সৈয়দ মিজান
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঠিক উল্টোপাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ডি আই টি সুপার মার্কেট। বেশ কয়েকবছর আগেও এই মার্কেটটিতে গমগম করতে দেখা যেত মানুষ। এখন কেমন নির্জীব আর নীরব হয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেটটি। এখানে একসময় পাওয়া যেত হ্যান্ডিক্র্যাফটস এবং অ্যান্টিকের জিনিসপত্র। বিশেষ করে পুরনো দিনের এমন সব জিনিস মিলত এখানে যা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করত। তবে এই মার্কেটে অনেকগুলো এমন দোকান থাকলেও ধীরে ধীরে সব দোকানই উঠে গেছে।
মার্কেটের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল আগের আলো ঝলমলে রূপ আর নেই। কেমন নির্জীব একটা পরিবেশ। একটা দুটো দোকান খোলা পাওয়া গেল। বেশিরভাগই গয়নার দোকান। হ্যান্ডিক্র্যাফটস এবং অ্যান্টিকের অনেক দোকানের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু দোকান বন্ধ। একটা সাইনবোর্ডের নিচে দেখা গেল স্বনামধন্য এক ব্যাংকের এটিএম বুথ। তার পাশেই একটা দোকানই খোলা দেখা গেল। ক্র্যাফটস কর্নার।
মার্কেট ঘুরে একটাই দোকান চোখে পড়েছিল (ছবি : দৈনিক অধিকার)
দোকানের সামনে পুরনো একটি গ্রামোফোন যন্ত্র সাজিয়ে রাখা। তার আশেপাশে আরও কয়েকটি কাঁসার পুরনো নিত্য ব্যবহার্য পাত্র দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। দোকানের ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো আস্ত একটি জাদুঘরে ঢুকে পড়েছি যেন। কী নেই দোকানে! রাজ্যের সব পুরনো জিনিসপত্রে ঠাঁসা কয়েক বর্গফুটের এই জায়গাটি। দোকানের মধ্যে একজন মানুষই বসে আছেন। কিছু একটা পরিষ্কার করছেন কাপড় ঘষে ঘষে।
নাম জানালেন এম ইসলাম। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশ ঘোরা হয়ে গেছে তার। এই কাজের সাথে যুক্ত আছেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে। গল্প শুরু হলো তার সাথে। জানালেন এই মার্কেট শুরু হবার শুরু থেকেই এখানে আছেন তিনি। জানতে চাইলাম এত এত দোকান ছিল আগে কোথায় গেল সব?
হ্যান্ডিক্র্যাফটস এবং অ্যান্টিকের দোকান উঠে সেখানে বসেছে এটিএম বুথ (ছবি : দৈনিক অধিকার)
অকপটে জানালেন, 'আগের বেচাবিক্রি এখন আর নেই। পুরনো জিনিস সংগ্রহ করার লোক কমে গেছে। তাই দোকান উঠিয়ে দিচ্ছে সবাই। ব্যবসা পাল্টে ফেলছে অনেকেই।' আবারও জানতে চাইলাম, 'আপনি ছাড়ছেন না কেন এখনও?' খানিকটা হাসির রেখা দেখা গেল তার ঠোঁটে। বললেন, 'আমি ছাড়ব না। এটা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। এই ব্যবসাটা নেশার মতো হয়ে গেছে। পুরনো জিনিস সংগ্রহ করাটা সোজা কথা না। আমি অনেক কিছু সংগ্রহ করি আবার তা বিক্রিও করি এটা বলতে পারেন রক্তে মিশে গেছে।'
বাইরে দেখা গেল বিকালের আলো মরে এসেছে। দোকানের চারপাশে চোখ বুলাতেই গিয়েই চোখ আটকে গেল পুরনো একটা জ্যাকেটে। উৎসুক চোখ দেখে তিনি জানালেন, 'এটা আমারই জ্যাকেট। বিক্রির জন্য না। শীতের সময় পড়ি। ২৪-২৫ বছর বয়স হবে এটার। দোকানেই রেখে দিয়েছি। অনেকেই কিনতে চায় এটা। বেশ কয়দিন আগেই এক স্প্যানিশ ১০০ ডলার সেধেছিল এটার জন্য।'
কত দেশের মুদ্রা যে আছে তার সংগ্রহে (ছবি : দৈনিক অধিকার)
কথায় কথায় জানা গেল তার দোকানে অনেক ভিনদেশি ক্রেতাও আসেন নিয়মিতই। একটা সময় যখন এই মার্কেট খুব জমজমাট ছিল তখন অ্যান্টিকের দোকানগুলোতে দেখা যেত মানুষের ভিড়। 'আমরা সারাদিনে যা বিক্রি করতাম তা এখন দশ দিনেও বিক্রি হয় না।' আক্ষেপ নিয়েই বললেন কথাগুলো।
মাটির অনেক পুরান রেকর্ড আছে তার সংগ্রহে। বাসন কোসন, বিভিন্ন দেশের পুরনো মুদ্রা, খাম-ডাকটিকিট এবং পুরনো গয়নার বিশাল সংগ্রহ আছে বার্ধক্য ছুঁইছুঁই এই মানুষটির কাছে। তিনি একে একে সংগ্রহে থাকা ভাণ্ডার থেকে কিছু কিছু বের করে দেখালেন। কয়েকশো বছরের পুরনো পায়ের মল থেকে শুরু করে বাঘের দাঁত-নখ পর্যন্ত দেখালেন তিনি।
পুরনো গ্রামোফোন 'হিজ মাস্টার ভয়েস' (ছবি : দৈনিক অধিকার)
একটা একটা দিন যাচ্ছে আর তার সংগ্রহে থাকা জিনিসপত্র কমছে। তবে অনেকগুলো দোকান একসাথে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশকিছু জিনিস একবারে সংগ্রহ করতে পেরেছেন তাদের থেকে। জানালেন, 'এমন অনেক পুরনো জিনিস আমার সংগ্রহে আছে যা অন্য কারও কাছে দিতে ইচ্ছে করে না। নিজের কাছেই জমিয়ে রেখেছি। তবে হয়তো কোনোদিন তা বিক্রিও করে দিতে পারি।'
আমরা যখন তার দোকান ছেড়ে বের হয়ে আসছিলাম টের পেলাম ইতিহাসের পাতা থেকে একটু বাসবে ঢুঁ মেরে আসলাম যেন।
ওডি/এসএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড