আন্তর্জাতিক ডেস্ক
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছে শ্রীলঙ্কা। ইস্টার সানডের দিনে গীর্জা ও হোটেলে বোমা বিস্ফোরণে ৩৫৯ জনের প্রাণহানি ঘটে, এই ভয়াবহ বিষ্ফোরণে জড়িত ৯ জন আত্মঘাতীর মধ্যে দুই ভাইয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে শ্রীলঙ্কা। আইএসআইএস এই হামলার দায় স্বীকার করে, যেখানে তারা তাদের জঙ্গিদের দ্বারা এই ভয়াবহ হামলা ঘটানো হয়েছে বলে দাবি করে। তদন্তের মাধ্যমে উঠে আসে শ্রীলঙ্কার বিত্তবান এক মুসলিম পরিবারের নাম।
কলম্বোর মাহাওয়েলা গার্ডেন্স এলাকার সাদা বাড়িটাকে সম্মান করত সবাই। পরিবারের সদস্যদেরও সামাজিক সম্মান ছিল, প্রতিপত্তি ছিল। কিন্তু ইস্টার সানডের ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পর পাল্টে গিয়েছে সব। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে এই পরিবারই শ্রীলঙ্কার সবথেকে ভয়ানক জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড।
এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের নেপথ্যে ছিল ইব্রাহিম পরিবার। বাড়ির বেশিরভাগ সদস্যই মারা গিয়েছেন। আত্মঘাতী বিস্ফোরণকারী দুই ভাইয়ের পিতা মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইস্টার সানডেতে হামলার পর দীর্ঘ সময় কোনো সংগঠন ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। দুদিন বাদে হামলার দায় নিয়েছে আইএসআইএস। তবে, তার আগেই ইব্রাহিম পরিবারের যোগাযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল প্রশাসন।
বিত্তবান এই বাড়ির বড় ছেলে ইনসাফ ইব্রাহিমই কলম্বোর অন্যতম বিখ্যাত হোটেল সাংরি-লাতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রাতরাশের লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে থাকা বোমা ফাটিয়ে দেয় ইনসাফ। মৃত্যু হয় বহু মানুষের। এরপর, সেদিনই ইব্রাহিমদের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। বিপদ বুঝতে পেরে ইনসাফের ছোট ভাই ইলহাম একটি বোমা ফাটায়। তাতে মৃত্যু হয় তার। একই সঙ্গে তার স্ত্রী এবং তিন সন্তানেরও প্রাণ যায়। শ্রীলঙ্কান পুলিশ সরকারিভাবে এ তথ্য জানায়নি। তবে সংবাদ সংস্থা 'রয়টার্স' একটি বিশেষ সূত্র থেকে এই খবর জানতে পেরেছে।
পুলিশ যতই প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেনো স্থানীয়রা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না যে পরিবার আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াত, তারাই এমন একটা ভয়ানক কাজ করেছে। এই বাড়ির পাশেই থাকেন ফাতিমা ফাজলা নামে এক গৃহবধূ। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'ওদের দেখে খুব ভাল মানুষ বলে মনে হতো। ওরা যে কারও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত।'
কলম্বোর মাহাওয়েলা গার্ডেন্স এলাকার ইব্রাহিমদের সাদা বাড়িটা । ছবি : সংগৃহীত
শুধু সামাজিক সম্পর্ক নয় আর্থিক দিক থেকেও এই পরিবার ছিল যথেষ্ট সচ্ছল। মোহাম্মদ ইব্রাহিম শ্রীলঙ্কার অন্যতম বিশিষ্ট মসলা ব্যবসায়ী, যার প্রভাব সর্বজন বিদিত। দেশের ব্যবসায়ী মহল কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করতে ইব্রাহিম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তার কথা সকলেই শুনত এবং মানতো বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
স্থানীয়রা পুলিশকে জানিয়েছেন তিন কন্যা এবং ৬ পুত্রের বাবা ইব্রাহিম খাবার এবং টাকা দিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে থাকতেন। তবে, এই ঘটনার পর তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। হামলা সম্পর্কে সে কতটা কী জানে বা আদৌ কিছু জানে কিনা তা জানতেই তাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। বাবার পাশাপাশি দুই ছেলে ইনসাফ এবং ইলহামও নিজেদের কাজের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। ইনসাফের একটি ফ্যাক্টরি আছে।
বার্তা সংস্থা 'রয়টার্স' ইব্রাহিম পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে বলছে, চরমপন্থায় বিশ্বাসী ৩১ বছর বয়সী ইলহাম প্রকাশ্যেই নিজের মত প্রকাশ করত। শুধু তাই নয়, এই হামলার সঙ্গে জড়িত এনটিজে (জাতীয় তৌহিদ জামাত) সংগঠনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে ইলামের কয়েকবার দেখাও হয়েছে। অন্যদিকে কিছুটা উদারমনস্ক তবু কীভাবে সে এই হামলার সঙ্গে যুক্ত হল তা বুঝতে পারছে না প্রশাসন।
ইলহামের বড় ভাই ইনসাফ ও একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন, তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বাইরের দিক থেকে আরও বেশি নিরপেক্ষ ছিলেন এবং তার কর্মীদের এবং স্থানীয় সংগ্রামী পরিবারের প্রতি তার দানশীল বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ইনসাফ এক ধনী জুয়েলারি ব্যবসায়ীর কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন এবং সে কখনো আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়নি।
ইব্রাহিম পরিবারের বাড়ির পাশে অবস্থিত ৩৮ বছর বয়সী এক নেটওয়ার্ক ক্যাবলিং প্রকৌশলী সঞ্জেয়া জয়সিংহ বলেন, আমি হতভম্ব হয়ে গেছি, আমরা কখনোই ভাবিনি যে তারা এই ধরনের মানুষ।'
ছবি : সংগৃহীত
প্রাথমিকভাবে ইস্টার সানডে বোমা হামলার পর শান্ত দেশটিতে আবার ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মাত্র ১০ বছর আগে দেশটির সংখ্যালঘু হিন্দু, জাতিগত তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠদের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। এই বোমা হামলার পরে দেশটিতে ফের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়েছিল।
শ্রীলংকাকে এই অবস্থায় ফেলে দেয়ার জন্য ইব্রাহিম ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রতি দেশের বেশিরভাগ লোক অপবাদ আরোপ করবে, তবুও কিছু মানুষ তাদেরকে মনে করবে। সম্প্রদায়ের যেসব লোক এই ভাইদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা তাদেরকে স্মরণ করবে। কলম্বোর উপকণ্ঠে ইনসাফের পরিত্যক্ত তামার কারখানায় কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিক সরোয়ার বলেন, 'সে (ইনসাফ) খুব দয়ালু ছিল, অন্যান্য বসদের থেকে আলাদা। আমি তার নেতৃত্বে কাজ করে খুশি ছিল। এখন সে নাই, এখন আমি কি করব?'।
ওডি/এসএমএস
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড