• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দগ্ধ নুসরাতে জ্বলছে বিশ্ব মিডিয়া

জীবিতাবস্থায় সুবিচার পেলে বেঁচে যেত নুসরাত!

  অধিকার ডেস্ক    ২০ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:০১

নুসরাত
নারীদেরকে শ্রদ্ধা করতে না পারলে, দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে নুসরাতদের বার বার এভাবে পুড়ে মরতে হবে। ছবি : সংগৃহীত

প্রায় ৩ দশক ধরে বাংলাদেশের শাসনভার ন্যস্ত নারীদের ওপর, পালাক্রমে সরকার প্রধানের দায়িত্বও পালন করেছেন দুই নারী। তবুও, দেশে ক্রমেই বেড়ে চলছে নারীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে পুরুষের লালসার অবস্থা এতই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ১৯ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীকে শ্লীলতাহানি চালিয়েই ক্ষান্ত হননি তার হিংস্র মাদ্রাসা শিক্ষক, আদিম বর্বর মানুষের চেয়েও নির্মমভাবে তারই সহপাঠীদের মাধ্যমে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত ফেনীর সোনাগাজীতে অবস্থিত একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের হাতে শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি তার ওপর যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে। ক্ষুব্ধ অধ্যক্ষ নুসরাতকে অভিযোগ তুলে নিতে বার বার হুমকি দেয়ার পরেও যখন নুসরাত তার ওপর করা নির্যাতনের বিচারের আশায় অনড় তখন এক পর্যায়ে অধ্যক্ষের নির্দেশেই পরীক্ষার মধ্য থেকে তারই সহপাঠীরা মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে স্কার্ফ দিয়ে হাত পা বেঁধে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয় ১৯ বছরের এই তরুণীকে।

আগুনে জ্বলে স্কার্ফ খুলে গেলে জ্বলন্ত অবস্থাতেই নিচে নেমে যেতে সক্ষম হয়, ৫ দিনের দিন ৮০ শতাংশ দগ্ধ শরীরে যন্ত্রণাকাতর নুসরাত মারা যায়। মৃত্যুর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের একটি ভিডিও প্রকাশ করে যান, যা অতি দ্রুত ভাইরাল হলে দেশব্যাপী সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

নুসরাত ও অভিযুক্ত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। ছবি : সংগৃহীত

এই নির্মম মৃত্যু নারী ও বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে বিশ্ব মিডিয়ায়। যে দেশের নারীরাই প্রায় ৩ দশক ধরে দেশকে চালাচ্ছে, সেই দেশেরই এক তরুণীকে এভাবে পুড়িয়ে মারা হয়! স্বাধীন এই দেশটিতে নারীরা নিজেরা কখনোই স্বাধীন ভাবতে পারবে কি আর?

শ্লীলতাহানির অভিযোগ করায় জোর করে জীবিত পুড়িয়ে দেয়া ছাত্রীর ভয়ঙ্কর মৃত্যুর বিচারের দাবিতে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকেরা বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। এই ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে স্থান করে নেয় বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও। ব্রিটিশ গণমাধ্যম 'দা টেলিগ্রাফ' হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বরাত দিয়ে জানায়, শ্লীলতাহানির অভিযোগ করায় নুসরাতকে ছাদে নিয়ে গিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে নির্মমভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। চারদিন ধরে শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধতা নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরে মৃত্যু হয় নুসরাতের।

মানবাধিকার সংগঠনটির দক্ষিণ এশীয় পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলীর বরাত দিয়ে 'দা টেলিগ্রাফ' বলে, 'নির্যাতনের শিকার সাহসী তরুণীকে নির্মমভাবে খুন হওয়া বাংলাদেশ সরকারের শ্লীলতাহানির সুবিচার প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার চিত্রই তুলে ধরে। নুসরত জাহান রাফির মৃত্যুর বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে শ্লীলতাহানির বেঁচে যাওয়াদের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে এবং তারা যেন নিরাপদে বিচার পায় এবং প্রতিশোধ থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারে তা নিশ্চিত করা উচিত।' মৃত্যুর পরে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে জীবিতাবস্থায় নারীদের ওপর নির্যাতনের সমুচিত বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে, স্বাধীন দেশে নারীদের পরাধীন ও আতঙ্কিত এক জাতিতে পরিণত করবে।

এই মামলার দায়িত্বরত তদন্ত কর্মকর্তা, পুলিশের জ্যেষ্ঠ পরিদর্শক মোহাম্মদ ইকবাল ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা 'এএফপি' জানায়, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে আটক ১৮ জনের একজন জানায়, যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে নুসরাতের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে এবং যদি তাতে কাজ না হয় তাহলে মেরে ফেলতে নির্দেশ দেয় নরপশু মাদ্রাসা অধ্যক্ষ। নুসরাত পুলিশের কাছে নির্যাতনের বিচার চাইতে গেলে প্রধান নিবন্ধন কর্মকর্তা একে 'তেমন কোনো বিষয় নয়' বলে মামলাটিকে খারিজ করে দেয়। মামলা প্রত্যাহার না করায় বীর বাঙালি নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষরূপী পশুরা।

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার 'বিবিসি বাংলা'কে জানায়, 'নুসরাতের ওপর হামলাকারীদের একজন তার মাথা চেপে ধরায় মাথায় কেরোসিন ঢালতে পারেনি এবং এ কারণে তার মাথা দগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা পায়।' ৫ই এপ্রিল সকালে মাদ্রাসার একটি হোস্টেলে বসে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করা হয়। মাদ্রাসার দুটো ছাত্রাবাসের একটিতে : পশ্চিম হোস্টেল বসে পাঁচজন মিলে রাফিকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করা হয়। দুটি কারণে তাকে হত্যার এই পরিকল্পনা হয়।

এক, হত্যাকারীরা মনে করেছে নুসরাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করে 'আলেম সমাজকে হেয় করেছে'। দ্বিতীয় কারণ, নুসরাত আসামিদের একজনের প্রেমের প্রস্তাব বার বার প্রত্যাখ্যান করায় ঐ ব্যক্তি তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। হত্যার এই পরিকল্পনা তারা মাদ্রাসার আরও পাঁচজন ছাত্রছাত্রীকে জানায়, যাদের দুজন ছাত্রী। 'একটি মেয়ের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় তিনটি বোরকা এবং কেরোসিন জোগাড় করে আনার।'

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। ছবি : সংগৃহীত

বনজ মজুমদার আরও বলেন, ৬ই এপ্রিল পরীক্ষার দিনে সকালে পরীক্ষা শুরুর কিছু আগে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐ দুই ছাত্রীর একজন অন্য এক ছাত্রীকে মারা হচ্ছে বলে নুসরাতকে ফুসলিয়ে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে অপেক্ষারত অন্য কজন ওড়না পেঁচিয়ে তাকে বেঁধে ফেলে কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাইরের গেটে বেশ কজন পাহারায় ছিল। ঘটনা শেষে, কয়েকজন বোরকা পরে বেরিয়ে যায়।

জ্বলন্ত অবস্থায় ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে নুসরাত, মৃত্যুর আশঙ্কায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়ই অ্যাম্বুলেন্সে তীব্র যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে তার ওপর ঘটা নির্মমতার বর্ণনা করেন। ভাইয়ের মোবাইল রেকর্ড করা হয় বলে জানায় কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম 'আল-জাজিরা'। নুসরাত সেই ভিডিওতে বলে, 'ওই শিক্ষক আমাকে স্পর্শ করেছে, আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব।' তার ওপর হামলাকারীদের কয়েকজনকে চিহ্নিতও করেন নুসরাত।

এমনকি ৬ই এপ্রিল তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নুসরাত জাহান সন্দেহভাজনদের সম্পর্কে তার ভাইয়ের কাছে যে বিবৃতিও দিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে প্রথমে তাদের সন্দেহ হলেও পরে তাতে সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন তারা বলে জানান বনজ কুমার মজুমদার।

নুসরাতকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়া ৫ জন। ছবি : সংগৃহীত

শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত নুসরাত লড়াই করে গেছেন, দেশের নির্যাতিত নারীদের জন্য নুসরাত যে সাহসের পথ দেখিয়েছেন, যদি এখন সেই নৃশংস হত্যাকারীসহ পুরো ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়া যায় তাহলে কোনো নির্যাতিতাই আর তাদের ওপর অত্যাচারের বিচার চাইতে সাহস দেখাবেন না। নুসরাতরা হারিয়ে যাবে, বেঁচে থাকবে নরপশুরা।

নুসরাতের হত্যাকাণ্ডে পুরো বিশ্বে এক নিন্দার ঝড় শুরু হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই নির্মমতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সম্পাদক ও লেখক মরিয়ম খান বলেন, 'সমাজে নুসরাতের মতো তরুণীদের জন্য যথাযথ স্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। আমি এর জন্য শুধু পুরুষদের দায়ী করব না, #মিটু আন্দোলনে এসব তরুণীদের জন্য উপযুক্ত স্থান তৈরি করতে না পারায় আমি নারীদেরও সমানভাবে দায়ী মনে করি।'

ছবি : সংগৃহীত

ব্রিটিশ গণমাধ্যম 'দা গার্ডিয়ান' জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে জানায়, 'মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনীত নারী নির্যাতনের অভিযোগ সত্য। এই অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশের অবস্থানকে দোষারোপ করা হয়। সংস্থাটির প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হক বলেন, 'জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে মাদ্রাসা যদি অভিযোগটির ব্যাপারে যথাযথ আচরণ করত তাহলে হয়তো এমন নৃশংসতার ঘটনা কখনোই ঘটত না।'

পুলিশের কাছে উপস্থাপিত নুসরাতের ধারণ করা ভিডিওতে বলেছিল, 'মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ২৭শে মার্চ তাকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়, সিরাজ-উদ-দৌলা নামের নরপশু অধ্যক্ষ তাকে অনুপযুক্তভাবে স্পর্শ করে। তিনি সে দিন কোনোভাবে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং সে দিনই পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করে। 'স্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল'

ছবি : সংগৃহীত

পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা তার অভিযোগের পুরো ঘটনার ভিডিও ধারণ করে, পরে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় ক্রন্দনরত নুসরাতকে তার ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিতে দেখা যায় এবং সেখানে সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে এই ঘটনাকে 'এটাকে সামান্য ঘটনা' হিসেবে অভিহিত করতে দেখা যায় এবং নুসরাতকে মুখ থেকে হাত সরাতে বলতে শোনা যায়। 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট'

মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে 'এশিয়া টাইমস' তাদের শনিবারে (২০ এপ্রিল) প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার ফলে বাংলাদেশে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির হার ক্রমেই বাড়ছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামক একটি বেসরকারি দল জানায়, সারা দেশে দোসরা এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত আঠারো বছরের কমবয়সী অন্তত ৩৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। আরও ৮ জন ধর্ষণ অথবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার শিকার হয়।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের সুবিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়। তিনি বলেন, 'কোনো অপরাধীই বিচারের হাত থেকে রক্ষা পাবেন না। অভিযুক্ত নরপশু সিরাজকে পুলিশ আটক করেছে, বর্তমানে কারাগারে আছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা নুসরাতের ভিডিও ধারণ করেছিল তাকে প্রত্যাহার করা হয়। নুসরাতের পিতা বলেন, আমরা তদন্তের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট তবে, অতিদ্রুত বিচারিক কার্য সম্পাদনের আশা করছি।'

ছবি : সংগৃহীত

নারীদের ওপর এমন নির্যাতনের সুবিচার পেতে নুসরাতের মতো সবাইকে প্রাণ দিতে হলে হয়তো বাংলাদেশ থেকে নারীদের অনেককে মরতে হবে। জীবিতাবস্থায় পুলিশের কাছে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিল নুসরাত, তখন যদি পুলিশ প্রশাসন গাফিলতি না করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে অন্যরকম ঘটনা ঘটত আজ। নুসরাতের মতো দেশের আনাচে কানাচে রোজই বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষের লালসার শিকার হতে হচ্ছে অসংখ্য নারীদের।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র নামক বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংগঠনের বরাত দিয়ে 'দা টেলিগ্রাফ' জানায়, ২০১৮ সালে ৭০০ ধর্ষনের মামলা হয়েছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে নারীদের এখনও অনেকে ভোগ্যপণ্য মনে করেন। নারীদের ধর্ষণ করে সেই নারীর ওপরই দোষ চাপানোর মতো অফুরন্ত উদাহরণ পাওয়া যাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

জাতীয় মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩-১৭ এই পাঁচ বছরে ধর্ষণের সংখ্যা দেড় গুণ, উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা প্রায় দুই গুণ, গৃহপরিচারিকা আত্মহত্যা চার গুণ ও বাল্যবিয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীদের ৫১ ভাগই সাইবার ক্রাইমের শিকার। এর মধ্যে নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে বিগত ১০ বছরে বিভিন্নভাবে নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা, উত্ত্যক্ত, পাচার, শ্লীলতাহানি, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু।

ধর্ষকের হাতে ধর্ষিত হবার পরে দুর্ভাগা বাঙালি নারীকে যেতে হয় এক সিরিজ ধর্ষণের মধ্য দিয়ে। পুলিশ, সমাজ, গণমাধ্যম, স্বজন, বন্ধুদের কাছে সে যেন ধর্ষিতা হয়ে ওঠে, তার আগের পরিচয় মিলিয়ে যায় পুরুষের ঘৃণ্য লালসার কাছে। যে হিংস্র পশুর হাতে নারীটি ধর্ষিত হচ্ছে, সেই পুরুষকে সমাজে যে অপরাধের দৃষ্টিতে দেখা হয়, ধর্ষিতাকে দেখা হয় আরও ঘৃণার চোখে।

ছবি : সংগৃহীত

নিজের পরিবারের কাছেও অনেক সময় মুখ দেখাতে লজ্জা পায়, ধর্ষিত হয়ে অপরাধটা যেন সেই করেছে। ধর্ষক হওয়া এই সমাজে যত বড় অপরাধ তারচেয়ে ধর্ষিত হওয়াটা আরও বড় অপরাধ। কারণ, সে এর পর থেকে প্রতিদিন মানুষের দৃষ্টিতে, কথায়, আচরণে ধর্ষিত হতে থাকে। নুসরাতের মতো যারা সাহসী না তারা বার বার ধর্ষিত হয়েও তাই মুখ ফুটে বলতে পারে না, বললে যে বাঁচার আর উপায় থাকবে না। সমাজ তাকে রোজ ধর্ষণ করবে এরপর থেকে। এসব কারণে, যৌন নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যাটা জানা সম্ভব না। হয়তো আসল সংখ্যাটা শুনলে আমাদের চোখ কপালে উঠে যাবে।

যে দেশে নুসরাতের সহপাঠী, নারী হয়েও তার সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে, নরপশু সিরাজের জন্যে, নুসরাতের বিরুদ্ধে বিচারের জন্য রাস্তায় নামতে পারে, সে দেশের মানুষ আর যাই হোক, নারীদের সম্মান দিতে জানে না। নারীকে যদি ন্যূনতম মানুষের মর্যাদাও দিতে পারত তাহলে হয়তো নির্যাতনের হার কমে আসত।

বাংলাদেশের সবচেয়ে হাস্যকর বিচার হচ্ছে, ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে ধর্ষিতার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়া। যে নরপশু লড়াই করে শিকার ধরত, সেই নরপশুর খাঁচার ভেতরেই সমাজ সেই শিকারকে তুলে দিচ্ছে। এমন ভয়ঙ্কর হাস্যকর বিচারের উদাহরণ এই সমাজে বহু মিলবে। নারী জাতির মাধ্যমেই যে বিশ্বে মানব সমাজের আবির্ভাব, সেই স্থান থেকেও যদি নারীদের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা ধারণ করতে পারে পুরুষ সমাজ, তাহলে সমাজ থেকে এই ঘৃণ্য অপরাধের মাত্রা হয়তো কমত।

ছবি : সংগৃহীত

বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরিবর্তনের মাধ্যমে, পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টাতে পারলেই কেবল নুসরাতদের পরিণতির মাত্রা কমে আসবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসুক, নারীকে যথার্থ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখুক বাংলাদেশের মানুষ। নুসরাতদের জীবনে আর কোনোদিন এমন শিক্ষকের লালসার শিকার হতে না হোক, মরতে না হোক জীবন্ত পুড়ে। বিশ্বের নারীরা মানুষ হিসেবে নির্ভয়ে জীবন কাটাক, সমাজ থেকে বিকৃত লালসা মুছে যাক। মানুষ হোক মানুষের মতো, পুরুষ হোক নারীর নিরাপত্তা, সমাজ হোক তাদের অভয়াশ্রম।

ওডি/এসএমএস

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড