এস এম সোহাগ
মানবদেহে ইমিউনোডিফিশিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) থেকে সুস্থ হতে ব্রিটিশ গবেষকদের একটি পরীক্ষা নতুন দিক উন্মোচন করেছেন। যুক্তরাজ্যের এক রোগীর এইচআইভি স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টের পরে তার দেহে ভাইরাসটি 'সনাক্তকরণের অযোগ্য' হয়ে উঠেছে। যার অর্থ হচ্ছে প্রাণঘাতী এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি হতে পারেন লন্ডনের এই রোগী।
যদিও এই রোগী ১৮ মাস ধরে এইচআইভি থেকে মুক্তি পেয়েছে তবুও তাকে এই মুহূর্তেই সম্পূর্ণ আরোগ্য হিসেবে ঘোষণা করাকে চিকিৎসকরা খুব তাড়াতাড়ি মনে করছেন। ব্রিটিশ স্টাডির মঙ্গলবার (৫ মার্চ) প্রকাশিত বিজ্ঞান গবেষণার নিবন্ধ 'ন্যাচার' এ চিকিৎসকরা অন্য রোগীদের এখনই এই চিকিৎসার আওতায় আনতে সতর্ক করেছেন।
একটি বিরল জেনেটিক মিউটেশন যা হাড়ের মজ্জা স্টেম কোষকে এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম তা এক ডোনারের কাছ থেকে গ্রহণের তিন বছর পার হয়ে গেছে। অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ প্রয়োগের ও প্রায় ১৮ মাস পার হয়ে গেছে, অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর পরীক্ষাতেও রোগীটির দেহে পূর্বের এইচআইভি ভাইরাসও সনাক্ত করা যায়নি।
লন্ডনের অজ্ঞাত ওই রোগীর জন্য চিকিৎসক দলের নেতৃত্বপ্রদানকারী চিকিৎসক ও এইচআইভি জীববিজ্ঞানী রবীন্দ্র গুপ্ত বলেন, 'তার দেহে কোন ভাইরাস ই নাই যা আমরা পরিমাপ করতে পারি। আমরা কোন কিছুই সনাক্ত করতে পারছি না।'
বিশ্বের প্রথম এইডসকে প্রতিহত করা জার্মান নাগরিক টিমোথি ব্রাউন। ছবি : সংগৃহীত
হডকিনস ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য তাকে কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছিল এবং এর সাথে তার মধ্যে এইচআইভির প্রতিরোধী স্টিম কোষ ইমপ্লান্ট করা হয়েছিল, যার ফলে ক্যান্সার এবং এইচআইভি উভয় থেকেই মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডন, ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের সমন্বয়ে এই গবেষণা পরিচালনা হচ্ছে।
এইচআইভি আক্রান্ত শুধুমাত্র একজন রোগীর কেসই নথিভুক্ত রয়েছে, যা ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম (এডস) আক্রান্তি থেকে মুক্ত হয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে টিমোথি ব্রাউন নামক 'বার্লিন রোগী' একজন দাতার কাছ থেকে স্টেম সেল অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন করতে প্রাকৃতিক সিসিআরপি৫ জিনের দুইটি অনুলিপি মিউটেশন গ্রহণ করেছিলেন। আর তাকেই এইচআইভি / এইডসকে 'প্রতিহত' করা প্রথম ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হয়। তার লিউকেমিয়ার জন্য দুটি ট্রান্সপ্লান্ট এবং সমস্ত শরীরের বিকিরণ (রেডিওথেরাপি) দেয়া হয়, এটি আরও আক্রমনাত্মক চিকিত্সা।
ইউসিএল এর অধ্যাপক রবীন্দ্র গুপ্ত জানান, একই পদ্ধতি ব্যবহার করে আরও একজন রোগীর চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, 'বার্লিনের রোগীটি' একক কোন ব্যক্তি নয়। লন্ডনের রোগীর ওপর একই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে এইচআইভি ভাইরাস মুক্ত হতে দেখা যায়।'
গবেষণার সঙ্গে জড়িত ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক এডুয়ার্ডো ওলাভারিয়া বলেন, 'স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন সাফল্যে এইচআইভি ভাইরাস মোকাবিলা করার জন্য নতুন এই কৌশলটি বিকাশ করা যেতে পারে। কেমোথেরাপির বিষাক্ততার কারণে আদর্শ এইচআইভি চিকিত্সা দেয়া সম্ভব হয়নি, এই ক্ষেত্রে লিম্ফোমার চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল।'
এই চিকিৎসা পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে?
সিসিআর৫ এইচআইভি-১ এর ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত রিসেপ্টর। বিশ্বজুড়ে মানব দেহের কোষে প্রবেশ করতে এইচআইভি ভাইরাসকে আকর্ষণ করে। তবে, এইচআইভি প্রতিরোধে খুব কম সংখ্যক লোকের মধ্যেই সিসিআর৫ রিসেপ্টরের দুটি অনুলিপি থাকে। যার অর্থ, এই ভাইরাস শরীরের কোষগুলিতে প্রবেশ করতে পারে না, সাধারণত যা সংক্রামিত হয়।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক এডুয়ার্ডো ওলাভারিয়া। ছবি : সংগৃহীত
লন্ডন রোগীর ক্ষেত্রে ,ডোনারের কাছ থেকে এই নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশন স্টেম কোষগুলি পাওয়া যায়, যা তাকে এইচআইভি প্রতিরোধীও করে তোলে। তবে, এইচআইভি বহনকারী কোষের একটি ভাণ্ডার এখনও অনেক বছর ধরে বিশ্রামরত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে।
যুক্তরাজ্যের গবেষকরা বলেছেন যে, এইচআইভি রোগীদের জন্য সিসিআর৫ রিসেপ্টরকে লক্ষ্য করে জিন থেরাপি ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে, এখন তারা জানে যে, বার্লিনের রোগীর এইচআইভি মুক্তি ই একমাত্র উদাহরণ নয়।
ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের সংক্রামক রোগের গবেষক ও অধ্যাপক প্রফেসর গ্রাহাম কুক বলেন, 'গবেষণার ফলাফলগুলি "উৎসাহজনক" ছিল। যদি আমরা ভালভাবে বুঝতে পারি যে, প্রক্রিয়াটি কেন রোগীদের মধ্যে কাজ করে এবং অন্যদের কেন করবে না তাহলে আমরা এইচআইভি নিরাময়ের জন্য আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের কাছাকাছি থাকব। যদিও এই মুহুর্তেই এই পদ্ধতিটি এখনও অন্যান্য রোগীদের ক্ষেত্রে খুব বেশী ঝুঁকি বহন করে।'
'উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা'
কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ এবং মাননীয় কনসালট্যান্ট চিকিত্সক ডা. অ্যান্ড্রু ফ্রিডম্যান বলেন, 'এটি একটি "আকর্ষণীয় এবং সম্ভাব্য উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন" ছিল। তবে, পরবর্তী পর্যায়ে ভাইরাস যেন পুনঃর্নির্মাণ না করে তা নিশ্চিত করার জন্য অনেক বেশি ফলোআপ প্রয়োজন হবে।'
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এর অধ্যাপক রবীন্দ্র গুপ্ত। ছবি : নিউ ইয়র্ক টাইমস
তিনি আরও বলেন, 'এই পদ্ধতিতে এইচআইভি আক্রান্ত লাখ লাখ মানুষকে চিকিত্সা করার ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে ব্যবহারযোগ্য নয়, তবে, এই ধরনের প্রতিবেদনগুলি এইচআইভি প্রতিকারের চূড়ান্ত উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে।'
এদিকে, তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এইচআইভি নির্ণয় এবং জীবনকালের সমন্বয় এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (সিএআরটি) রোগীদের ওপর ফোকাস প্রয়োজন। এটি ভাইরাসকে অন্যদের কাছে প্রেরণ করা এবং এইচআইভি সংক্রমণের কাছাকাছি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে বাধা দেয়।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড