মো. সাইফুল ইসলাম
ড. লিয়োং হো নম সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (সার্স) ভাইরাস এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা এ (এইচ১এন১) ভাইরাস সম্পর্কে যার প্রথম দিকেই হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বর্তমানে ছড়ানো নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সম্পর্কে তিনি বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো-
কভিড-১৯ নভেল করোনা ভাইরাস কী?
কভিড-১৯ এর আরেক নাম ২০১৯ নভেল করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (মার্স) এবং সার্স করোনা ভাইরাসের মতোই।
যাইহোক, এই ভাইরাস সার্স ভাইরাস থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। যার অর্থ হলো যদি কেউ পূর্বে সার্স ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে তিনি নভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতেও পারেন। অর্থাৎ পূর্বে সার্স ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে এখন আর তার নভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই তা ঠিক নয়।
নভেল করোনা ভাইরাস একটি সক্রিয় জীবাণু যা খুবই ক্ষতিকর এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এই ভাইরাস প্রথম চীনের উহানে ধরা পড়ে। বর্তমানে বিশ্বের শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এটি। ধারণা করা হয়, মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাস ছড়ানোর পূর্বে বাদুড় থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
উপসর্গ কী?
নভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে সাধারণত নিম্নের উপসর্গগুলো প্রকাশ পায়– • জ্বর • কাশি • গলা ব্যথা • পেশি ব্যথা এবং • জ্বর শুরু হওয়ার ৫-৭ দিন পর শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া।
নভেল করোনা ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়?
নভেল করোনা ভাইরাস বায়ুবাহিত ভাইরাস নয়। এই ভাইরাস নাক, মুখ থেকে নিঃসৃত জলীয় ফোঁটা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়।
জলীয় ফোঁটা– আক্রান্ত ব্যক্তির ফেলা থুথু, কফ, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নির্গত জলীয় ফোঁটার দ্বারা এই ভাইরাস ছড়ায়।
সংস্পর্শ– সংক্রমিত ব্যক্তির নিঃসৃত ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার দ্বারা যে কোনো সুস্থ ব্যক্তি সহজেই আক্রান্ত হতে পারে। হতে পারে নিঃসৃত ভাইরাস দরজার হাতল কিংবা টেবিলের ওপর পড়ে আছে। তবে উভয়ক্ষেত্রেই ভাইরাসকে চোখ, নাক অথবা মুখের সংস্পর্শে যেতে হবে।
এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে কত দ্রুত ছড়াচ্ছে। তবে অস্থায়ীভাবে যে সংস্পর্শ হয় তাতে ভাইরাসটি ছড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, অল্প সময়ের জন্য কাউকে স্পর্শ করা এবং স্পর্শ করার পর হাত ধুয়ে নিলে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কমে যায়।
দীর্ঘ সময় অসুস্থ ব্যক্তির আশপাশে থাকলে এই ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আবার আবদ্ধ কক্ষে দীর্ঘ সময় আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে থাকলেও দ্রুত ছড়াতে পারে।
কীভাবে নভেল করোনা ভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধ করা যায়?
সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া : সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধুতে হবে। যদি সাবান না থাকে শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলেও ভাইরাস মারা যেতে পারে।
হাত না ধুয়ে মুখমণ্ডল স্পর্শ না করা : যেহেতু নাক, চোখ, মুখ দিয়ে ভাইরাস প্রবেশ করছে তাই হাত না ধুয়ে মুখমণ্ডল স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
পৃষ্ঠতল ডিটারজেন্ট ও পানি দিয়ে মুছে ফেলা: কোনো কিছুর পৃষ্ঠতল ভাইরাস দ্বারা দূষণ হলে ডিটারজেন্ট ও পানি দিয়ে মুছে ফেলতে হবে।
মাস্ক ব্যবহার করা : যদি ফ্লুর মতো লক্ষণ প্রকাশ পায় তবে মাস্ক ব্যবহার করলেও ভাইরাস ছড়ানো কমে যাবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া : যদিও সাধারণ সর্দি কয়েকদিন পর নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায় তবুও এই সময়ে অসুস্থ বোধ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
ভিড় এড়িয়ে চলা : ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও জনসমাগম পূর্ণ এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।
করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা আছে কি?
এখন অব্দি করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা নেই। এছাড়াও কোনো টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই রোগের উপসর্গ অনুযায়ী সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া হয়। সাধারণত পুষ্টিকর খাবার ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। সুস্থ হতে ১০-১৪ দিন সময় লাগে।
নমুনা নেয় কীভাবে?
নভেল করোনা ভাইরাসের পরীক্ষার জন্য নাসিকার সোয়াব (নাক মুছে) নমুনা গ্রহণ করে। পরীক্ষার ফলাফল পেতে ৩-৬ ঘণ্টা সময় লাগে। পরীক্ষার জন্য খরচ পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ ডলার।
যদিও উপসর্গহীন লোকও ভাইরাস বহন করতে পারে তবুও উপসর্গহীন লোকদের পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত উপকরণগুলো অসুস্থ ব্যক্তিদের রোগ শনাক্তকরণের জন্যই সংরক্ষণ করা উচিত।
নভেল করোনা ভাইরাস সম্পর্কে লিয়োং আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। যেগুলোও জানা খুবই জরুরি।
কোন ধরনের মাস্ক ব্যবহার করবেন?
যদিও সাধারণ নীল এবং সাদা সার্জিক্যাল মাস্ক ভাইরাস প্রবেশ বন্ধ করতে পারে না, কিন্তু ভাইরাস ছড়ানো কমাতে পারে। তাই এই মাস্কই ব্যবহার করতে হবে।
যদিও এন৯৫ মাস্ক ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে কিন্তু সেটা ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ সেটা ব্যবহারে ঝামেলা রয়েছে। আবার মাস্ক ঠিকমতো মুখে আটকে রাখার জন্য বারবার মুখের কাছে হাত দিতে হয়। এটা এই মাস্কের বড় একটা সমস্যা। তাই সর্ব সাধারণের জন্য এই মাস্ক ব্যবহার না করাই ভালো।
কীভাবে মাস্ক পরতে হবে?
কোনোই সন্দেহ নাই যে নীল প্রান্ত বাইরের দিকে ও সাদা প্রান্ত ভেতরের দিকে পড়তে হবে।
একটা মাস্ক কতক্ষণ ব্যবহার করা যাবে?
এটা নির্ভর করে ঠিক কতক্ষণে আপনার মাস্কের ফিল্টার আর্দ্র হয়ে গেছে। আর্দ্র হলে ফেলে দিতে হবে। যদি আর্দ্র না হয় তবে তা ভালোভাবে মুখ আটকানো ব্যাগে রেখে দিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে। পুনরায় ব্যবহার করার পর এই মাস্ক দিনশেষে ফেলে দিতে হবে। ফেলে দেওয়ার সময় টিস্যু পেপার দ্বারা পেঁচিয়ে ফেলে দিতে হবে।
অসুস্থ বোধ করলে ক্লিনিকে যাওয়া কতটা নিরাপদ?
যদি ক্লিনিকে যেতে হয় তবে অবশ্যই মাস্ক পড়তে হবে। এছড়াও সাবান ও পানি দ্বারা হাত না ধুয়ে মুখ স্পর্শ করা যাবে না।
সাঁতার কাটা কি নিরাপদ?
সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে সমস্যা নেই। সুইমিংপুলের পানি ও ক্লোরিন একত্রে ভাইরাসকে মেরে ফেলতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে সাঁতারে গিয়ে অন্যান্য ব্যক্তির সংস্পর্শ কতটা পাচ্ছেন।
উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞান থাকতেও টিকা কেন আবিষ্কার করা যাচ্ছে না?
যদি বাদুড়ের মল পরীক্ষা করা যায় সেখানে হাজার হাজার করোনা ভাইরাস পাওয়া যাবে। এখন কোন স্ট্রেইন দ্বারা বর্তমানের নভেল করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে তা জানা যাচ্ছে না। যদি সবগুলো করোনা ভাইরাস স্ট্রেইনের বিরুদ্ধেই টিকা তৈরি করা যায়, তখনও ভাইরাস নিজেদের পরিবর্তন ঘটাবে। ফলে নতুন আরেকটি ভাইরাস তৈরি হবে। তাছাড়া এই ভাইরাস কীভাবে নিজেকে পরিবর্তন করে নিচ্ছে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করাও সহজ নয়।
(মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের ওয়েবসাইটের প্রতিবেদন থেকে অনুবাদকৃত)
ওডি/এনএম