• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

উইম হফ মেথড : বরফ পানিতে শ্বাসই যখন সুস্থতার মূলমন্ত্র!

  নিশীতা মিতু

১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:০৫
উইম হফ
উইম হফ; (ছবি- ইন্টারনেট)

তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির নিচে নামলেই একটু ভারী পোশাক খুঁজি আমরা। আর কোনোক্রমে তা যদি নেমে আসে শূন্যের কাছাকাছি তবে তো কথাই নেই। শীতপ্রধান দেশগুলোতে তাপমাত্রা থাকে শূন্যেরও কমে। আর তাই ভারী পোশাক, ঘরের ভেতর ফায়ার প্লেসই তাদের ভরসা।

তবে উইম হফ ঠান্ডার ধার ধারেন না। ডেনমার্কের এই অ্যাথলেট বোধহয় ভালোবাসেন ঠান্ডাকে। তাই উদোম শরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন বরফের ওপর কিংবা ঠান্ডা পানিতে। মধ্যবয়সী এই ব্যক্তি ভীষণ ফিট। আর তার সুস্বাস্থ্যের পেছনে রয়েছে বিশেষ এক মেথড। যা পুরো বিশ্বে ‘উইম হফ মেথড’ নামে পরিচিত।

কীভাবে এই মেথডের সূচনা করলেন হফ? কী উপাকারই বা মেলে এতে? চলুন তবে ভ্রমণ করা যাক বরফমানব উইম হফের বরফময় জীবনে-

হফের বয়স তখন ১৭। এক ছুটির রবিবার সকালে পার্কে একা হাঁটছিলেন তিনি। মাথায় আসলো ঠান্ডা পানিতে নামলে কেমন লাগে? যেই ভাবা, সেই কাজ। ঠান্ডা পানিতে নেমে পড়লেন তিনি। এক মিনিটও টিকতে পারলেন না। কিন্তু অদ্ভুত এক উত্তেজনা কাজ করল তার মধ্যে। এরপর থেকে দৈনিক নিয়ম করেই কাজটি করা শুরু করলেন হফ।

উইম হফ খেয়াল করলেন, ঠান্ডা পানির সঙ্গে কোথাও যেন তার মনের সম্পর্ক রয়েছে। অনেকদিন ধরে মাথার ভেতর জট বেঁধে থাকা নানা চিন্তা যেন খুলে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। মনে যে হতাশা জমেছিল সেটিও কমে যেতে শুরু করল শীতল পানির স্পর্শে। ঠান্ডা পানিতে ডুবে থাকা অবস্থায় ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তিনি খেয়াল করলেন তার মন যেন স্থির হয়ে পড়েছে।

মনের ভেতরে যত দুশ্চিন্তা, হৈ চৈ ছিল সব যেন দূর হয়ে যাচ্ছিল। একসময় হফ বুঝতে পারেন এভাবে ঠান্ডা পানিতে নিমজ্জিত থাকার প্রভাব তার মন থেকে দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যরকম এক গভীর আত্মশক্তি অনুভব করেন তিনি।

হফ বিষয়টি নিয়ে আরও জানতে চান। ধ্যানজনিত বই, স্থান সবকিছু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও কোনো সমাধান যেন তিনি পেলেন না। বরং অন্যদের তথ্যগুলো তার কাছে নির্জীব মনে হলো। মূলত ঠান্ডা তাকে এতটাই আসক্ত করে ফেলেছিল যে তিনি স্বীকার করে নিলেন, ভোগান্তি হলেও তার সব সমস্যার সমাধান রয়েছে ওই ঠান্ডার গভীরেই।

তিব্বতের সাধুদের একটি ধ্যান বা তপস্যার নাম হলো টাম্মো। বলা হয়, এই ধ্যানের মাধ্যমে এক ধরনের বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করা যায় যার মাধ্যমে নিজের শরীরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। যারা এই পদ্ধতি আত্মস্থ করতে পারেন, তারা তাদের পুরো দেহে তাপ উৎপন্ন করতে সক্ষম হন। এই পথেই হাঁটা শুরু করলেন হফ। অতি প্রাচীন এই ধ্যানে শুরু হয় তার অন্যরকম যাত্রা।

পরবর্তী ২৫ বছর হফ তার এই সাধনা চালিয়ে গেলেন কাউকে কিছু না জানিয়ে। প্রতিদিন তিনি চলে যেতেন অ্যামস্টারডেমের সেই পার্কের শান্ত পুকুরে। গাছের আড়ালে লুকানো এই শান্ত পুকুর তার ধ্যানের জন্য একদমই উপযুক্ত ছিল। সেখানে তিনি নিরবে ও শান্তিতে পানিতে সময় কাটাতে পারতেন। সবকিছু মিলিয়ে ঠান্ডা পানির সেই শান্ত পুকুরই হয়ে উঠল তার ধ্যান ও মানসিক যন্ত্রণা দূর করার স্থান।

ধীরে ধীরে ঠান্ডা পানির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেন হফ। একসময় তিনি ভাবেন বরফের ভেতর সেই ভঙ্গিমায় থাকবেন যেমনটি মানুষ ভ্রূণ অবস্থায় কুঁকড়ে থাকে। শান্ত আর নিরব দেহে পানির কম্পনের ধ্বনি শুনতেন তিনি।

হফের শান্তির জীবনে হঠাৎ করে ভর করে অশান্তি। ১৯৯৫ সালে চার সন্তানের জননী তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। বাচ্চা, পরিবার, দায়িত্ব সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন হফ।

মানসিক যন্ত্রণা কাবু করে দেয় তাকে। সবকিছু মিলিয়ে শূন্যতার মুখোমুখি হন তিনি। খুঁজতে শুরু করেন জীবনের গভীর অর্থ। আর সেই খোঁজেই আবার ফিরে যান বরফ পানির কাছে। কয়েকবছর পর হফ অনুভব করেন, বরফ পানিতে থাকার সময় শ্বাসপ্রশ্বাসে অন্যরকম পরিবর্তন হয়। তিনি খেয়াল করেন কিছুটা সময় ঠান্ডা তাপমাত্রায় থাকার পর নিঃশ্বাস আরও গভীর হয়ে উঠে। অনুশীলন করে দেখেন, বরফে থেকে অনেক গভীরভাবে নিঃশ্বাস নেওয়া সম্ভব হয় যার মাধ্যমে শরীরে শক্তি উৎপাদন করে। এভাবেই সূচনা ঘটে ‘উইম হফ মেথড’ এর।

অতিরিক্ত ঠান্ডার মধ্যে উইম হফ স্বাচ্ছন্দে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে পারেন। কেবল শর্টস পরে উত্তর মেরুতে ম্যারাথন দৌড়ের রেকর্ডসহ আরও ২৩টি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড রয়েছে তার।

উইম হফ মেথডের ফলে কী হয়?

এই মেথডের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হল, নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা। গভীরভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর মাধ্যমে আপনি দেহে অভ্যন্তরীণ শক্তি সৃষ্টিতে সক্ষম হবে। নির্দিষ্ট করে এর উপকারিতা বলতে গেলে বলা যায়-

- স্ট্রেস দূর করা - দৈহিক উদ্যম বাড়ানো - ভালো ঘুম - শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি - সৃজনশীলতা বৃদ্ধি - মনোযোগ বাড়ানো - মানসিক প্রশান্তি

উইম হফ মেথডের মাধ্যমে বাত, কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত সমস্যা, অ্যাজমা থেকে শুরু করে আরও অনেক শারীরিক জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

‘উইম হফ মেথড’ প্রক্রিয়া-

এই মেথড অনুশীলন করতে অবশ্যই একটি শান্ত শীতল স্থান বেছে নিতে হবে। শুরুতে ৩০ বার দ্রুত শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলতে হবে। এ সময় নাকের সাহায্যে শ্বাস গ্রহণ করবেন আর মুখের সাহায্যে তা ত্যাগ করবেন। পরের ধাপে গভীরভাবে শ্বাস নিন এবং যতক্ষণ না শ্বাস ফেলার প্রয়োজন পড়ছে ততক্ষণ শ্বাস ধরে রাখুন। আবার শ্বাস নিন এবং তা ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। এভাবে যতক্ষণ সম্ভব করুন।

মনে রাখবেন উইম হফ মেথডের মূল ভিত্তি হলো তিনটি-

- বরফ পানি - শ্বাস-প্রশ্বাস - অঙ্গীকার

আপনি যখন নিজের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে এই কাজটি করবেন তখনই দেহে অভ্যন্তরীণ শক্তি উৎপাদনে সক্ষম হবে। আর নিজেকে শারীরিক বা মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে এটি সবচেয়ে বেশি জরুরি।

জীবন নিয়ে কি খুব হতাশায় ভুগছেন আপনি? মানসিক যন্ত্রণা আর নানা শারীরিক জটিলতা কি কাবু করে নিচ্ছে আপনাকে? তবে ‘উইম হফ মেথড’ হতে পারে আপনার জন্য উৎকৃষ্ট। আজই তবে সংকল্প গ্রহণ করুন আর শুরু করুন অনুশীলন। হয়তো নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি পাবেন আপনি।

তথ্যসূত্র- উইমহফমেথড ডট কম, ডিস্কোভারম্যাগাজিন ডট কম, থটব্রিক ডট কম, মিডিয়াম ডট কম ইত্যাদি।

ওডি/এনএম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড