মো. সাইফুল ইসলাম
আজকাল গুটিবসন্তের নাম শুনলে আমরা আর ভয় পাই না। কারণ ১৯৭৭ সালে বিশ্ব থেকে এই রোগটি সম্পূর্ণ নির্মূল করা হয়। এটিই হচ্ছে বিশ্বের প্রথম কোনো রোগ যা সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়।
গুটিবসন্ত রোগ নির্মূলের জন্য যিনি প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি হচ্ছেন চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার। জেনার লক্ষ্য করেন অনেক মানুষ গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হলেও একটি মেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে না। অথচ এই রোগ শত শত বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানি করেছিল।
যে মেয়েটি গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না সে আবার বাড়ি বাড়ি গাভীর দুধ বিক্রি করত। জেনার সেই মেয়েটিকে পর্যবেক্ষণে রাখেন। এরপর তার বাড়িতে যান। সেখানে দেখেন গরুতে গোবসন্ত রোগ রয়েছে। যে কারণে গরুর ওলানে বসন্তের ফোসকা পড়েছে। গোবসন্ত রোগটি মানুষে ছড়ায় না।
জেনার তখন গরুর ওলানের ফোসকা থেকে তরল সংগ্রহ করেন। তিনি সেই তরল একটি শিশুর শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করে লাগিয়ে দেন। শিশুটির শরীরের ক্ষতস্থানে একটি ছোট গুটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যায়। জেনার এরপর সেই শিশুর শরীরে গুটিবসন্তের ভাইরাস প্রবেশ করান। কিন্তু সৌভাগ্যবশত শিশুটি আর গুটিবসন্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়নি।
এভাবেই জেনার গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গুটিবসন্তের টিকা ১৯৭০ সালে অনেক উন্নত করা হয়েছিল। যে টিকা পরবর্তীকালে ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ তাদের টিকাদান কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে। এভাবেই গুটিবসন্ত রোগকে নির্মূল করা সম্ভব হয়। জেনারের টিকার মতো পদ্ধতি অবলম্বন করে পরবর্তী সময়ে লুই পাস্তুর আবিষ্কার করেছিলেন জলাতঙ্ক রোগের টিকা। তবে জলাতঙ্ক রোগ নির্মূল হয়নি। রোগ নির্মূল না হলেও বহু লোকের জীবন বেঁচে যাচ্ছে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ গুটিবসন্তের রোগী শনাক্ত হয়েছিল। তিন বছর বয়সী রহিমা নামের এক শিশুর শরীরের এই রোগ ধরা পড়েছিল। পরে ১৯৭৭ সালে সোমালিয়ার মেরকায় এই রোগটি ধরা পড়েছিল। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যের গবেষণাগারে দুর্ঘটনাবশত গুটিবসন্তের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দুইজন শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়। যাদের একজনের মৃত্যু হয়।
যাই হোক, ১৯৮০ সালে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ গুটিবসন্তকে পুরোপুরি নির্মূল ঘোষণা করে। এই ঘোষণার পর মানুষ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে গুটিবসন্ত রোগের ভয়াবহতা থেকে নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু গত বছর নতুন করে আরেক আতঙ্কের সূচনা হয়।
২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম মাংকি পক্স বা বানরবসন্ত ভাইরাস মানুষের শরীরে পাওয়া যায়। এই ভাইরাস অনেকটা নির্মূল হওয়া গুটিবসন্তের ভাইরাসের মতোই। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত রোগীটিকে লন্ডনের রাজকীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসার সময় জানা যায় তিনি নাইজেরিয়ায় ভ্রমণ করেছিলেন। সামরিক বাহিনীর লোক হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তার পরিচয় প্রকাশ করেনি।
যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগ জানায় বানরপক্স সহজে মানুষের মাঝে ছড়ায় না। আবার ছড়ালেও অধিকাংশ রোগীই কয়েক সপ্তাহের মাঝেই সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু এতে আক্রান্ত রোগী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাছাড়াও আফ্রিকার দেশগুলোতে শতকরা ১০ ভাগ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর, মাথা ধরা, পেশীতে ব্যথা, পিঠে ব্যথা ও লিম্ফনোড ফুলে যায়। এছাড়াও রোগীর শরীর ঠান্ডা ও অবসাদগ্রস্ত হয়। গুটিবসন্তের মতো বানরবসন্তেও ফুসকুড়ি ওঠে। এই ফুসকুড়ি মুখসহ সারা শরীরে বিস্তার লাভ করতে পারে। পরবর্তীকালে ফোসকার অংশ খসে পড়ে।
গত বছর যুক্তরাজ্যে সর্বমোট তিনজন রোগীর সন্ধান মেলে। এদের একজন ছিলেন সামরিক বাহিনীর কর্মী। অপরজন নাইজেরিয়ার পর্যটক এবং তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন এদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্যকর্মী। জানা যায়, নাইজেরিয়ায় ২০১৭ সালে বানরপক্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। ধারণা করা হয় সেই ভাইরাসই এখনো বিভিন্ন দিকে ছড়াচ্ছে।
গত বছরের ন্যায় এ বছরও যুক্তরাজ্যে আরেকটি বানরবসন্তের রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এই রোগীও নাইজেরিয়া ভ্রমণ করেছেন। হয়তো ভ্রমণের সময়েই সেখানে বানরপক্স আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে গিয়েছেন। মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বানরপক্স ভাইরাসের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে বলে জানা যায়। ফলে সে সব দেশ ভ্রমণে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
বানরপক্স ভাইরাসটি বানর, আফ্রিকার কাঠবিড়ালি, ইঁদুর ও খরগোশে পাওয়া যায়। এসব প্রাণীর কামড় থেকে অথবা সরাসরি কোনো তরলের সংস্পর্শে আসলে বানরপক্স দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। পূর্বে ধারণা করা হয়েছিল এটি আক্রান্ত মানুষ থেকে অন্য মানুষে ছড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু সেই ধারণা এখন অনেক বদলে গেছে। তাছাড়াও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও আক্রান্তের উপায় নিয়ে তেমন গবেষণা না হওয়ায় সঠিক তথ্যও জানা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে নাইজেরিয়ায় ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’- এর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রাণী চিকিৎসক ও প্রাণিবিদদের সহায়তায় বানরপক্স ভাইরাস ছড়ানোর কৌশল ও যথাযথ উৎস শনাক্তকরণে কাজ করছে। বানরপক্স ভাইরাস যেহেতু বিলুপ্ত হওয়া গুটিবসন্ত ভাইরাসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তাই যথাযথ পদক্ষেপ ও গবেষণার অভাবে নতুন কোনো মহামারীকে হাতছানি দিচ্ছে কি না, ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের।
তথ্যসূত্র : দ্যা গার্ডিয়ান, মেডিসিন নেট, আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা
ওডি/এনএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড