অধিকার ডেস্ক ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:৫৫
ঘরে তৈরি নীল-সাদা পলিথিন ব্যাগ কেটে বানানো আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির বিখ্যাত '১০' নম্বর লেখা শার্ট পরে অনলাইনে বিশ্ব জুড়ে সাড়া ফেলা মুর্তাজা আহমাদির কথা মনে আছে কি কারও? ইউনিসেফের অ্যাম্বাসেডর মেসি। এই দাতব্য সংগঠনটির মাধ্যমে নিজের অটোগ্রাফসহ একটি জার্সি তিনি পাঠিয়েছিলেন ক্ষুদে আফগানকে।
মেসির ভক্তের শেষ নেই। বিশ্ব জুড়ে রয়েছে এই আর্জেন্টাইন তারকার ভক্ত। কিন্তু এই শিশুটির ব্যাপারটাই আলাদা। মাত্র ৭ বছর বয়সী মুর্তাজা আহমাদি ২০১৬ সালে প্লাস্টিক ব্যাগ দিয়ে ঘরে তৈরি আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী ফুটবলার লিওনেল মেসির জার্সি পরিহিত একটি ছবির মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
তার নায়ক মেসি যখন জানতে পেরেছিলেন তার এই খুদে ভক্তের কথা, তখন কাতারে ডেকে নিয়েছিলেন পাঁচ বছর বয়সী তার এই ভক্তকে। হাতে তুলে দিয়েছিলেন অটোগ্রাফ সম্বলিত জার্সি মেসির হাত ধরে ছবি তোলায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠে মূর্তুজা। সেই খ্যাতিই যেন আফগান মেসির জীবনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভক্ত হওয়া যে অন্যায়, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মুর্তজা। তালেবানদের হাতে খুন হওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে।
ছবি : সংগৃহীত
দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে দেশটিতে যুদ্ধ চলছে, আল-কায়েদা, তালিবান কিংবা আইএস জঙ্গি যা ই বলা হোক না কেন, মাত্র ৭ বছর বয়সী এক মানব শিশুকে ধর্মের দোহাই টেনে কিভাবে হুমকি দেয়া যায়! এটা খুব একটা সহজ কাজ না হলেও যে জোরে আমরা নিজেদের মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি তা এক প্রকার একটা অযৌক্তিক কথা। একটা নিষ্পাপ শিশু তার শিশুসুলভ আচরণের কারণেই মেসির প্রতি অনুরক্ত হয়, পুরো বিশ্বের সঙ্গে সেও এই কিংবদন্তী খেলোয়ারকে তার জীবনের আদর্শিক নায়ক বানিয়ে ফেলে। 'বিবিসি নিউজ'
এমন ভালবাসা কখনও ধর্ম বা জাতিগত প্রভাবকে তোয়াক্কা করতে পারে না। এই অনুরাগ, এই ভালবাসা কখনই এমন কোন ভেদাভেদকে মাথায় রেখে আসতে পারেনা, সেখানে এই খুদে আফগান তার দেশের উগ্রবাদী তালিবানদের ধর্মীয় আগ্রাসনকে কিভাবে বুঝে উঠবে।
ছবি : সংগৃহীত
একজন অমুসলিমের (মেসি) সঙ্গে ছবি তোলায় সাত বছর বয়সী মুর্তাজা খুন করতে হন্যে হয়ে খুঁজছে তালিবান সন্ত্রাসীরা। প্রাণ ভয়ে তাকে নিয়ে ঘর ছেড়েছে পরিবার। আফগানিস্তানের গজনিপ্রদেশের জাগুরি গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম মুর্তাজার।
ধর্ম মানুষকে করবে অহিংস, ইসলাম শান্তির ধর্ম, সেই ধর্ম নিয়ে কিছু মানুষের উগ্রতা একে বানিয়ে ফেলছে মানবতা বিরোধী। যাকে নিয়ে আফগানদের গর্ব করার কথা তাকেই কিনা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তালেবান সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে কাবুলে পালিয়ে এসেছে মূর্তুজা ও তার পরিবার।
ছবি : সংগৃহীত
কাবুলের এই বস্তিতে কেমন আছে মুর্তজা? কীভাবে কাটছে তাদের দিন? সেটি জানতে তার বাব-মায়ের সঙ্গে দেখা করে সংবাদমাধ্যম এএফপির প্রতিনিধি। সেখানেই নিজেদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জানান মুর্তজার মা শফিকা-'তালেবানরা বলেছে ওরা ওকে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর কেটে টুকরো টুকরো করবে।
২০১৬ সালে মুর্তাজার পরিবার তাকে নিয়ে পাকিস্তানের শরনার্থী শিবিরে গিয়েছিল আশ্রয় নিতে, কিন্তু যখন তাদের অর্থসংকট দেখা দেয় তখন আবার ফিরে আসে নিজগৃহে।
২০১৬ সালে খুদে মুর্তাজার ভিনধর্মী নায়ক মেসি যখন তাকে দোহাতে ঢেকে নিয়ে তার সঙ্গে মাঠে হাটেন, সেই দৃশ্য দেখেনি এমন মানুষ পাওয়া বিরল। যারা দেখেছে তাদের প্রায় সবার ই চোখে আটকে আছে যুদ্ধবিধ্বস্তের স্বাক্ষর বহনকারী শিশুটির মুখের সন্তুষ্টির হাসি। তা দেখে মাঠের অনেকেই আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়েছিল, কেউ তখন ধর্মের দোহাই টেনে ভক্ত আর নায়কের মধ্যকার ভালবাসা দেখেছিল।
তালিবান হুমকি:
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা 'বিবিসি নিউজ' এর করা এক প্রতিবেদনা জানানো হয়, আফগান মেসিকে নিয়ে তার পরিবার এখন চরম আতঙ্কে রয়েছে। তার খ্যাতিই এখন তার জীবনের জন্য হুমকি। সে মুসলিম এজন্য, সে মেসিভক্ত এজন্য নাকি সে মানুষ এজন্য! ঠিক কোন কারনে তালিবানরা মাত্র ৭ বছর বয়সী নিষ্পাপ এই শিশুকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে সেটা এক বিস্ময়ের ব্যাপার।
ছবি : সংগৃহীত
মুর্তাজার মা শফিকা বার্তা সংস্থা 'এএফপি'কে বলে, 'স্থানীয় বলবান লোকেরা প্রায়ই বলছেন, মেসির কাছ থেকে আমরা অর্থ পেয়ে ধনী হয়ে গিয়েছি। এখন সেই অর্থ যদি আমরা তাদের না দেই তাহলে তারা আমাদের কাছ থেকে মুর্তাজাকে কেড়ে নিয়ে যাবে।'
মুর্তাজার পরিবার শিয়া অধ্যুষিত হাজারা নৃগোষ্ঠীদের অংশবিশেষ জাতি যারা প্রায়ই সুন্নি তালিবানদের হামলার শিকার হয়। এই গজনী প্রদেশ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এটাকে সরকার বাহিনী ও তালিবানদের মধ্যকার সংঘর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বলা হয়।
ছবি : সংগৃহীত
ইসলামি উগ্রবাদী এই দলটির আগ্রাসন গত আগস্ট থেকে বেড়ে যায়, তখন একটি মেজর হামলা চালায় তালিবান জঙ্গিগোষ্ঠি। নভেম্বরে পুনরায় এই অঞ্চলে হামলা চালালে স্থানীয় হাজার হাজার অধিবাসীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সহিংসতার প্রাদুর্ভাবে শত শত বেসামরিক, সামরিক এবং জঙ্গিরা প্রাণ হারায়।
মুর্তাজার ১৭ বছর বয়সী ভাই হুমায়ুন 'ইএফই' সংবাদ সংস্থার কাছে বলে, তারা ২ বছর ধরে মুর্তাজাকে স্কুলে পাঠাতে পারছে না, এমনকি তালিবানদের ভয়ে সে রাস্তায় খেলতেও পারছেনা।
বার্তা সংস্থা 'এএফপি'র কাছে মুর্তাজা বলেছিল, 'আমি মেসিকে খুব মিস করি, মেসির কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। আমি আশা করি কোনদিন আরেকবারের জন্য হলেও তার (মেসি) সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে। যখন আমার সঙ্গে তার দেখা হবে তখন আমি তাকে বলব "সালাম", কেমন আছেন আপনি? এবং সে আমায় ধন্যবাদ জানিয়ে বলবে, নিরাপদে থাকো। আমি তার সঙ্গে পিচে যাব যেখানে সে খেলে এবং তাকে আমি মাঠে খেলতে দেখব।'
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড