• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক সংক্রমণ চার মাসে দ্বিগুণ 

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৮ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৪০
করোনা
ছবি : সংগৃহীত

কার্যকর টিকার সন্ধান মিললেও শিগগিরই করোনা মহামারি থেকে মুক্তি নিয়ে সংশয় কাটছে না। একদিকে বিশ্বজুড়ে দৈনিক সংক্রমণে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে কম সময়ের মধ্যে সবার টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। গত চার মাসে দৈনিক সংক্রমণ দ্বিগুণ হয়ে পাঁচ-ছয় লাখের কোঠায় ঠেকেছে। কোথাও কোথাও সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউও দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে স্বস্তির খবর হলো, সংক্রমণ বৃদ্ধির অনুপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়েনি। বৈশ্বিক গড় মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাণহানি কমার পেছনে ভাইরাসটি যে দুর্বল হয়ে পড়েছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে বেশি বেশি পরীক্ষা এবং করোনার সঙ্গে মানুষ অনেকটা খাপ খাওয়ায় পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেছে।

গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে প্রথমবারের মতো মানবদেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর সাড়ে ১০ মাস কেটে গেলেও এখনো ভাইরাসটির উৎস শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যদিও ডিসেম্বরের আগেই চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে মার্কিন জৈব-প্রযুক্তি কম্পানি মডার্না গত সোমবার জানিয়েছে, তাদের করোনার টিকা ৯৪.৫ শতাংশ কার্যকর বলে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার প্রাথমিক ফলে উঠে এসেছে। এর আগে মার্কিন ওষুধ কম্পানি ফাইজার এবং জার্মান জৈব-প্রযুক্তি কম্পানি বায়োএনটেক তাদের উদ্ভাবিত করোনা টিকা ৯০ শতাংশ কার্যকর বলে জানায়। মডার্না ও ফাইজার নিজেদের টিকার অনুমোদনের জন্য শিগগিরই আবেদন করবে। আর রাশিয়ার টিকা স্পুিনক ভি ৯২ শতাংশ কার্যকর বলে বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে। এদিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ডের টিকাও শিগগিরই অনুমোদন পেতে পারে। চীনের কয়েকটি টিকাও একই অবস্থায় আছে। তবে সংকটের বিষয় হলো, টিকা উৎপাদন ও সংরক্ষণের পরিকাঠামো সব দেশে নেই। যেমন ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার পরিকাঠামো প্রয়োজন। তা ছাড়া এগিয়ে থাকা টিকার কম্পানির সঙ্গে অনেক দেশের চুক্তি যেমন নেই, তেমনই উৎপাদনের সক্ষমতা নেই।

অন্যদিকে সবার জন্য টিকা নিশ্চিতকরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সে ১৭২টি দেশ নাম লেখালেও তা বেশ সময়সাপেক্ষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বাধীন এ উদ্যোগের সঙ্গে আছে কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন (সিইপিআই) এবং দাতব্য সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গাভি)। এ উদ্যোগের সদস্য রাষ্ট্রগুলো জনসংখ্যার ৩ শতাংশের জন্য টিকা পাবে। কার্যকর ও নিরাপদ টিকা পাওয়া মাত্রই এ সুবিধা পাবে দেশগুলো। এসব টিকা করোনার লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীসহ সামাজিক বিভিন্ন সেবার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। প্রতিটি দেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিকা সরবরাহের এ হার ২০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সাল শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বজুড়ে ২০০ কোটি ডোজ টিকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নত দেশ ও কোভ্যাক্সের মাধ্যমে উৎপাদিত টিকা দিয়ে বিশ্বের ৭৮০ কোটি জনসংখ্যার চাহিদা আগামী বছরের মধ্যে কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। সবার টিকা নিশ্চিতকরণে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। ফলে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ সময় লেগে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে স্বল্প মেয়াদে পরিস্থিতি খারাপের দিকে আগালেও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হওয়ার কারণে বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আর খুব বেশি দিন মহামারি হিসেবে থাকবে না। কারণ আমি মনে করি, টিকা পরিস্থিতি পাল্টে দেবে।’

ড. ফাউচি বলেন, ‘করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে টিকাকরণের পর। কয়েক দিন আগে যেহেতু স্পষ্ট হয়েছে সত্যিকার অর্থে কার্যকর টিকা প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু টিকা এলেই আমাদের লড়াই থামানো যাবে না।’

চলমান মহামারির শুরু থেকে করোনা পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক তথ্য জানাচ্ছেন ওয়ার্ল্ডোমিটারের একদল স্বেচ্ছাসেবক। ওয়েবসাইটটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০ মে দৈনিক সংক্রমণ এক লাখের কোঠা পার হয়। অর্থাৎ উহানে গুচ্ছ সংক্রমণ ধরা পড়ার ১৪১ দিন পর প্রথমবারের মতো এই সংখ্যা এক লাখ ছোঁয়। এর ৪২ দিন পর ১ জুলাই দৈনিক সংক্রমণ দুই লাখে পৌঁছে। এর সংক্রমণের গতি কিছুটা স্থির ছিল। ৬৫ দিন পর ৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংক্রমণসংখ্যা তিন লাখ ছাড়ায়। এর ৪১ দিন পর ১৫ অক্টোবর আরো এক লাখের কোঠা অতিক্রম হয়। এরপর খুব দ্রুতই সংক্রমণ বাড়তে থাকে। ১৩ দিনের ব্যবধানে ২৮ অক্টোবর দৈনিক সংক্রমণ পাঁচ লাখে পৌঁছে। আট দিনের মাথায় এই সংখ্যা ছয় লাখের কোঠাও ছাড়ায়। পরের আট দিনের মাথায় ১৩ নভেম্বর সংক্রমণে রেকর্ড তৈরি হয়। এদিন বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক ছয় লাখ ৫৭ হাজার নতুন রোগী নথিবদ্ধ হয়। এর আগে ১৬ জুলাই এই সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের চেয়ে কিছুটা বেশি। অর্থাৎ মাত্র চার মাসের ব্যবধানে দৈনিক সংক্রমণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সাম্প্রতিক এই উল্লম্ফনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বড় ভূমিকা রেখেছে।

ওয়ার্ল্ডোমিটার বলছে, গতকাল পর্যন্ত বিশ্বের ২১৪টি দেশ ও অঞ্চলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ৫৮ লাখে। এ সময়ের মধ্যে সুস্থ হয়েছে তিন কোটি ৮৮ লাখ রোগী আর প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৩৯ হাজারে।

সংক্রমণ বাড়লেও কমেছে মৃত্যুহার

করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউকালে গত ১৭ এপ্রিল এক দিনে বিশ্বে সাড়ে আট হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এরপর প্রাণহানির সংখ্যা কমতে শুরু করে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত দিনে সাড়ে তিন হাজার থেকে ছয় হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এরপর অক্টোবর পর্যন্ত দৈনিক মৃত্যু সাড়ে সাত হাজার পর্যন্ত ওঠানামা করতে থাকে। গত ৯ নভেম্বর ৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর দুই দিন পর ১১ নভেম্বর প্রথমবারের মতো এই সংখ্যা ১০ হাজার পেরোয়। গত সোমবার এই সংখ্যা সাত হাজারে নেমে এসেছে। এর মধ্যে গত ১২ নভেম্বর এক দিনে রেকর্ড পাঁচ লক্ষাধিক রোগী সেরে উঠেছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক গড় মৃত্যুহার ধারাবাহিকভাবে কমে এসেছে। গত এপ্রিলের শুরুতে দৈনিক মৃত্যুহার ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। বর্তমানে এই হার ৩.৩৫ শতাংশের নিচে।

সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যুহার কমার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করছে বলে হাফিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, বেশি বেশি পরীক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, উপযুক্ত চিকিৎসা এবং তরুণদের মাঝে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ায় মৃত্যুর আনুপাতিক হার কমছে।

যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক স্টিফেন গ্রিফিন বলেন, গত মার্চের তুলনায় মৃত্যুহার কমেছে। কারণ তখন এত বেশি নমুনা পরীক্ষার সুযোগ ছিল না। এখন বিপুলসংখ্যক মানুষ পরীক্ষার আওতায় আসায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে, ফলে মৃতের সংখ্যাও কমানো সম্ভব হয়েছে।

বর্তমানে সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সবাই অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করছে। যেমন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো বিধি মানা হচ্ছে বহু দেশে।

ড. গ্রিফিন বলছেন, শুরুতে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের কভিড-১৯-এর চিকিৎসা নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা ছিল না। এখন অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়ায় মৃত্যুর হার কমছে।

তরুণ ও স্বাস্থ্যবান মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় প্রাণহানির সংখ্যা কমছে উল্লেখ করে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, তরুণদের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সামগ্রিক মৃত্যুহার কমে গেছে। কারণ তরুণ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকজনের এই ভাইরাসে মৃত্যুঝুঁকি কম।

এদিকে মিউটেশনের ফলে করোনাভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়েছে—এমন দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন যুক্তরাজ্য সরকারের বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা স্যার প্যাট্রিক ভ্যালেন্স। তিনি বলেন, ভাইরাসটির রূপ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকি আগের তুলনায় কমে গেছে।

কোথাও কোথাও সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ

প্রতিবেশী দেশ ভারতে সুস্থতার হার আশাব্যঞ্জক হলেও দেশটির রাজধানীর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না। এরই মধ্যে সেখানে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ১০০ করে প্রাণহানি হচ্ছে সেখানে। অবশ্য দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র কুমার জৈন গতকাল বলেছেন, দিল্লি এরই মধ্যে সংক্রমণের চূড়া পেরিয়েছে। সে কারণে নতুন করে লকডাউনের প্রয়োজন নেই। তবে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।

সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ চলছে যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ এলাকায়। মূলত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরও সংক্রমণের গতি বেড়েই চলেছে। ব্রাজিল ও ফ্রান্সের অনেক এলাকার পরিস্থিতি নতুন করে খারাপ হতে শুরু করেছে। এসব এলাকায় তৃতীয় ঢেউ চলছে।

নতুন করে লকডাউনে যায়নি বেশির ভাগ দেশ

করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউ মোকাবেলায় যেভাবে বেশির ভাগ দেশে লকডাউন জারি করা হয়েছিল, বর্তমানে সে রকম চিত্র খুব কম দেশে দেখা যাচ্ছে। এর বদলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, বার-রেস্তোরাঁ, ব্যায়ামাগার, বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ রাখা এবং জমায়েত কমানোর মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে বেশির ভাগ দেশ। ফ্রান্স ও স্পেনে রাতের বেলা কারফিউ জারি করা হয়েছে। ইতালি ও গ্রিসেরও একাধিক এলাকায় একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জার্মানিতে স্কুল চত্বরে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাদা বিধি আরোপ করা হয়েছে। বর্তমানে আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালির কিছু এলাকা, লেবানন, লিথুয়ানিয়া ও মঙ্গোলিয়ায় লকডাউন চলছে।

ওডি/

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড