• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

'আমাকে প্রতিদিন ধর্ষণ করা হতো'

  নাবিলা বুশরা

০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৬:৫৬
রুবি মেরি
৩৫ বছর বয়সী রুবি মেরি (ছবি: বিবিসি)

রুবি মেরির জন্ম এবং বড় হওয়া সাউথ ওয়েলসে। সেখানে তার খুব আনন্দের একটা শৈশব ছিল। কিন্তু সে বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়ার সাথে সাথেই হুট করে সব বদলে গেল।

১৯৯৮ সালে যখন রুবির বয়স ১৫ বছর তখন ছুটি কাটানোর কথা বলে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

'আমরা সেখানে গিয়েছিলাম ছয় সপ্তাহের জন্য কিন্তু এরপর দুই মাস গেল, এরপর তিন মাস, এরপর সেটি গিয়ে দাঁড়াল ছয় মাসে এবং এক সময় আমরা বাড়ি ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম', বলছিল রুবি।

ruby

পাঁচ বছর বয়সী ছোট রুবি

'আমি বাবাকে বলেছিলাম আমি বাড়ি যেতে চাই। আমি স্কুলে যেতে চাই। আমি আমার বন্ধুদের কাছে ফিরতে চাই। কিন্তু তিনি শুধু বাহানা দিতেন। বলতেন, 'এখানে এসে আমরা অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছি'- আসলে এটা আমার বিয়ে দেওয়ার একটা প্ল্যান ছিল যা তিনি আমাকে কখনোই বুঝতে দেননি।

'একদিন আমি পুরো পরিবারের সাথে বসে খাবার খাচ্ছিলাম আর ঠিক সে মুহূর্তেই তিনিও এসে খাওয়া শুরু করলেন এবং আমার এখনও মনে আছে এটা যেন ঠিক গতকালকের ঘটনা, তিনি বলতে লাগলেন, "কেমন হয় আমরা যদি রুবির বিয়ে দেই?"

কথাটা শুনে আমি প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলাম। তখন আমার বয়স কম ছিল আর আমি প্রচুর বদমেজাজী ছিলাম।কথাটা শুনতেই আমি আমার খাবারের প্লেট মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললাম। দরজায় লাথি ছুঁড়তে লাগলাম, চিৎকার করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। সে মুহূর্তে আমি শুধু বুঝতে পারছিলাম না এই খবরটির সাথে আমার নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নেওয়া উচিত।'

'সে সময় আমাকে এক ধরনের আদেশ পালন পদ্ধতির মাঝে ফেলা হল। আমার একজন চাচা আসলেন এবং আমাকে সব কাজে আদেশ করতে শুরু করলেন। এটা খুব ভয়াবহ একটা ব্যাপার ছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি একজন দাসী!’

'এই বিদেশে পড়ে থাকা অবস্থায় আমি জানতাম না আমাকে কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, জানতাম না কোথায় গেলে একটা ফোন পাওয়া যাবে। কিছুই না।'

আমি ছিলাম অসম্মানিত আর বর্জিত

মেরিকে তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী একজন মানুষের সাথে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাকে তার এংগেজমেন্টের দিন 'পুতুল'র মতো করে সাজানো হয়।

'সেদিন বাড়ি ছিল হাস্যোজ্জ্বল মানুষে ভর্তি। আমার চারপাশে অনেক মানুষ, তারা আমার রুমে আসছে শুধু আমাকে এক নজর দেখার জন্য।'

'সেখানে আমি বসে শুধু একটা কথাই ভাবছিলাম, 'আমি শুধু একটি বস্তু।' আর ভাবছিলাম তোমাদের যা করার ছিল তোমরা তা করেছ আর এটা এ পর্যন্তই। আমার লক্ষ্য শুধু বাড়ি যাওয়া। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য তুমি যা খুশি করও।’

বিয়ের পরপরই তার স্বামী বাচ্চা চাইতে লাগল।

'কম-বেশি রোজ আমি ধর্ষিত হতাম শুধু মাত্র প্রেগন্যান্ট হওয়ার জন্য। কারণ সে বুঝে গেল বৃটেন যাওয়ার জন্য এটাই তার একমাত্র পন্থা। আর এই পথটার জন্য সে শুধু একটা বাচ্চা চাইছিল।'

সে সময়ে রুবি প্রেগন্যান্ট হয় আর ওয়েলসে ফিরে আসে। বাচ্চা পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখতেই রুবি পালিয়ে আসে সেখান থেকে।

'এটি সে পরিবারের জন্য আবার লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু আমি তো আসলে অনেক সময় ধরেই অসম্মানিত হয়ে ছিলাম।'

'এভাবে জোর করে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা মেনে নেওয়া আমার জন্য বেশ কঠিন একটি সিদ্ধান্ত ছিল কারণ আপনি আপনার পরিবারকে ভালোবাসেন, অবশ্যই বাসেন... কিন্তু দিন শেষে বিশ্বাসভঙ্গ মানে বিশ্বাসভঙ্গই।'

জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার বিষয়ে রুবি বর্তমানে একজন অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছে। ' পৃথিবীকে আমি এখন জানাতে পারি, বলতে পারি যে, সব সুড়ঙ্গের শেষেও একটা আলোর পথ আছে, পৃথিবীতে তোমার জন্য কোথাও না কোথাও একটা জায়গা আছে।'

'এখানেই সব সর্বনাশ আর হতাশা নয়। এটাই জাহান্নাম নয়। তোমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তোমার আশেপাশের শক্তিকে তোমারই খুঁজে নিতে হবে আর সুবিধাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এই পৃথিবীকে খুশির জায়গা তোমারই বানিয়ে নিতে হবে কারণ এটা তোমার জন্য আর কেউ করে দেবে না।'

জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া একটি অপরাধ। অথচ এ বিষয়ে সামনে এসে কথা বলার মতো সাহস থাকে না বেশিরভাগ ভুক্তভোগীরই।

তারা বলেন, যদি তাদের বাবা-মাকে আটক করে রাখা হয় আর সে সময় তাদের জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তখন না চাইতেও ভুক্তভোগীদের সে সময় চুপ করে থাকতে হয়।

ভুক্তভোগীদের সাথে কাজ করা একটি দাতব্য সংস্থা জানায়, যখন আইনজ্ঞরা তাদের 'আইনি নোটিশ' পাঠায় তখন সেটি অন্যদেরকেও ভীত করে।

২০১৪ সালে জোরপূর্বক বিয়ে একটি ফৌজদারি অপরাধ হয়ে ওঠে, কিন্তু পুরো বৃটেন জুড়ে শুধু ওয়েলসেই একটিমাত্র মামলায় চারজন দোষীকে সামনে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল।

অথচ, ওয়েলস সরকার জানায়, প্রতি বছর জোরপূর্বক বিয়ে বিষয়ক তাদের কাছে অন্তত ১০০টি মামলা থাকে।

২০১৮ সালে, বৃটেনের ১,১৯৬টি মামলায় পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ এবং স্বরাষ্ট্র কার্যালয় সমন্বিত প্রচেষ্টায় 'বাধ্য বিবাহ ইউনিট' (ফোর্সড ম্যারেজ ইউনিট) এর পক্ষ থেকে পরামর্শ আর সহযোগিতা দেওয়া হয়।

হেনা ফাউন্ডেশনের কার্ডিফ-ভিত্তিক শাহীন তাজ বিবিসি ওয়েলসের সরাসরি এক সম্প্রচারে বলেন, অপরাধীদের মধ্যে বেশিরভাগই আসলে ভুক্তভোগীদের বাবা-মা। তাদের এ বিষয়ে আরও বেশি শিক্ষাগ্রহণের প্রয়োজন।

তিনি বলছিলেন, যাদের সাথে আমি কাজ করেছি তাদের মাঝে আমি এমন একজন ভুক্তভোগীকেও পাইনি যে পুলিশ বাবা-মায়ের উপর চড়াও হতে চাইলে তারা সেটি হতে দিয়েছে- তাদের মাঝে বেশিরভাগই এই বিষয়ে পুলিশের হস্তক্ষেপ চায় না।

তাজ বিশ্বাস করেন, জোরপূর্বক বিয়ে প্রতিরোধ আদেশ আসলে পছন্দের একটি মাধ্যম- এতে তরুণদের আদালতে নিজেদের সুরক্ষার জন্য আবেদন করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, অপরাধ পদ্ধতি থেকে তারা যেন নিজেদের পরিবার থেকে দূরে থাকতে পারে।

তিনি বলেন, এই সমস্যার সমাধান একবার হয়ে গেলে খুব কম ভুক্তভোগীই আছেন যারা নিজ পরিবারে ফিরতে চায়। আমরা এমন আটটি মামলা পেয়েছি যেখানে তরুণ মেয়েরা বাড়ি ফিরে গেছে এবং জীবন উপভোগ করছে একদম নিজের মতো করে।

শামসুনিয়ার আলি নামের বাওসো দাতব্য সংস্থার একজন বলেন, ‘বেশিরভাগ বাবা-মা’ই বুঝতে পারেন না যে তারা আইন ভঙ্গ করছেন। তাদের ধারণা তারা ঠিক কাজটিই করছেন এবং এই শিশুর মাধ্যমেই একমাত্র তাদের পরিবারের লজ্জা দূর হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, 'এটা ওয়েলসে বেশ বড় একটা সমস্যা এবং এটা নিয়ে এখনও কেউ খুব বেশি কথা বলে না।

ওয়েলসেই একটু গ্রামের দিকে মেয়েদের কোনো সমর্থন নেই এবং তারা সেখানে অনেক বেশি বিপদে আছে। তাদের সেখানে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয় 'প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য’ এবং এটা কেউ জানতেও পারে না!’

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র কার্যালয় একটি উদ্যোগ নেয়। তারা বুঝেছিল, শিক্ষক আর সমাজসেবীরা খুব সহজে তরুণদের সাথে গভীরভাবে মিশতে পারত। এ বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে আগে কারা এই সমস্যায় ভুক্তভোগী তাদের জানতে হবে। আর ভুক্তভোগীদের সাথে মিশে তারা যখন ‘জোরপূর্বক বিয়েতে বাধ্য করা হয়’-এমন বিষয়ে কোনো সন্দেহজনক মামলা নিয়ে আসত সে বিষয়গুলোকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র কার্যালয় কাজ করত।

স্বরাষ্ট্র কার্যালয়ের একজন সদস্য বলেন, 'আমরা জানি জোরপূর্বক বিয়ে আসলে একটা লুকানো অপরাধ। তাই এ বিষয়ে যাদের সহায়তা দরকার তাদের জন্য হলেও ভুক্তভোগীদের একটু সাহস নিয়ে সামনে এসে এ বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত।

তিনি বলেন, ‘রুবির মত ভুক্তভোগীর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই এ ব্যাপারটি এখন অনেকের সামনে এসেছে।

সবার জন্য আমাদের পরামর্শ কেন্দ্র খোলা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তাদের কথা শোনার জন্য এবং তাদেরকে সহায়তা প্রদানের জন্য আমাদের বিশেষজ্ঞরা সব সময় আছেন।’

তথ্যসূত্র: বিবিসি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড