আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত মহামারি রূপ ধারণ করেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার পাঁচ শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। তাছাড়া করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও এরই মধ্যে ১ লাখ ছাড়িয়েছে। যাদের মধ্যে ইতালি ও ইরানের নাগরিকদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, অন্যান্য দেশের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে গ্র্যান্ড প্রিন্সেস নামের একটি প্রমোদতরীতে এখন পর্যন্ত ২১ জন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। মহামারি ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে মারা গেছেন ১৭ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র বলছে, দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত ২০০ জন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। তবে কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০০ কিংবা তারও অধিক। এসব কারণে দেশটির নিউ ইয়র্ক সিটিসহ অন্তত আট রাজ্যে এরই মধ্যে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এ দিকে ইতালির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটিতে এখন পর্যন্ত ২৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইতালিতে সবমিলিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৬০০ মানুষ। চীনের পর এখন পর্যন্ত এই দেশেই সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস।
এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে এখন পর্যন্ত দুই হাজারের অধিক লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দেশটিতে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের ঘটনা। শুক্রবার (৬ মার্চ) ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, এখন পর্যন্ত সেখানে ১২৪ জন মারা গেছেন। যদিও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজ বলছে, দেশটিতে এখন পর্যন্ত ২১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
করোনা আতঙ্কে বিশ্বের ১০টিরও অধিক রাষ্ট্রের লাখ লাখ শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি চীনজুড়ে স্কুল বন্ধ রাখায় দেশটির প্রায় দুই কোটি শিশু গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারেই প্রথম প্রাণঘাতী ভাইরাসটি সক্রিয় হয় বলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য টাইম জানিয়েছে, ২০১৫ সালের নভেম্বরে দেশটির নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (চ্যাপেল হিল) সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. রালফ ব্যারিক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। ‘নেচার মেডিসিন’ নামে গবেষণাপত্র তৈরির জন্য তিনি প্রথমে চীনা বাদুড়ের লালা থেকে নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে একধরনের করোনা ভাইরাস সক্রিয় করেছিলেন। পরবর্তীকালে এর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয় ‘এসএইচসি-০১৪’।
গবেষণার কারণ হিসেবে দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফ্রান্সিস কলিন্স বলেছিলেন, অণুজীবের মাধ্যমে জৈব নিরাপত্তা এবং সতর্কতামূলক বিষয়গুলোকে আরও সুদৃঢ় করতেই পরীক্ষাটি করা হলো। মূলত প্রকৌশলবিদ্যা ব্যবহারের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতার বিচিত্র কয়েকটি দিক নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নেচার মেডিসিনের গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পরপরই এ ধরনের গবেষণার মারাত্মক ফলাফল সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন অণুজীব বিশেষজ্ঞ রিচার্ড এড ব্রাইট। ২০১৫ সালের নভেম্বরেই দ্য সায়েন্টিস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এ ধরনের বিপজ্জনক গবেষণার কারণে ভাইরাসটি লোকালয়ে চলে আসতে পারে। তখন এটা মানবজাতি এবং অন্য অনেক প্রাণীকুলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
রিচার্ড এড ব্রাইট আরও বলেন, ভাইরাসটি যখন প্রকৃতিতে অন্য কোনো পোষকদেহে নির্জীব অবস্থায় থাকে, তখন এর সক্রিয় হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তবে এটি গবেষণাগারে সক্রিয় হওয়ার পর একবার যদি তা মানুষকে সংক্রমিত করে, তখন এটি আর নির্জীব থাকে না বরং প্রাণঘাতী ভয়ংকর অস্ত্রের মতোই আঘাত করে।
অপরদিকে উৎপত্তিস্থল চীনের পর বর্তমানে থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, জাপান, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতসহ বেশকিছু দেশে অজ্ঞাত এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। তাছাড়া আতঙ্কে রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানও। আক্রান্তদের সবাই সম্প্রতি চীনে ভ্রমণ করেছেন কিংবা সেখানে বসবাস করেন।
তাছাড়া তালিকাটিতে আরও রয়েছে- কাতার, চেকপ্রজাতন্ত্র, জর্জিয়া, আইসল্যান্ড, রুমানিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাম্বোজ, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, আয়ারল্যান্ড, লিত্ভা, লুক্সেমবার্গ, উত্তর ম্যাসেডোনিয়া, মোনাকো, নেপাল, নিউজিল্যান্ড, নাইজেরিয়া ও শ্রীলঙ্কার নাম।
এমনকি সিঙ্গাপুরেও কয়েকজন বাংলাদেশির করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা সকলেই বর্তমানে দেশটিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানেও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ ভাইরাস মানুষ ও প্রাণীদের ফুসফুসে সংক্রমণ করতে পারে। ভাইরাসজনিত ঠান্ডা বা ফ্লুর মতো হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস। এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার প্রধান লক্ষণগুলো হলো- শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া ইত্যাদি। শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিষ্ক্রিয় হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
আরও পড়ুন : খনিজ দখল নিয়ে এবার যুদ্ধে জড়াচ্ছে আফগানিস্তান!
সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো ভাইরাসটি নতুন হওয়ায় এখনো কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। ভাইরাসটির সংক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা। তাই মানুষের শরীরে এমন উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চীনা বিজ্ঞানীরা।
ওডি/কেএইচআর