আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি প্রত্যাহার করার বর্ষপূর্তি হতে চলেছে শিগগির। মাঝের এই একটা বছরে কাশ্মীরে ঠিক কী কী পাল্টে গেছে আর কীভাবে তা হয়েছে, তা নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদন করছেন। আজ প্রথম পর্ব।
ফ্রান্স থেকে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, আর মাঝ-আকাশে জ্বালানি ভরে পাঁচটি অত্যাধুনিক 'রাফাল' যুদ্ধবিমান ভারতে পা রেখেছে বুধবার (২৯ জুলাই)। ভারতীয় বিমান বাহিনীর বহরে এই ফাইটার জেটগুলোর সংযোজন নিঃসন্দেহে সে দেশের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে একটা অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ফ্রান্স থেকে এই বিমানগুলো যার নেতৃত্বে চালিয়ে নিয়ে আসা হলো, তিনি কাশ্মীরের অনন্তনাগের সন্তান হিলাল আহমেদ রাঠোর। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নতুন পোস্টার বয়!
হিলাল কাশ্মীরের সেই আধুনিক প্রজন্মের সন্তান, যারা তাদের জান্নাতের মতো জন্মভূমিকে কিছুতেই শেষ হয়ে যেতে দিতে চান না। সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভূখণ্ড ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ক্ষেত্রভূমি। তবে হিলাল বিশ্বাস করেন, অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে – কাশ্মীরের এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে, আর সেখানকার নবীন প্রজন্মের হাতেই রয়েছে সেই পালাবদলের চাবিকাঠি।
হিলাল আহমেদ
হিলাল আহমেদ রাঠোর কেবল চৌকস ফাইটার পাইলট-ই নন, তিনি এই মুহূর্তে প্যারিসের ভারতীয় দূতাবাসে ডিফেন্স অ্যাটাশে হিসেবেও কর্মরত। ফ্রান্স থেকে রাফাল যুদ্ধবিমানগুলোর ঠিক সময়ে ডেলিভারি আর ভারতের প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলোতে অস্ত্র সম্ভারের সংযোজন (ওয়েপেনাইজেশন) – পুরোটা তদারকি করেছেন তিনি। আর তার নেতৃত্বে পাঁচটা রাফাল ভারতের আম্বালায় এসে নামার পর তিনি সারা ভারতেই এখন নায়কের সম্মান পাচ্ছেন।
শ্রীনগরে কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তৌসিফ রায়নার কথায়, 'আসলে কাশ্মীরে এখন তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ভাবছেন পেছনে তাকিয়ে আর লাভ নেই, যা হওয়ার হয়ে গেছে। কাশ্মীরটা দিনে দিনে ফিলিস্তিনের মতো ভবিষ্যৎ-বিহীন হয়ে উঠুক তারা অনেকেই সেটা চান না। ৩৭০ ধারার অবলুপ্তিও হয়তো সেই ভাবনাটা ট্রিগার করাতে সাহায্য করেছে – আর তারাও এখন নতুন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে ঝলমলে ক্যারিয়ার গড়তে চাইছেন, কেউ আবার নিজের প্যাশনের পেছনে ছুটছেন। হিলাল আহমেদ রাঠের এদের সবার জন্যই একজন রোল মডেল!'
হিলাল একা নন। কাশ্মীরের নতুন স্বপ্নের দিশারি এখন অনেকেই। তাদেরই কয়েকজনের প্রসঙ্গ আলোচিত হবে আজকের প্রতিবেদনে।
শারমিন খান
রাজৌরি জেলার মাঞ্জাকোট গ্রামে সরপঞ্চ বা গ্রাম প্রধানের নাম শামরিন খান। মাত্র ২৪ বছরের ঝকঝকে সপ্রতিভ তরুণী, নার্সিংয়ে স্নাতক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভালবেসে চলে এসেছেন রাজনীতিতে। কাশ্মীরে জঙ্গিদের ভয়ে আজও যেখানে ডাকাবুকোরাও রাজনীতিতে নামতে ভয় পায়, শামরিন সেখানে সোৎসাহে পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়েছেন, ভোটে জিতে হয়েছেন গ্রামের সরপঞ্চ।
পুরো কাশ্মীরেই এখন সবচেয়ে কম বয়সী গ্রাম প্রধান তিনি। লকডাউনের সময় নিজের গাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বোঝাই করে যেভাবে এলাকায় বিলি করে বেড়িয়েছেন, সে গল্প এখন রাজৌরির মুখে মুখে ফিরছে।
কিংবা ধরা যাক মুনির আলমের কথা। চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই মুনির একজন প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু অঙ্ক পড়ানোটাই এখন তার নেশা ও পেশা। কাশ্মীরের তরুণরা যাতে বিভিন্ন এনট্রান্স পরীক্ষায় অঙ্কে ভাল করে আরও বেশি সংখ্যায় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ হয়ে উঠতে পারে তার জন্য বহু বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে আসছেন তিনি। তবে লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের অনলাইন ক্লাস নিতে গিয়ে মহা সমস্যা দেখা দিল, কারণ ইন্টারনেটের স্পিড সেখানে বেশ কম।
মুনির আলমের ক্লাস
কিন্তু পরোয়া করলেন না মুনির আলম। শ্রীনগরের ঈদগা ময়দানেই শুরু করে দিলেন তার ওপেন এয়ার ক্লাস। ভোর পাঁচটা বাজতে না-বাজতেই শহরের মাঝে ওই বিশাল পার্কে দুটো হোয়াইট বোর্ড নিয়ে রোজ ঢুকে পড়েন তিনি, মিনিট পনেরোর মধ্যেই চলে আসে তার ছাত্রছাত্রীরা। তারপর খোলা আকাশের নিচে দু-তিন ঘণ্টা ধরে চলে অঙ্ক ক্লাস। মাস্ক পরে, বিশাল পার্কে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই বসতে পারে তারা। ইন্টারনেট স্লো বলে কাশ্মীরের পরীক্ষার্থীরা যাতে বাকি ভারতের চেয়ে পিছিয়ে না-পড়ে, সে জন্যই 'মুনির স্যারে'র এত আয়োজন!
আরও পড়ুন : দখলকৃত নতুন ভূখণ্ডের মানচিত্র জাতিসংঘ-গুগলে পাঠাচ্ছে নেপাল
শ্রীনগরের মেয়ে আফসানা আশিকের গল্পও কম আকর্ষণীয় নয়। এক সময় বন্ধুবান্ধবের সাথে মিলে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন দেখলেই পাথর ছোঁড়াটা ছিল তার প্রিয় নেশা। তবে সেটা প্রায় আট বছর আগের কথা, এখন আফসানা কাশ্মীরের মহিলা ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন, তুখোড় গোলকিপার। মুম্বাইয়ের বিভিন্ন পেশাদার ক্লাবে বেশ কয়েক বছর খেলা হয়ে গেছে তার – ও নিজেই রোজ সাতসকালে উঠে মুম্বাইতে বস্তির ছেলেদের ফুটবল ট্রেনিং দেয়।
আফসানা আশিক
কাশ্মীরের 'অ্যাংগ্রি জেনারেশনে'র মেয়ে আফসানা কীভাবে স্টোন-পেল্টার থেকে ফুটবল তারকা হয়ে উঠল, তা নিয়ে বলিউডে একটি ছবিও তৈরি হচ্ছে। 'হোপ সোলো' নামে আফসানার সেই বায়োপিকে অভিনয় করছেন বলিউড নায়িকা আথিয়া শেঠি।
আরও পড়ুন : এশিয়ায় চীনা আগ্রাসন বন্ধ করবে যুক্তরাষ্ট্র
ফুটবল যদি আফসানার জীবন বদলে দিয়ে থাকে – তাহলে বলা যেতে পারে পুলওয়ামার একদল কাশ্মীরি তরুণের জীবনের ধারাটাই পাল্টে দিয়েছে করোনা ভাইরাস মহামারি। এই তরুণ যখন বেশ উদ্দেশ্যহীনভাবেই জীবন কাটাচ্ছিলেন, তখন লকডাউনের মধ্যে কাশ্মীরের অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা তাদের ঠেলে দিল ত্রাণের কাজে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা `কাশমাকাশ`
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। পুলওয়ামার ওই তরুণরা মিলে তৈরি করে ফেললেন একটি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'কাশমাকাশ'। কাশ্মীরে বাকি ভারতের যে অসংখ্য অভিবাসী শ্রমিক কাজ করেন, লকডাউনে তারা কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের জন্য রোজ সকাল-সন্ধে রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা শুরু করল তারা। কাশমাকাশ স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে শুরু করে দিল লঙ্গর, সেখানে হাজার হাজার মানুষ পেট ভরাতে পারলেন এই দুর্দিনে।
এখানে কাশ্মীরের ফ্যাশন ডিজাইনার মুফতি সাদিয়ার কথাও না-বললেই নয়। 'হ্যাঙ্গারস – দ্য ক্লোজেট' নামে শ্রীনগরে একটি ডিজাইনার লেবেল তথা বিপণি চালান তিনি। কিন্তু মহামারির শুরুতে যখন দেখলেন আসল সংকট মাস্কের – তখন তিনি তার গোটা টিম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মাস্ক বানাতে।
আরও পড়ুন : নেপালের সমর্থনে ভারতের আরেক অঞ্চল দখলে নিল চীন
কাশ্মীরে শুরুতে মাস্কের দাম ছিল সাংঘাতিক, তিনি দ্রুত বিশ হাজার মাস্ক বানানোর পর দাম নাগালে এল। কাশ্মীরি সেই মাস্ক এখন বাকি ভারতেও নানা জায়গায় যাচ্ছে – আর মাস্কের পাশাপাশি মুফতি সাদিয়া এখন খুব উন্নত মানের পিপিই কিট-ও বানাচ্ছেন।
মুফতি সাদিয়া
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একজন মুফতি সাদিয়া বা একজন মুনির আলমরা আসলে এক নতুন কাশ্মীর গড়ারই স্বপ্ন দেখছেন – যেখানে সন্ত্রাসবাদের ছায়া থাকবে না, সত্তর বছরের অভিশাপ কাটিয়ে ভূস্বর্গ স্বাভাবিকতার নিঃশ্বাস নিতে পারবে।
আরও পড়ুন : ভারত-যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলবে চীনের ভয়ঙ্কর বোমারু বিমান (ভিডিও)
কাশ্মীর যেন আর একটা ফিলিস্তিন না-হয়ে ওঠে, সেটাই যেন অঙ্গীকার এই নবীন প্রজন্মের কাশ্মীরিদের। তাহলে কাশ্মীরে জঙ্গিবাদের এখন কী অবস্থা? সে গল্প তোলা থাক দ্বিতীয় পর্বের জন্য!
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড