটগণনাও প্রায় শেষ, এরই মধ্যে বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে মোদী নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তির দেশটির ক্ষমতায় আগামী ৫ বছরের জন্য বসতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। রবিবার (১৯ মে) শেষ ধাপের ভোটগ্রহণের পর বুথফেরত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর তার (বিজেপি) ভারতীয় জনতা পার্টিই আসছেন ফের ক্ষমতায়, এমন ইঙ্গিতই দেয়া হয়েছিল প্রকাশিত সেই ফলাফলে। তবে, বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ভোট গণনা শুরু হওয়ার পরেই বিজেপি'র জয়জয়কার শুরু হয়, প্রায় ৩৫০টি আসনে এগিয়ে মোদী নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট।

মোদীর কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকার ফের ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতেও পড়তে পারে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। বিজেপি যেভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, সেখানে পাকিস্তানের মতো করে বাংলাদেশকেও দেখা হচ্ছে, আসামের ৪০ লাখ বাঙালিকে ফেরত পাঠানো নিয়ে বিজেপির হুঙ্কার নষ্ট করে দিতে পারে দীর্ঘকালীন দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব অতি, হিন্দুত্ববাদী মোদীই আসছে দেশটির ক্ষমতায়। অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যে একটা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। জরিপের ফল বিগত নির্বাচনগুলোতে যে ব্যর্থ হয়েছে তাতে এই ফলকেও অনেকে বিশ্বাস করতে পারেনি প্রথমে, যদিও সেসব শঙ্কা এখন কেটে গেছে, জরিপের অনুমান ছাড়িয়েও মোদীর দাপট অনেক উঁচুতে এখন। তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মোদী ফের ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে কী ঘটতে পারে ভবিষ্যতে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে।

গুজরাট প্রদেশের দীর্ঘ এক দশক ক্ষমতায় থাকা মোদী ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থনৈতিক রেনেসাঁ আনয়ন, ভারতকে ব্যবসায়ের জন্য সহজ স্থান হিসেবে গড়া, বেকারত্ব হ্রাস করে যুবসমাজকে কর্মমুখী করে তোলা, দুর্নীতি দূরসহ একাধিক মুখরোচক প্রতিজ্ঞামূলক প্রচারণায় ভর করে মোদী নির্বাচিত হন। নরেন্দ্র মোদী ২০১৪-১৯ পর্যন্ত তার প্রতিজ্ঞার কতখানি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন তা নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই।

কার্নেগী এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মিলান বৈষ্ণব বলেন, 'ট্রাম্প যেমন মেক্সিকোর সঙ্গে শারীরিক প্রাচীর তৈরি করছে, মোদিও তেমন এনআরসির মত নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি রূপক প্রাচীর তৈরি করছে।'

ছবি : বিবিসি নিউজ

ট্রাম্পের দুই বছর আগে মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন, তার দলটির অসহায় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানকেই এই বছরের নির্বাচনের মটো করেছিলেন যা ভারতের বহুত্ববাদী গণতন্ত্র হিসাবে ভারতের পরিচয়কে সংকটে ফেলতে যাচ্ছে।

বিজেপি নেতারা মুসলমানদের 'অনুপ্রবেশকারী' হুমকি হিসেবে দেখাতে এনআরসিকে কাজে লাগাচ্ছে। তাদের দাবি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বহু অনুপ্রবেশকারী অভারতীয় রয়েছে যাদের মোকাবিলা করা আবশ্যক। দলটি এই ধরনের নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) সারা দেশজুড়ে তৈরির প্রস্তাব করেছে।

সংকটে মুসলিমরা

আসামের মুসলিম জনসংখ্যার প্রতি ৩ জনের একজন বাসিন্দা আতঙ্কে আছে। ভারত থেকে তাদের বিতাড়নের জন্য এনআরসি ব্যবহার করা হচ্ছে ভেবে তারা ভয়ে আছে। অল আসামের সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আজিজুর রহমান বলেন, 'বিজেপি সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে এবং যদি তারা তা চালিয়ে যায় তবে এটি ভারতীয়দের বহুত্ববাদী পরিচয় ধ্বংস করবে। যদি তারা জিতে যায়, তাহলে পরবর্তী পাঁচ বছর মুসলমানদের জন্যে খুবই কঠিন হবে এবং আগামী কয়েক দশক ধরে এই ধারা চলতে থাকবে।'

খসড়া প্রক্রিয়া চলাকালীন, অধিবাসীরা এনআরসি'তে অন্তর্ভুক্ত নামগুলিও নাগরিকত্বের চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছে এবং কিছু সমালোচক বলেছেন যে, মূলত মুসলমানদের কাছে থেকেই অধিকাংশ অভিযোগ এসেছে। নিবন্ধনে তাদেরকে লক্ষ্য করে নাম বাদ দেয়া হয়েছে।

আসামের মানবাধিকার আইনজীবী আমান ওয়াদুদ বলেন, 'বিদেশীদের পৃথকীকরণের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে মুসলিম বিরোধী চর্চা হয়ে উঠেছে'। তবে, বিজেপি নেতা গুপ্ত মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য এনআরসি'কে ব্যবহার করার অভিযোগ প্রত্যাহার করেছেন। তিনি বলেন, মোদি সরকার সব ভারতীয়দের জন্যই কাজ করেছে।

বিজ্ঞান শিক্ষক আহমেদ হোসেন (বামে) ও শিক্ষার্থী নাজি নাজিয়া। ছবি : বিবিসি নিউজ

আদাবরি গ্রামের সরকারী বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক আহমেদ হোসেন বলেন, তার নামের কারণে নাগরিকত্বের জটিলতায় জড়িয়ে পরেছেন। যার জন্য তার পরিবার এক ভয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, '২০১৬ সালে বিজেপি সরকার গঠন করার পর আসামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন সমস্যা বেড়েছে।'

৫৫ বছর বয়সী এই শিক্ষক এমন একটি পরিবার থেকে এসেছেন যারা আসামি জেলার ধুবরিতে গত নয় প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসছেন। এই এলাকাটি বাংলাদেশের সীমান্তের পাশে অবস্থিত, জলাভূমির পানি দু-দেশের মধ্যে বিভক্ত এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর অনেক শাখাও বিভক্ত করেছে এই অঞ্চলের অনেক গ্রামকেই।

আহমেদ দাবি করেছেন, ১৯৫১ সালে ধুবরি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে চাকরি করার সময় তার বাবা মূল এনআরসি প্রস্তুত করার জন্য জড়িত ছিলেন। তবে তার পরিবারের ১৮ বছর বয়সী সদস্য নাজি নাজিয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকার অভিযোগে তার পরিবারের ভারতীয় শেকড় নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

বিজ্ঞানের এই শিক্ষার্থী তার বাড়ি থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্তিত গৌহাটি গ্রাম থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করেছেন। একজন মেডিকেল ডাক্তার হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার, কিন্তু পড়াশোনা করার পরিবর্তে, নাজিয়া তার বিরুদ্ধে মামলা লড়তেই সময় পার করছেন, যে সমস্যায় তার পুরো পরিবার জড়িয়ে পরেছে।

তিনি বলেন, 'আমি আমার ভবিষ্যত নিয়ে ভয়ে আছি, যদি আমি একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঘোষিত না হই তবে, আমার জন্যে চাকরি খুঁজে পাওয়া খুবই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। যদি আমি সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করি, তবে তারা আমাকে আমার মুসলিম পরিচয়ের জন্য লক্ষ্যবস্তু করবে? কেন শুধু আমরাই?'

ছবি : সংগৃহীত

হিন্দুত্ববাদী 'চৌকিদার' মোদী ও ভারতের ভঙ্গুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি!

মোদীর প্রচারণা কৌশল যে নির্বাচনে বেশ প্রভাব রাখে তা প্রমাণিত। তার নির্বাচনি বার্তা পৌঁছানোর জন্য প্রচারণায় বিশাল তহবিল ব্যয় হয়, যার জন্য ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন। জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে প্রচারণায় বিজেপি এবার রেকর্ড পরিমাণ ব্যয় করেছে। দীর্ঘ ৬ সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনে চরম হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকারের উগ্রতার সমালোচনা করেছে দেশটির বিরোধী রাজনীতিবিদরা। ২০০২ সালে মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যে দাঙ্গা হয়েছিল সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল, যার অধিকাংশই ছিল মুসলিম। মোদী ও বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবকে হাতিয়ার বানিয়ে মমতা-রাহুলের মতো নেতারা তাদের প্রচারণা চালিয়েছে।

স্থানীয় ও বহিরাগত হুমকিকে পরাস্তকারী হিসেবে নিজেকে ভারতের নিরাপত্তার 'চৌকিদার' বলে প্রচার চালিয়েছেন মোদী। মোদী সমালোচকেরা এর সঙ্গে চোর শব্দ জুড়ে দিয়ে 'চৌকিদার চোর হ্যায়' স্লোগানে গরম রেখেছেন পুরো নির্বাচনি সময়টা। শেষপর্যন্ত সমালোকদের 'চৌকিদার কড়া জবাব দিলেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে বিজিত হবার মাধ্যমে।

২০১৯ সালের প্রাচারাভিযান শেষ হওয়ার কথা বিবেচনা করলে দেশটির সাম্প্রদায়িকতায় মোদীর প্রভাব পাওয়া যাবে। একটি বিতর্ক যা একাধিক উদারতাবাদী ও সংখ্যালঘু ভারতীয়দের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করে। মোদী ও তার কট্টর হিন্দু সহযোগীদের উত্থানে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ মর্যাদার পতন ঘটে যার প্রধান চরিত্রে আসীন ছিল কেন্দ্রীয় ভারতের বিজেপি প্রার্থী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর। যিনি দেশটির জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীকে দেশপ্রেমিক হিসেবে ঘোষণা করেন।

বেশ কয়েক বছর আগে মুসলিমদের ওপর বোমা হামলার সন্ত্রাসী মামলার অন্যতম অভিযুক্ত প্রজ্ঞা ঠাকুর। তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে, বিজেপি এই মামলাটিকে ছাইচাপা দিলেও দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় ও বিরোধীরা মামলাটির একটা রায় নিয়ে এখনও আশাবাদী।

ছবি : সংগৃহীত

প্রকৃতপক্ষে, মোদীর নিকটতম রাজনৈতিক সহযোগী, বিজেপি দলের সভাপতি অমিত শাহ, প্রজ্ঞার প্রার্থিতা রক্ষা করেছিলেন। প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে একটি উদার ষড়যন্ত্রের চেয়ে বেশি কিছু নয় বলে ঘোষণা করেছেন। এসব কিছুই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভারতকে একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী দেশের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। মোদী ভার্সন ২ যদি এবারও ক্ষমতায় আসে তাহলে দেশটির সংখ্যালঘুরা যে এক মারাত্মক হুমকিতে পড়তে যাচ্ছেন, তেমনটাই ইঙ্গিত দেয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর হিন্দুত্ববাদী দেশ গড়তে মোদীকে কাজে লাগিয়ে দেশটির এক মুখ্য দলের আসনে বসতে যাচ্ছে শিবসেনা।

লোকসভা নির্বাচনে বাংলাদেশ কেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু?

ভারতীয় সংসদ নির্বাচনে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে। সচারচর বাংলাদেশের নির্বাচনে মুখ্য বৈদেশিক প্রভাবক হিসেবে কাজ করে ভারত। তবে, এই প্রথম ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশ প্রভাব রাখতে যাচ্ছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সামির দাস বলেন, 'সাধারণত ভারতই সর্বদা বাংলাদেশে একটি বড় নির্বাচনি ইস্যু হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এবার, ক্ষমতাসীন বিজেপি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীদের নির্বাচনের এক মুখ্য হাতিয়ার বানিয়েছে।'

ছয় সপ্তাহের দীর্ঘ জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) আপডেটকে ব্যাপক প্রাধান্য দিয়েছে বিজেপি। আসামে আঞ্চলিক দলগুলো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত নিবন্ধটির একটি খসড়া সংস্করণ থেকে প্রায় ৪০ লাখ অধিবাসীদের বাদ দিয়েছিল বিজেপি সরকার। বাদ পড়াদের বেশিরভাগই বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমান।

ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের আদেশ অনুসারে, আগামী ৩১ জুলাই এই তালিকাটির চূড়ান্ত সংস্করণটি প্রকাশ করতে হবে। আর এই সময়সীমার মধ্যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হবে দেখে অনেকেই এখানে সন্দেহভাজন বাঙালি বংশোদ্ভুত হিসেবে বাদ পড়তে পারেন। যেখানে অনেক আসল ভারতীয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে দেখে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে ভারতের এই প্রদেশটিতে।

ছবি : ব্লুমবার্গ

আসামের বাঙালি মুসলমান ওলিউল্লাহ লস্কর বলেন, 'এনআরসি জাতীয় নিবন্ধনের এক নিষ্ঠুর চিত্র হয়ে উঠেছে, প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমানদের জাতীয় নিবন্ধন থেকে বাদ পড়েছেন এবং ইতোমধ্যেই তাদের মধ্যকার ৪০ জন নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে। এটা এক নিষ্ঠুরত্ব।'

কিন্তু, এ জাতীয় অভিযোগগুলিতে বিজেপির কিছু আসে যায়নি, উল্টো দলটির জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ দেশব্যাপী এনআরসি চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যগুলিতে এনআরসি প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের এক নির্বাচনি সমাবেশে অমিত শাহ বলেন, 'যদি আমরা ক্ষমতায় ফিরে আসি, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতের বাকি অংশগুলিতে আমাদের এনআরসি চালু করব। বাংলাদেশ থেকে আসা সকল অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের ভারত থেকে বিতারিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।' এমনকি এমন অবৈধ অভিবাসীদের 'ঘুণপোকা' হিসাবেও বর্ণনা করেন অমিত।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসসহ অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে অবৈধ অভিবাসীদের 'নিরাপদ ভোটব্যাংক' হিসাবে ব্যবহার করার অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার দলের বেশ কয়েকটি নির্বাচনি সমাবেশে তিনি অবৈধ অভিবাসীদের দরজা দেখানোর জন্য আহ্বানও জানিয়েছেন।

তবে, মোদীও পরিষ্কার করেছেন যে, তার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটিকে সামনে নিয়ে যেতে আগ্রহী, যা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যাওয়া সকল অমুসলিম শোষিত সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

বিজেপি সরকার কর্তৃক উপস্থাপিত হওয়ার পর দেশটির দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের নিম্ন কক্ষ দ্বারা এই বিলটি অনুমোদন করা হয়। তবে, উচ্চকক্ষে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে বিলটি পাস করাতে ব্যর্থ হয় বিজেপি সরকার। বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে মোদী আবার বিলটি পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে মোদীর দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করা মানে বাংলাদেশের জন্য বেশ চিন্তার বিষয় দাঁড়াতে পারে।

বিজেপি ভারতে ধর্মীয় মেরুকরণকে উচ্চতর করতে এবং হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি সৃষ্টিতে অভিবাসন সমস্যাকে ব্যবহার করছে বলে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ জানিয়ে আসছে। আসামের রাজধানী গৌহাটির কংগ্রেস প্রার্থী বব্বিতা সারমাহ বলেন, 'বিজেপির বিভক্তিমূলক রাজনীতির কারণে গুরুতর সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত কীভাবে ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব আইন চালু করতে পারে যা সংবিধানের সরাসরি বিরোধিতা করে? একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসাবে ভারতের আদর্শিক স্থানে বিজেপি খুবই বাজেভাবে আক্রমণ করছে।'

ছবি : সংগৃহীত

এছাড়াও মোদীর দল, দুই বাংলাদেশি অভিনেতাকে লক্ষ্য করে এক সমস্যা তৈরি করেছে, যার মধ্যে একজন তার ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণের পরেও ভারতে অবস্থান করছিল। এই অভিনেতা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক সমাবেশে যোগদান করেছিল, পরে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

ভারতের বেশ কয়েকটা চলচ্চিত্র ও সোপ অপেরায় অভিনয় করা ফেরদৌস আহমেদ এবং আবদুস নূরকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, 'নূরের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণের পরেও ভারতে অবস্থান করা এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশিদের এখানে আসতে এবং অবৈধভাবে থাকা কতটা সহজ।'

বিজেপির বর্ণবাদ এশিয়ার দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়মিত ভারতে সফর করা মোহাম্মদ হানিফ নামের বাংলাদেশি এক গার্মেন্ট মালিক বলেন, 'ভারতীয় রাজনীতিবিদরা আমাদের জনগণকে 'ঘুণপোকা' বলে কলুষিত করার পরেও কীভাবে আশা করে আমরা বন্ধু হব?' ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলি চালু করে দেখেন কীভাবে আমার দেশের বিরুদ্ধে কিছু ভারতীয় রাজনীতিবিদ বিষাক্ত বার্তা ছড়াচ্ছে।'

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে প্রো-ভারতীয় হিসাবেই দেখা হয় তবে, দলটির অনেক রাজনীতিবিদকেই বিজেপি নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা গিয়েছে। বিজেপির বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলেই তারা আশঙ্কা করছে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানবিরোধী নীতির ওপর পরিচালিত বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, 'ভারতের ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি, ধর্মবিরোধী থিমগুলি কেবলমাত্র বাংলাদেশের ইসলামপন্থি কঠোর দলগুলোকেই প্রভাবিত করবে, যাদের আমাদের সরকার নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।'

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, আফরোজ বিজেপি'র কিছু বিবৃতিকে 'গণহত্যায় উদ্দীপনার প্রমাণ' হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ আসামে এনআরসি কর্তৃক চিহ্নিত অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি কূটনীতিক বলেন, 'এনআরসি একটি অভ্যন্তরীণ অনুশীলন এবং কাউকেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানা হবে না বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু অমিত শাহের মতো বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদরা বারবার বলছেন যে, অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হবে। আমি নিশ্চিত যে, তাদের সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে না।'

ছবি : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

তিনি আরও বলেন, 'এই সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তাদের সেরা সময় পার করছে, সুতরাং এখন আমাদের মধ্যে সংকটের নতুন কোনো ইস্যু তৈরি হবে না, এতটুকুই আমি আশা করতে পারি।'

ইতোমধ্যেই, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

বাংলাদেশি এক পর্যবেক্ষক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, 'বিজেপির রাজনৈতিক আদর্শের জন্য ভারত শেষ পর্যন্ত তার একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হারাতে পারে। বিশেষ করে হাসিনার সরকারের বিরোধীরা ইতোমধ্যেই তাকে 'ভারতীয় স্ট্যুজ (হাতের পুতুল)' হিসাবে চিত্রিত করেছে। বিজেপি একই আলোতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে দেখতে চায়, কারণ তারা মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।'

'কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানরাই প্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং একেবারে শেষের দিকে ভারতীয় সমর্থন নিয়ে তারা তৎকালীন শক্তিশালী পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীকে সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন করার আগে এই গতিবিদ্যা বুঝাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ' বলে তিনি যুক্ত করেন।

সূত্র : 'নিউ ইয়র্ক টাইমস', 'ব্লুমবার্গ' 'সিএনএন', 'দা ইকোনোমিস্ট', 'বিবিসি নিউজ'

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড