• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

কৃত্রিমভাবে ডিম ফোটানো মেশিনের ইতিহাস

  মোঃ সাইফুল ইসলাম

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:২৪
হ্যাচারি
ছবি : সংগৃহীত

যেসব মুরগি খামারে লালন-পালন করা হয় সেগুলোর বাচ্চা সাধারণত তাদের মায়ের দ্বারা ফোটানো হয় না। মায়ের পরিবর্তে কৃত্রিমভাবে তাপের ব্যবস্থা করে ফোটানো হয়। যে যন্ত্রের ভেতর এই পদ্ধতি রয়েছে তাকে বলা হয় ইনকিউবেটর। ইনকিউবেটর মেশিনের আকার ও সক্ষমতা অনুযায়ী শত শত এমনকি হাজার হাজার ডিম একসাথে ফোটানো যায়।

বর্তমানে উন্নতমানের ইনকিউবেটর দিয়ে অনেক বড় বড় হ্যাচারি পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু কৃত্রিমভাবে ডিম ফোটানোর মেশিন বা কৃত্রিম ইনকিউবেটরের ব্যবহার আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন মিশরীয়রা প্রথম করেছিলেন। বলা যায় তারাই ছিলেন ইনকিউবেটরের উদ্ভাবক।

মিশরীয়দের ডিম ফোটানোর পদ্ধতি সেখানে ভ্রমণে যাওয়া বিদেশি পর্যটকদের অবাক করত। যারা পূর্বে সেখানে ভ্রমণ করেননি তাদের অনেকই হতবাক হয়ে যেত মুরগি ছাড়াই বাচ্চা ফোটানোর পদ্ধতি দেখে।

হ্যাচারির ভেতরে কী ধরনের কার্যক্রম হতো তা পর্যটকদের কিংবা বাইরের কাউকে দেখতে দেওয়া হতো না। বর্তমানেও হ্যাচারি ও খামারে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকে। যদি কোথাও কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া না হয়, তবে তা সম্পর্কে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলা স্বাভাবিক। যা থেকে তৈরি হতে পারে গুজব। এর ফলে ভুল তথ্যের বিস্তৃতিও ঘটে। হ্যাঁ, মিশরীয়দের হ্যাচারি ও ইনকিউবেটর সম্পর্কেও অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল।

একজন লেখক বলেছিলেন হ্যাচারিতে থাকা পরিচারকরা ডিমের ওপর বসে তাপ দেয়। ফ্রায়ার সিমন ফিটজসিমন নামক একজন লেখক চৌদ্দ শতকে মিশর ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি কৃত্রিমভাবে ডিম ফোটানোকে অবিশ্বাস্য বলেছিলেন। তিনি বলতেন, আগুনের মাধ্যমে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলতেন, ডিমগুলোকে হ্যাচারির ভেতর রাখার পূর্বে মুরগি দিয়ে তাপের ব্যবস্থা করা হয়। মিশরীয়দের হ্যাচারি ও ইনকিউবেটর নিয়ে অ্যারিস্টোটলও কথা বলেছিলেন। তার মতে, ডিমগুলোকে গোবর গাদায় পুঁতে রাখা হয়। এটা বলার কারণও ছিল। কারণ হ্যাচারিগুলোতে গোবর নিয়ে যাওয়া হতো। তবে গোবর কি কাজে ব্যবহার করা হতো তা একটু পরেই বুঝতে পারবেন।

ফ্রান্সের প্রকৃতিবিজ্ঞানী রেন এন্টোন ফারচাল্ড ডি রিউমার প্রথম যথাযথ বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি ১৭৫০ সালে মিশর ভ্রমণ করেন। সেখানে অসংখ্য হ্যাচারি ঘুরে ঘুরে ইনকিউবেটর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।

রিউমারের তথ্যানুসারে জানা যায়, হ্যাচারি ৯ ফুট উঁচু ইটের তৈরি। ভেতরে দীর্ঘ একটি গলির উভয় পাশে দুই স্তরে সাজানো হয় কক্ষ থাকে। গলির একমুখ দিয়ে পরিচারক হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। সাধারণত নিচতলায় শন বা খড়ের তৈরি বিছানায় ডিম রাখা হতো।

ওপরের কক্ষে খড়ের সাথে গরু ও উটের গোবর মিশিয়ে আগুন জ্বালানো হতো। এই পদ্ধতির ফলে আগুন ধীরে ধীরে ও দীর্ঘক্ষণ জ্বলত। দিনে দুইবার আগুন জ্বালানো হতো। আগুন কতবার জ্বালানো হবে তা সেখানকার আবহাওয়া ওপর নির্ভর করত।

পরিচারকরা ডিমগুলো ওলট-পালটও করে দিত যাতে সবদিকে সমানভাবে গরম হয়। ১৪ দিন পর আগুন নিভিয়ে দেয়া হতো। সেই সময়ে ভ্রূণ যথেষ্ট পরিমাণে বড় হয়ে যেত। এরপর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ তাপের ফলে ২১ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতো।

রিউমার ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে মিশরীয়দের পদ্ধতি অনুসারে হ্যাচারি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ইউরোপের জলবায়ুর শীতলতার কারণে মিশরীয়দের মতো সফলতা পাননি। তার মৃত্যুর পর তারই নকশা অনুযায়ী আব্বে জিনঅ্যান্টয়েন নোলেট ও আব্বে কোপিনিউ ইনকিউবেটরে অ্যালকোহল বাতি ব্যবহার করেছিলেন। এই ইনকিউবেটর উনিশ শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক ইনকিউবেটর চালু হওয়ার পর পুরনো পদ্ধতিটি বিলুপ্ত হতে থাকে।

ফ্রান্সে পুরনো ইনকিউবটর ব্যবহৃত না হলেও এখনও মিশরে পুরনো পদ্ধতির ইনকিউবেটরে হ্যাচারি পরিচালিত হচ্ছে। তবে গোবরের পরিবর্তে পেট্রোল বাতি ও বৈদ্যুতিক হিটারে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখনও আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন– থার্মোমিটার, তাপ নিরোধক ইত্যাদি ব্যবহার করে না। একজন দক্ষ কর্মী ডিমকে চোখের পাতার কাছে ধরে তাপ পরিমাপ করেন। ডিম অতিরিক্ত গরম হলে তার ওপর পানি স্প্রে করেন। মিশরীয়রা সকল পদ্ধতি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথেই করতেন। এই তথ্যগুলো বাইরে প্রকাশ হতে দিতেন না।

হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরনো পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর ব্যবস্থা হয়তো মিশর থেকে দ্রুতই হারিয়ে যাবে। ২০০৯ সালে ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায়, সেখানকার প্রায় সকল হ্যাচারি মালিকই আধুনিক হ্যাচারি গড়তে চান। কারণ আধুনিক হ্যাচারিতে ডিম ফোটার হার পুরনো পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি।

কালের বিবর্তনে পুরনো পদ্ধতি হারিয়ে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি হবে। মানুষ হয়তো কম শ্রমে অধিক উৎপাদন করবে। কিন্তু হাজার বছর আগে মিশরীয়দের শেখানো সেই হ্যাচারি ও ইনকিউবেটরের ইতিহাস পাঠককে বিস্মিত করবেই।

তথ্যসূত্র- অ্যামিউজিং প্লানেট, ইফাউল, টিচিং উথচ থিম ডট কম।

ওডি/এনএম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড