• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতি, চীনের উত্থানে চাপে ভারত

চীনের এই ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার উৎস হলো ‘নির্ভার বিনিয়োগ’

  এস এম সোহাগ

০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:২৭
ভারত-চীন
ছবি : প্রতীকী

উপনিবেশবাদ এক সময়কার বিশ্বে ক্ষমতাধর দেশগুলোর বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার ছিল। তারাই শাসন করত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। এমনকি বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও শাসন করত ব্রিটেন। কাগজে-কলমে উপনিবেশবাদের অবসান ঘটলেও পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটেনি। নব্য-উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের চাদরে ঠিকই এই দখলদারী তত্ত্বটা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। ইউরোপ ছিল এক উপনিবেশবাদের চালিকাশক্তি, গেল শতকে ইউরোপের প্রায় ৫০০ বছর ধরে টিকিয়ে রাখা শাসনক্ষমতার বিলুপ্তি ঘটে। উত্থান হয় আমেরিকা-রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী শাসনের। নব্য উপনিবেশবাদে নতুন সদস্যের আবির্ভাব ঘটেছে।

এশিয়ার ক্রমবর্ধমান দুটি রাষ্ট্র চীন ও ভারত যারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে বিশ্বে এই দু-দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিত বিদ্যমান। দেশ দুটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও যাদের রয়েছে পাশাপাশি অবস্থান। বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা বেশি পরিলক্ষিত আর চীন এই দক্ষিণ এশীয় দেশের তালিকাভুক্ত না হয়েও ক্রমেই তারা এ অঞ্চলে তাদের তৎপরতা জোরদার করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীনের এমন হস্তক্ষেপ ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে। একে অন্যকে ছাপিয়ে যাবার যে প্রতিযোগিতা চলছে সেখানে চীনের এমন তৎপরতা ভারতের জন্যে যৌক্তিকভাবেই চাপের কারণ। নেপাল, ভুটান আর শ্রীলংকার ওপর ভারতের যে প্রভাব আর অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠিত তা চীনের সংশ্লিষ্টতায় ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। নেপালকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের কাছে বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উপনীত।

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো ক্রমেই ঝুঁকছে চীনের দিকে

ভারত যখন বড় দেশগুলোর সঙ্গে দফা-রফায় ব্যস্ত অথবা আঞ্চলিক নানা প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীন, চীন তখন এসব দেশের বাস্তব সমস্যায় নজর দিয়েছে, স্থানীয় দ্বন্দ্বগুলো কাজে লাগিয়েছে, যে কোনো সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে একই নীতি নিয়ে কাজ করে চলেছে তারা। এভাবে অল্প দিনের মধ্যেই এই অঞ্চলে চীন তার অবস্থান শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে চীনের এমন হস্তক্ষেপ একেবারেই নতুন, এই অঞ্চলের রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব ক্রমেই দিক পাল্টাচ্ছে। বিংশ শতকের শেষার্ধে এসে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচোনার কেন্দ্রবিন্দু। আন্তর্জাতিক গুরুত্বের দিক থেকে যেসব বিষয়কে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয় তার মধ্যে রয়েছে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কুটনৈতিক শক্তি। এই মানদণ্ড অনুযায়ী বিশ্বে ক্রমেই উন্নতি লাভ করছে এশিয়ার এই দেশদুটি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া, এই বাক্যে বিশ্ববাসীর গভীর এক পরিচিতি আছে। দেশ দুটি তাদের নিজস্ব ভূখণ্ড ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে দখলদারিত্বের মনোভাবের কারণেই অধিক পরিচিত। পৃথিবিতে ঘটে যাওয়া দুটো বিশ্বযুদ্ধে দেশদুটি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গিয়েছিল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে। এজন্যে দেশদুটিকে বন্ধুত্বপূর্ণ দুটি রাষ্ট্র হিসেবে ধরে নিলে তা বাস্তবজ্ঞানের সঙ্গে হতে পারে সাংঘর্ষিক। একে অন্যের বিরুদ্ধে চলমান কুটনৈতিক দ্বন্দ্ব, দীর্ঘকাল ধরে চলা তাদের স্নায়ুযুদ্ধের কথাও মনে করিয়ে দেয় তাদের আন্তঃসম্পর্কের কথা। সিরিয়া, আফগান, মধ্য এশীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একে অন্যের বিরোধিতাও বুঝিয়ে দেয় তাদের বিপরীত অবস্থানের কথা।

শুধু পশ্চিমা রাজনীতি, মধ্য এশীয় বা আফ্রিকান রাজনীতিতেই নয় দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতেও দেশ দুটির অংশগ্রহণ বেশ গুরুত্বতার দাবিদার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধেও তারা ভিন্ন অবস্থানে ছিল। বাংলাদেশকে সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা এবং পাকিস্তানকে মার্কিন সমর্থন তাদের প্রতিপক্ষ পরায়ণতাকেই ফুটিয়ে তুলেছিল। সে সময়ে বাংলাদেশের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। শুধুমাত্র মানবিক দিক বিবেচনায় ভারত যে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল যুদ্ধজয়ে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। বাংলাদেশকে সাহায্য করা ভারতের নিজের জন্যেই অতিগুরুত্বপূর্ণ ছিল কেননা তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে এই অঞ্চলে দুর্বল করাটা তাদের জন্যে উপকারের এবং একই সাথে প্রয়োজনের।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিপিপির প্রধান বেনজির ভুট্টোর গর্ব করে দেওয়া ভাষণের কথা মনে করা যাক। প্রবল হর্ষধ্বনি দিতে থাকা আমেরিকান দর্শক শ্রোতাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের পাকিস্তান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করেছে। স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে থাকার তাদের ইচ্ছাকেই আমরা যৌথভাবে নষ্ট করে দিয়েছি!’ আফগান যুদ্ধ পরবর্তী ওই সময়টাতে রুশ বাহিনী একদিকে দিকভ্রান্ত হয়ে পিছু হটছিল, অন্যদিকে চেচেনিয়া রাশিয়া ভেঙে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। এমন কি খোদ মস্কোতে অনেক বিস্ফোরণ ও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

অস্ত্র রপ্তানিতে দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে শীর্ষে চীন

বর্তমান চিত্রের নাটকীয় পরিবর্তন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেয়া যাক। এই অঞ্চলের বর্তমান চিত্র মুদ্রার উল্টো পিঠকেই যেন নির্দেশ করে। বিগত সময়ের তুলনায় বর্তমানে পাকিস্তান ও রাশিয়ার সম্পর্ক সবচেয়ে মধুর, যা ছিল একসময়ে ঠিক উল্টো। তার কারণ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের একই রকম নাটকীয় পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেই তার ‘কৌশলগত অংশীদার’ মনে করে, যা ১৯৭০-৭১ সালে কল্পনা করা অসম্ভব ছিল। ওই সময় বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রেক্ষিতে তার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে।

আন্তর্জাতিক এসব নতুন মেরুকরণে সবচেয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে চীন, অর্থনৈতিক আর সামরিক দিক থেকে তারা সমান টক্কর দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। নিজ মহাদেশে সীমান্তবর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্বকে যে কোনো একদিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করাটা যৌক্তিক হবে না। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ চীন সাগরে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে চীনের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। চীনের এই আগ্রাসী ব্যবহার সামনের বছরগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম সম্মেলনে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং চীনকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চীনের এই তৎপরতার পিছনে মূলত বেশ কয়েকটি কারণ ও উদ্দেশ্য কাজ করছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে-

 বিশ্ব ক্ষমতার বলয়ে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠতায় দ্রুত উত্থান।  ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণে এবং অভিন্ন দৃষ্টিকোণের আলোকে ভারত কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক।  সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ভারতের আফগানিস্তানে অবস্থান গ্রহণ।  মুসলিম বিশ্বে ইসলামিক শক্তি হিসেবে পাকিস্তান ইরানের পারমাণবিক শক্তি অর্জন ও প্রযুক্তিগতভাবে খুব দ্রুত এগিয়ে যাওয়া।  দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিপুল প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি।  চীন ও ভারতের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব।  আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে কৌশলগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব অত্র অঞ্চলকে নতুন করে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ভারত পরাশক্তি চীনকে নিয়ে প্রতিনিয়তই বিনিদ্র উদ্বিগ্নতায় আছে। কারণ চীন-ভারতের চতুর্দিকের রাষ্ট্রগুলোকে প্রায় নিজস্ব বলয়ে নিয়ে ফেলেছে। পাশাপাশি ভারত মহাসাগর ও আরব মহাসাগরে অবস্থিত দেশগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চীন নৌশক্তির মাধ্যমে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতকে প্রায় নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের সহায়তায় আফগানিস্তানে ভারত অবস্থান নিয়েছে মূলত পাকিস্তানকে চাপে রাখার জন্য এবং পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কে দিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদে পাকিস্তানের হাতকে গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য করার জন্য। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে সামরিক ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতাকে সংকুচিত করে দিয়ে কৌশলগত স্বার্থ হাসিলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ দিকে নিজের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে পাকিস্তান বর্তমানে রাশিয়ার নকশায় নির্মিত অত্যাধুনিক ট্যাংক কেনার কথা ভাবছে। এর আগে দেশটি রাশিয়ার কাছ থেকে চারটি যুদ্ধ হেলিকপ্টার ও পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে থাকা জেএফ-৭ যুদ্ধবিমানের জন্য নতুন ইঞ্জিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই দুই দেশ যৌথ সামরিক মহড়াও করেছে, যা ভারতের ভ্রূ-কুঞ্চিত করেছে। তাছাড়া পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে দীর্ঘপাইপলাইন যাওয়ার প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত থাকা একটি ১ হাজার কোটি ডলারের বিস্তারিত জ্বালানি চুক্তিও চূড়ান্ত হওয়ার পথে। পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্কও ভারতকে ভাবাচ্ছে। কেননা এই দেশ দুটিই ভারতের জন্য মুখ্য চিন্তার বিষয়।

২০১৬ সালের রাশিয়া-পাকিস্তান যৌথ সামরিক মহড়া। ছবি : সংগৃহীত

চিরবৈরী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা একটা আতঙ্কের বিষয়। ২০১৫ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরের পরপরই ভারত পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য মিসাইল অগ্নি-৫ উৎক্ষেপণ করে। যদিও সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০২৫ সালের মধ্যে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকায় বিশ্বে পঞ্চম স্থানে উঠে যাবে যা ভারতের জন্যে গভীর উদ্বেগের কারণ। অগ্নি-৫ নিক্ষেপের পরদিনই পাকিস্তান তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘রাদ’ বা ‘ব্রজে’র পরীক্ষা চালায়। এর আগে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। ফলে দেশ দুটি আবারও এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় নিয়োজিত হয়।

পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। পাকিস্তানের বর্তমান উন্নয়নে চীনের অবদান সবচেয়ে বেশি। বর্তমানের এই সংকটময় সময়েও চীন পাকিস্তানে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান ভারতকে শায়েস্তা করার সংকল্পে আরব মহাসাগরে ভারতের দোরগোড়ায় চীনকে দুইটি গভীর নৌবন্দর করার এবং সামরিক উপস্থিতির অনুমতি দিয়েছে। যা ভারতকে ফেলে দিয়েছে চরম আশঙ্কায় এবং সামরিক ক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধায় চীন ভারতের প্রায় পেটের ভিতরেই ঢুকে পড়ল। নয়া মেরুকরণে চীন পাকিস্তান সম্পর্ক আরও বলিষ্ঠ হয়েছে।

শুধুমাত্র পাকিস্তানই নয়, নেপালের সাথে চীনের বর্তমান সম্পর্ক ভারতের জন্যে বিপদ সংকেত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নেপালের সঙ্গে চীনের সখ্যতা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ভৌগলিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। নেপাল ভারতের নিজস্ব দেশের মতো, দেশদুটির মধ্যে আঞ্চলিক সম্প্রীতি শতাব্দীব্যাপ্তি, ভাষাগত মিল, সাংস্কৃতিক মিলসহ সব দিক থেকেই একটা পরিবারের মতো। নেপাল ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য মুখ্য একটি বিবেচ্য শক্তি, ভারত-চীনের স্থল সীমার স্থানেই নেপালের অবস্থান। স্থলবেষ্টিত এই দেশটি তাই চীন-ভারত শক্তির মেরুকরণে মুখ্য এক খেলোয়ার। হিমালয়ের এই দেশটা প্রায়ই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যায়, দেশটার দুর্দিনে চীনের আগ বাড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াটা এবং ভারতের উদাসীনতার ফলে নেপাল ক্রমেই চীনকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে বলেই বিশেষজ্ঞরা দাবি করছে।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী খাদক প্রসাদ ওলী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জি পিং। ছবি : এসসিএমপি

নেপালের সাম্প্রতিক নির্বাচনে চীন সমর্থিত বামপন্থী জোট বিপুল বিজয় পেয়েছে, পরাজিত হয়েছে ভারত সমর্থিত নেপালি কংগ্রেস। বামপন্থী জোটের সংখ্যাগুরু দল ইউএমএল- এর নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খাদক প্রসাদ ওলী আবারও প্রধানমন্ত্রী হন। ওলীর অভিযোগ, এর আগে চাপে ফেলে তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল ভারত। সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে নেপালের অর্থনীতিতে ভারতের অঘোষিত অবরোধ দুই দেশের সম্পর্ককে তলানিতে নিয়ে গেছে। নির্বাচনী প্রচারণাকালে ওলী বলেছিলেন, চীন থেকে একটি রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নেপাল পর্যন্ত আসবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আরও অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

এটা খুবই পরিষ্কার— উন্মুক্ত সীমান্ত থাকলেও নেপালের সঙ্গে আবার কবে উন্মুক্ত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে ভারত, তা অনিশ্চিত। বামপন্থীদের দুই পক্ষকে জোটভুক্ত করার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল চীনের। সুতরাং এই সরকার তাদের পক্ষে থাকবে। ভারতের অঘোষিত অবরোধ এবং ভূমিকম্প বিপর্যয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখায় চীন এতটুকু দাবি করতেই পারে।

২০১১-১২ অর্থবছরে ভারত-নেপাল বাণিজ্য হয় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পক্ষান্তরে নেপাল ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য ছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এই সম্পর্ক আরও উন্নত করতে চীন নেপালের ৬০ শতাংশ পণ্যকে শুল্কমুক্ত করেছে। সাংস্কৃতিক উন্নয়নে নেপালে প্রায় ১৯ টি চীন স্টাডি সেন্টার (সিএসসি) এবং কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে চীন।

মাধেশি বিক্ষোভ চলাকালে যখন ভারত-নেপাল সীমান্তে জ্বালানি ও প্রয়োজনীয় সরবরাহ অবরুদ্ধ ছিল, তখন বেইজিং নেপালকে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন লিটার পেট্রোল অনুদান হিসাবে সরবরাহ করেছিল, যার ফলে দু-দেশের কোম্পানির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এছাড়াও পোখরায় চীনা নাগরিকদের ভ্রমণে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে চীন ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে নিজ দেশে। বেইজিং এর সড়কে ‘মৃত্যুর আগে একবার ভ্রমন অত্যাবশকীয়’ লেখা বিলবোর্ডে পোখরাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। চীন কৌশলগত দিকথেকেই নেপালের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে।

চীন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের বিরোধপূর্ণ সীমান্ত

ভারত-চীনের মাঝে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সীমান্ত বিরোধী নিয়ে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন জায়গায় বিরোধ এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে এবং মাঝে-মধ্যেই সেটি মাথা চাড়া দেয়। ২০১৭ সালে চীন, ভুটান আর ভারতের সিকিম প্রদেশের সংযোগস্থলে একটি উপত্যকার ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি করাকে কেন্দ্র করে নতুন বিরোধের সূচনা। চীন চায় সেখানে একটি রাস্তা তৈরি করতে। কিন্তু যে জায়গাটিতে চীন রাস্তা তৈরি করতে চাইছে সেটি ভুটান ও চীনের মধ্যকার একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা।

সে উপত্যকাকে চীন এবং ভুটান-উভয় দেশই দাবি করে। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ভুটানের পক্ষে। ভারত মনে করে, চীন যদি এ রাস্তাটি তৈরি করে তাহলে কৌশলগতভাবে ভারত পিছিয়ে পড়বে। এ রাস্তাটির মাধ্যমে চীন এমন একটি জায়গায় পৌঁছে যাবে যেটি ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। চীন এমন জায়গায় সড়ক নির্মাণ করতে চাইছে যার পাশেই ভারতের ২০ কিলোমিটার চওড়া একটি করিডোর আছে। এই করিডোরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো মূল ভারতের সাথে সংযোগ রক্ষা করে।

উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে উভয় দেশ সীমান্তে তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে এবং একটি মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সড়ক নির্মাণ না করার জন্য ভুটানের তরফ থেকে চীনকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ভুটান বলছে, এ ধরনের সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে চীন আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন করছে।

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয় ঘটে। ছবি : সংগৃহীত

ভারত মনে করে সিকিম রাজ্যটি তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সিকিম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারত চীনের যে কোন আগ্রাসনের জবাব দিতে পারে। চীন এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে বলেই সেখানে তাদের কৌশলগত অবস্থান জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। ভারতের দাবি, ১৯৬২ সালের ভারত এবং ২০১৭ সালের ভারত এক নয়। এ দিকে, ১৯৬২ সালের যুদ্ধের কথা ভারতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে চীন। দেশটি বলছে চীন আগের তুলনায় এখন আরও বেশি শক্তিশালী। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান এই উন্নতি ভারতের জন্য ভয়াবহ অস্তিত্বসংকটের কারণ হতে পারে। কেননা এই অঞ্চলের আঞ্চলিক কর্তৃত্ব ভারতের একক দখলে ছিল। সেখানে ভারতের কাছ থেকে এই ক্ষমতা ক্রমেই চীনের ঝুলিতে চলে যাচ্ছে।

নেপাল, মায়ানমার, ভুটান, শ্রীলংকা এমনকি বাংলাদেশে চীনের সাম্প্রতিক আর্থিক বিনিয়োগ ও সহায়তা ক্রমেই যেন ভারতের একক আধিপত্যকে হ্রাস করছে। দক্ষিণ এশিয়ান রাজনীতিতে চীনের এমন অনুপ্রবেশ এবং ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানকে সামরিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে সাহায্য করাকে ভারতের জন্য পরোক্ষ আঘাত বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

চীনের এই ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার উৎস হলো, ‘নির্ভার বিনিয়োগ’। এ অঞ্চলের দেশগুলো যেখানে ভারতীয় ঋণের সঙ্গে তাদের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনৈতিক স্বার্থ দেখে, চীনের বিনিয়োগকে সেই তুলনায় অনেক নিরাপদ মনে করছে। চীনের এ সাফল্যের পেছনে কাজ করছে তাদের কূটনৈতিক সামর্থ্য, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দক্ষতা এবং তথাকথিত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি। চীনের বর্তমান সরকার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় আগ্রাসী এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী। প্রেসিডেন্ট শির খোলামেলা ঘোষণা— এখন এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক শক্তি হিসেবে বেইজিংয়ের উত্থানের সঙ্গে অন্যদের অভিযোজন করে নিতে হবে। চীন এটা কখনোই মেনে নেয়নি যে, দক্ষিণ এশিয়া ভারতের একচেটিয়া প্রভাবের অধীনে থাকবে। এখন তারা ধীরে ধীরে সে অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বাণিজ্যিক কর্তৃত্বেও যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বর্তমানে একমাত্র পরাশক্তি যারা ভারতকে উন্মুক্তভাবে সমর্থণ করে যাচ্ছে, অস্ত্র বিনিময়সহ সম্প্রতি ভারত-মার্কিন পররাষ্ট্র পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বহু সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক অস্ত্রচুক্তি এবং যৌথ মহড়া ভারতের জন্য চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে অবনতিতে পাকিস্তানকে যতটা দুর্বল না বোধ করছে তার চেয়ে চীন, রাশিয়ার সাথে সম্পোর্কন্নয়নের ফলে আরও বেশি শক্তিশালী হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করছে। ভূরাজনীতির দিক থেকে চীন-পাকিস্তান সম্প্রীতি যেন ভারতের জন্য চরম উদ্বিগ্নতার বিষয়।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র পর্যায়ের বৈঠক। ছবি : সংগৃহীত

দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনীতিতে চীনের এমন অংশগ্রহণ এর আগে দেখা না গেলেও বর্তমানে তাদের তৎপরতায় ভারত যে গভীর চাপের মধ্যে পড়ে গেছে তা বেশ স্পষ্ট। চলমান চীন-মার্কিন বাণিজ্য দ্বন্দ্ব, রাশিয়া-মার্কিন কূটনৈতিক উত্তেজনার সুফল যদি পাকিস্তান কাজে লাগায় তাহলে সত্যিই ভারত হয়ে পড়বে কোণঠাসা। ভারতের সাথে পাকিস্তান-চীনের সরাসরি সীমান্ত রয়েছে, ভুটান-নেপাল যে বৃহত্তর ভারতেরই অংশ তা বলাইবাহুল্য, এদের অবস্থান একেবারে ভারতের ভেতরেই। আর এসব দেশের সাথে চীনের সখ্যতা ভারতকে কতটা বেকায়দায় ফেলছে তা আঁচ করতে পারাটা খুব একটা জটিল না। কোণঠাসা ভারত এই ভূ-রাজনৈতিক রাজনীতিতে কতটা সুবিধা করতে পারে এবং চীনের তৈরি চাপ সহ্য করে ভারত তাদের অবস্থানের কীভাবে উন্নতি সাধন করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ভারত এখনও তাদের দেশের অর্থনীতিকে ততটা শক্তিশালী স্থানে নিতে পারেনি যতটা সুবিধাজনক স্থানে চীন রয়েছে। ভারতের অনেক রাজ্যে এখনও ভয়াবহ দরিদ্রতায় রয়েছে। দুর্নীতি আর সামজিক কুসংস্কারের বলয় থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সীমান্ত নিরাপত্তার দিক থেকে ভারত রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে, একদিকে চিরশত্রু পাকিস্তান অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন।

দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্বের প্রতিযোগিতায় যে নতুন মেরুকরণের সূত্রপাত হয়েছে তাতে ভারত যদি সঠিক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে ভারতকে দুর্দশার ঘূর্ণিপাকে পড়ে যেতে খুব একটা সময়ের প্রয়োজন পড়বে না।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড