অধিকার ডেস্ক ২০ মার্চ ২০১৯, ২০:২০
মানুষ, সবার আগে মানবতা, এরপরেই আসলে ধর্ম, সংস্কৃতি আর সাম্প্রদায়িক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দুনিয়ার মানুষদের বাহাদুরি প্রতিষ্ঠিত। এমন কিছুই সৃষ্টির সেরা এই জীবের কাছ থেকে আশাজনক হলেও বাস্তবতা ভিন্ন প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছে। মানুষের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতীয়তাকে টিকে রাখতে গিয়ে নিঃশেষ করা হচ্ছে মানবতা। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে ব্যবহার করা হয়েছে সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় নৃশংস হামলায় প্রাণ হারানো মুসল্লিদের তথা মানবতাকে ক্ষতবিক্ষত করার ভিডিও প্রচারে।
ক্রাইস্টচার্চের মসজিদের বর্বর হামলায় অন্তত অর্ধশতাধিক প্রাণ হারায়, মস্তিষ্কবিকৃত সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে ছড়িয়ে দেন। পাশবিক শান্তির আশায় হয়তো এই উগ্র শেতাঙ্গ মুসলিম বিরোধী, মানুষ বিদ্বেষী সন্ত্রাসীটি মাথায় ক্যামেরা স্থাপন করে ফেসবুক লাইভে তা ছড়িয়ে দেয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই প্রযুক্তিক প্লাটফর্মকে মানবতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলেও মার্ক জুকারবার্গকে এখনও কোনো বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। ৫০টি প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে তার চোখের সামনে, তার সৃষ্ট দিব্যদৃষ্টির এই প্রযুক্তির সম্মুক্ষে এমন নারকীয় ঘটনা ঘটার পরেও প্রতিষ্ঠানটির নীরব অবস্থান মানবতাকে মুনাফার সামনে পরাজিত করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিকারগ্রস্ত হামলাকারীর ধারণকৃত লাইভশো পুলিশের সতর্কতার পরেই নামিয়ে নেয়া হয় যা পরে টুইটার এবং ইউটিউবের মাধ্যেম মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের কানায় কানায়। মানবতাকে রক্তাক্ত করার দৃশ্য বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করেছে একবিংশ শতকের মুনাফাকেন্দ্রীক দানবীয় এসব প্রতিষ্ঠানগুলো। ইউটিউবের মাধ্যমে ব্যপকভাবে ছড়ালেও ফেসবুকই ছিল নরপশু ওই হামলাকারীর লাইভ ব্রডকাস্টের প্লাটফর্ম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও প্রথম এই সত্যিকারের মেগালিথিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠানটি একটু কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই রঙ্গশোটির কারিগরি সমাপ্তি করতে পারত, যা আজও এই প্লাটফর্মকে ব্যবহার করে ছড়াচ্ছে।
চারদিনেরও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি প্রশ্ন মার্ক জাকারবার্গের জন্যেই থেকে গেল। ব্রিটিশ গণমাধ্যম 'দা গার্ডিয়ান'র টবি ম্যানহায়ার তার নিবন্ধে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতার কাছে প্রশ্ন করেন, 'আপনার নিজের কাছে বলার জন্য কি আছে মার্ক? মনে হচ্ছে আপনি ব্যস্ত এবং চিন্তা-প্রার্থনার পরিবর্তে ঘৃণাত্মক বক্তৃতা এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকি অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন? নিউজিল্যান্ডে তা একেবারেই ভালো কিছু না।'
'ফেসবুকে গণতন্ত্রের বিপজ্জনক প্রভাব সম্পর্কে নয়টি দেশের প্রতিনিধিত্বকারীরা যখন উত্তর খোঁজার জন্য তিরষ্কার করেছিল তখন যেমন আপনি নীরব ছিলেন এখনও কি সেভাবে চুপ থাকবেন। তারা আপনাকে চেয়ার থেকে সরিয়েছে। ক্রাইস্টচার্চে যা ঘটেছে তার তদন্তের জবাব দিতে, প্রোপাগান্ডা ও নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসবাদের প্রচার ও বিতরণের প্রক্রিয়া হিসেবে ফেসবুকের ভূমিকা জানাতে বলা হয়েছে। আমাদেরও কি আপনার চেয়ার খালি করতে হবে?'
ছবি : সংগৃহীত
এ দিকে, সিলিকন ভ্যালি সেই একই কথা বলে যাচ্ছে, তারা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ঘটানো এবং যন্ত্রগুলোকে বাজে ও নেতিবাচক কথাগুলোকে চিহ্নিত করে মুছে দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষকে নিয়োগ করে এমন ঘটনা চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো কোনো সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত এই লাইভ স্ট্রিমিংকে বন্ধ রাখা উচিত বলে মনে করছেন এই লেখক। নিঃসন্দেহে এটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল একটা কাজ তবে এটাও সত্য যে গত বছরের শেষ তিন মাসে অর্থাৎ বছরের এক চতুর্থাংশ সময়ের মধ্যে এই লাইভ স্ট্রিমিং থেকে প্রতিষ্ঠানটি ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করে।
হয়তো এই বিলিয়ন ডলার বাস্তব হুমকিতে পড়বে যদি আপনি এই পদ্ধতিটা আপাতত বন্ধ করে দেয়ার প্রতি মনোযোগ দেন। এটি শুরু এবং এটি একটি আন্তরয়ন্ত্রীয় ক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের বড় বড় টেলিকম কোম্পানির প্রধানরা আপনাকে, টুইটার এবং গুগলকে আজকের কাজের জন্য বেছে নিয়েছে। ইতোমধ্যেই ব্যবহারকারীদের একটি অংশ ঘৃণায় তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা শুরু করেছেন। পৃথিবী দেখছে যে কিছু একটা ঘটছে।
ফেসবুক, গুগল, টুইটার এবং বাকিদের জন্য টেড-টক টেকব্রো 'বিরক্তিকর' বুলিশট প্রতিদিন শ্লৈষ্মিক ছদ্মবেশের মতো দেখা যায়, যেখানে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রোজ বেআইনি ও অর্থলিপ্সাই দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক কোনো সৌভাগ্যের বাহক নয় বরং এটি বিশ্বের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রকাশনা সংস্থাও যা অভূতপূর্ব ক্ষমতা ও প্রভাবের বলয়ে বিশ্বকে আড়ষ্ট করে ফেলছে। আপনি জিন্স আর হুডি পরে যতই ছদ্মবেশ ধারণের চেষ্টা করেন না কেন, আমরা জানি আপনি কে, আপনি এই বিশ্বের ক্ষমতাধর এক নির্বোধ। আপনি এই প্রযুক্তি দানবের চেয়ার ও প্রধান নির্বাহী। এটা খুবই হাস্যকর।
ফেসবুকের প্রধান অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ বারবার নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে চাপিয়ে দিয়েছেন। জেসিন্ডা আরডার্ন নারীদের জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ, এক পরম বিষ্ময়কর ব্যক্তি। স্যান্ডবার্গ বলেছেন, 'জ্যাসিন্ডা শুধু একটি দেশের প্রধানই না, তিনি এই খেলাটা পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন।'
ফেসবুকের প্রধান অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (বামে) এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত
নিউজিল্যান্ডের মুসলিম সম্প্রদায়, ক্রাইস্টচার্চ শহর এবং নিউজিল্যান্ডের সামগ্রিক বিপর্যয়ের ফলে জেসিন্ডা প্রতিক্রিয়া কোনো সন্দেহ রাখেনি। মঙ্গলবার দেশটির সংসদে বিতর্কিত সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে জেসিন্ডার মন্তব্য এখন পর্যন্ত পরিবর্তনশীল রয়েছে যা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
জেসিন্ডা বলেন, 'চিন্তা ও ভাষার মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো যে বছরের পর বছর ধরে বিদ্যমান রয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই, তবে, এসব ছড়ানোর সংস্থা কিংবা প্রক্রিয়া একদম নতুন। আমরা কেবল পিছনে বসে থাকতে পারি না এবং এই প্ল্যাটফর্মগুলো যে বিদ্যমান এবং এসবের তা প্রকাশের দায় তাদের নেই তা বলে যাচ্ছে। তাদের প্লাটফর্মেই এসব ছড়াচ্ছে। তারা প্রকাশক। শুধু পোস্টম্যান নয়। সর্বোপরি মুনাফালোভী এবং দায়িত্বহীন।'
মার্ক জুকারবার্গ, এর আগে আপনার নবজাতক কন্যার কাছে এক আবেগঘন পত্রে আপনি এই দায়বদ্ধতার কথা স্বীকার করেছিলেন। আপনি বলেছিলেন যে, আপনার 'নৈতিক দায়িত্ব' রয়েছে। কিন্তু, নিউজিল্যান্ডের এমন বিপর্জয়ের আজকে চারদিন পার হয়ে সময় বাড়ছে, এখন পর্যন্ত আপনার কোনো মন্তব্য আমরা দেখিনি। নৈতিক দায়বদ্ধতার কোনো অর্থবহ চিহ্নই আপনার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড