দায়িদ হাসান মিলন
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে প্রায় এক দশক হলো। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। বরং বর্তমানে সংকট আরও বেড়েছে। সিরিয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে নিয়মিতই ঘটছে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা, যার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কবে এই পরিস্থিতি ঠিক হবে তা বলা যেন ‘মঙ্গলে যাওয়ার মতোই কঠিন’।
গত কয়েকদিন ধরে সিরিয়া পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ইদলিবকে ঘিরে নিয়মিতই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষ। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। একইসঙ্গে দ্রুত সমাধানের পথ খোঁজারও আহ্বান জানিয়েছে তারা।
সিরিয়া বর্তমানে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে- দেশটিকে ব্যবহার করে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে আরও কয়েকটি বৈশ্বিক শক্তি। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, তুরস্ক, ইসরায়েল ও রাশিয়া। মূলত সিরিয়াকে মাঠ বানিয়ে খেলছে তারা। যার যখন ইচ্ছা হামলা চালাচ্ছে, আবার সুযোগ বুঝে হচ্ছে পাল্টা হামলাও।
এই দেশগুলো সরাসরি একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে না। তারা সিরিয়াকে কেন্দ্রে রেখে দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এটিই হয়ে উঠেছে মূল বিপত্তির কারণ। ইরানি সেনাদের লক্ষ্য করে কয়েকদিন ধরে বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। তবে সেটি ইরানে নয়, সিরিয়ায়। এভাবে সবকয়টি দেশ নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য দামেস্ককে বেছে নিয়েছে, যার ফল ভোগ করছে সেখানকার মানুষ।
সর্বশেষ গত কয়েকদিন ধরে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মেতে উঠেছে তুরস্ক ও রাশিয়া। এর মধ্যে তুরস্ক চাচ্ছে- সিরিয়ার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন হোক। এতে দেশটির বিদ্রোহীরা শান্ত হবে। ফলে তুরস্কে থাকা লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থী দেশে ফিরে যেতে পারবে।
অন্যদিকে রাশিয়া অবস্থান নিয়েছে বাশার আল আসাদের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র যেন তুরস্ককে নিয়ে কোনোভাবেই অঞ্চলটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারে সেজন্য আসাদকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছে রুশ সরকার। এই পক্ষে রয়েছে ইরানও। তবে ইরান যেন কোনোভাবেই সিরিয়ায় শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য সিরিয়ায় ইরানি ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। সবমিলিয়ে অন্য দেশগুলোর ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পিষ্ট হচ্ছে সিরিয়া।
বলা হচ্ছে, সিরিয়ায় গত কয়েকদিন ধরে মুখোমুখি অবস্থানের কারণে তুরস্ক ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ফাটল দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় রাশিয়া কী পারবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে? বিশ্লেষকরা অবশ্য রাশিয়ার পক্ষেই মত দিচ্ছেন। তাদের দাবি, তুরস্ককে রাশিয়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে আঙ্কারার। কারণ, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কিছুটা হলেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে তুরস্কের। এ অবস্থায় রাশিয়াকেও হাতছাড়া করলে সমস্যায় পড়ে যেতে পারে এরদোগান প্রশাসন।
তুরস্ক ও রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আঙ্কারার কাছে সম্প্রতি ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ বিক্রি করেছে মস্কো। ২০১৮ সালে তুরস্ক-রাশিয়ার বাণিজ্য সম্পর্ক ২৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগামী কয়েক বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় তারা।
নিজেদের এমন ‘দুর্দান্ত’ বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিশ্চয়ই নষ্ট করতে চাইবে না রাশিয়া। সেজন্য সিরিয়ায় সর্বোচ্চ কৌশলী অবস্থান নিয়েছে মস্কো। মোটামুটি সব পক্ষের সমর্থন জুগিয়েই চলার চেষ্টা করছে তারা। ফলে কোনো পক্ষই রাশিয়াকে ছাড়তেও পারছে না আবার সরাসরি তাদের সঙ্গে যুক্তও হতে পারছে না। সিরিয়া ও তুরস্ক উভয়েরই রাশিয়াকে খুব প্রয়োজন, কিন্তু দামেস্ক ও আঙ্কারাকে না নিয়েও চলতে পারবে মস্কো। এই নীতিতেই সবকিছু এগোচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরে সিরিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে রুশ সরকার। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের সঙ্গে সিরিয়ার যুদ্ধবিরতির নেতৃত্ব দিয়েছে মস্কো। এরপর ইদলিব ইস্যুতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করেছে ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে আরও একটি চুক্তি করে তারা। এছাড়া সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি নিয়ে ইসরায়েলের মধ্যে যে উদ্বেগ সেটি নিয়েও ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
আরও পড়ুন : ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের হুঁশিয়ারি হিজবুল্লাহর
সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ইরানের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। সেটি নিয়ে ইসরায়েল যখন চূড়ান্ত উদ্বেগে তখন গোলান মালভূমিতে মিলিটারি পুলিশ মোতায়েনের পদক্ষেপ নেয় রাশিয়া। একইসঙ্গে সিরিয়ায় যেন ইরান-ইসরায়েল কোনো সংঘর্ষে না জড়ায় সেজন্য দেশ দুটির মধ্যে অনানুষ্ঠানিক চুক্তির নেতৃত্বও দিয়েছে মস্কো। ওই চুক্তিটা ছিল এরকম- ইরান ও ইরান সমর্থিত যোদ্ধারা সিরিয়া-ইসরায়েল সীমান্ত থেকে দূরে থাকবে, বিনিময়ে ইরানিদের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা বন্ধ করবে ইসরায়েল।
সিরিয়ায় আসাদ সরকার, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও তুরস্ককে সমানভাবে সামাল দিয়ে যাচ্ছে রুশ প্রশাসন। একদিকে তাদের বিমানবাহিনী আসাদ সরকারের জন্য লড়ছে ও সেনাবাহিনী তুরস্কের সঙ্গে কুর্দিবিরোধী অভিযানে নামছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কুর্দিদের স্বার্থরক্ষায়ও কাজ করছে তারা।
এ দিকে তুরস্ক চাচ্ছে ইদলিবকে যে করেই হোক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে। এতে সিরীয় লাখ লাখ শরণার্থীদের বোঝা থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে তারা। এছাড়া নতুন করে আর কোনো শরণার্থী যেন তুরস্কের দিকে না যায় সেজন্য রাশিয়াকে বিমান হামলা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে আঙ্কারা।
নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় গত কয়েকদিন ধরে রাশিয়া সমর্থিত সিরিয়ায় সামরিকবাহিনী ও তুরস্ক সমর্থিত বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। এই সংঘর্ষ কবে শেষ হবে সেটি বলার উপায় নেই। তবে এটুকু বলা যায়- রাশিয়ার সমর্থন ছাড়া সিরিয়ায় জয় নিয়ে ফিরতে পারবে না কেউ।
সূত্র : মিডেল ইস্ট ফোরামের নিবন্ধ অবলম্বনে
ওডি/ডিএইচ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড