তাবাসসুম তামিমা
ফণিমনসা। সাপের ফণার মতো দেখতে এই গাছটি সারা বিশ্বেই দেখতে পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে ‘মনসা’ গাছের নিচে দেবী মনসার পূজো দেয়া হয়। গাছগুলো বেশ লম্বা, প্রায় তেতলার সমান উঁচু হয়। পাতা ছিঁড়লে টপ টপ করে সাদা দুধের মতো কস ঝরতে থাকে। পাতাগুলো দেখতে ফণাসদৃশ, কাণ্ডে ও সারা গাছের ডালে ঘন কাঁটা দেখা যায়। মনসা গাছের আঠা থেকে প্রস্তুত তেল উৎকৃষ্ট ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে এ গাছের কবিরাজি সমাদর আছে।
ফণিমনসাকে লাতিন উচ্চারণে ওপানশিয়া বলা হয়। ওপানশিয়ার প্রায় ২০০ প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে ‘ফাইকাস-ইন্ডিকা’ নামের একটি প্রজাতি জগৎ বিখ্যাত। এই প্রজাতিটিতে কোনো কাঁটা হয় না। প্রায় ৩ মিটার উঁচু হয় গাছ। এর লাল ফল রসালো এবং মিষ্টি। মানুষ ও কিছু পশু-পাখির খাদ্য। যা থেকে জ্যাম-জেলি ও পানীয় তৈরি হয়। এটির সরস কাণ্ড একটি উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য। মেক্সিকো এলাকার মানুষ নানারকম খাবার তৈরি করে এই কাণ্ড থেকে।
অনেকে সখ করে টবে চাষ করেন এই গাছ। (ছবি : সংগৃহীত)
গাছগুলো জমির বেড়া দেয়ার জন্য খুব উপযোগী। ফণিমনসার নিরেট বেড়া জমিতে ধুলোবালি ঢুকতে দেয় না এবং ভূমিক্ষয় রোধ করার জন্য এদের ব্যবহার বেশ ফলপ্রদ। প্যালেস্টাইনের গাজা অঞ্চলে, জর্দানে এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু দেশে ফণিমনসা গাছ দিয়ে সীমানার বেড়া দেয়া হয়। এই গাছগুলো বছর তিনেকের মধ্যে এমন ঘন ‘হেজ’ তৈরি করে যে এর ভিতর দিয়ে উট তো দূরের কথা, খরগোশও ঢুকতে পারে না। বাতাসে উন্মুক্ত মরুর বালুকণা উড়ে আসতে পারে না, ফলে বেষ্টিত এলাকায় কিছু শস্যের চাষাবাদও হতে পারে।
লাল ও মেরুন রঙের ফলগুলো মিষ্টি বেশি হয়। তবে স্বাদে ও গন্ধে সবকটাই দারুণ। মিষ্টি ফলগুলো দিয়ে সুস্বাদু জ্যাম-জেলি তৈরি করা যায়। ফলের গায়ে গ্লোকিড নামক এক ধরনের সূক্ষ্ম রোম থাকে যেগুলো স্পর্শমাত্র মাথা ভেঙে রয়ে যায় চামড়ার ভিতরে। রোমের মাথাগুলো তীরের ফলার মতো। ঢুকলে সহজে বের হতে চায় না। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিব্রতকর চুলকানি। খালি হাতে এই ফল ধরা কখনও নিরাপদ নয়। গাছ থেকে পাড়ার সময় চিমটা বা গ্লাভস্ ব্যবহার করতেই হয়। এরপরও কখন কীভাবে হুল ফুটে যায় তা টের পাওয়া দায়।
অনেক পাখির প্রিয় খাদ্য ফণিমনসার ফল। (ছবি : সংগৃহীত)
এই ফলকে আরবিতে সবর বলা হয়। কারণ এটা প্রস্তুত করতে সবুর বা ধৈর্য্য লাগে। স্পেনে এর নাম ‘টুনা’ যার পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। ফণিমনসার পত্রসদৃশ চ্যাপ্টা কাণ্ডও খাওয়া যায় মাছ মাংস সালাদে নানাভাবে কাঁচা বা সেদ্ধ করে। একে গ্লোকিডমুক্ত করার জন্য অনেকে রান্নার আগে হাঁস পোড়ানোর মতো করে আগুনে ঝলসে নেয়।
আমরা ফণিমনসাকে সাপের ফনার সঙ্গে তুলনা করলেও বিদেশে একে তুলনা করা হয় নৌকার বৈঠা বা প্যাডেলের সাথে। যে কারণে এর এক নাম ‘প্যাডল ক্যাক্টাস’। তবে ‘প্রিকলি পিয়ার’ নামেই এর পরিচিতি বেশি। প্যাডেলের সঙ্গে কিছু বড় আকারের স্পাইন আর ছোট ছোট গ্লোকিড থাকে। খাওয়ার জন্য সেগুলো সরিয়ে ছক্কা করে কেটে নিয়ে তাপ দিতে হয় জলে বা তেলে। তারপর সেদ্ধ হলে যে কোনো কিছুর সঙ্গে মেশানো যায়। যেহেতু এর নিজস্ব স্বাদ খুব হালকা তাই যেটির সাথে মেশানো হয় সেটির স্বাদেই মিশে যায়। কাণ্ডজাত এই খাবার মেক্সিকো ও টেক্সাসেই পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি।
ফণিমনসার প্যাডকে বায়োমাস হিসেবে ব্যবহার করে তা থেকে মিথেন গ্যাস, ইথানল ও বায়োডিজেল তৈরি হতে পারে। বায়োমাস ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে কেনিয়া ও ভারত। এ দুটি দেশ যথাক্রমে সমুদয় উৎপাদিত শক্তির ৭৫% ও ৫০% ব্যবহার করে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই গাছের বেশ কিছু ঔষধি গুণ উন্মুক্ত হয়েছে যা,ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মদ্যপানের কারণে হ্যাংওভার, ডায়েরিয়া, প্রস্টেট রোগ, ভাইরাস ইত্যাদি রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব ছাড়া এই গাছের একটি বিশেষ ব্যবহার রয়েছে ঘন লাল কারমাইন রং তৈরিতে যার প্রচলন সারা বিশ্ব জুড়ে। ৩০০ বছর আগে ভারতবর্ষেও এই রং ব্যবহার করা হয়েছে। এই রঙের উৎস একপ্রকার ‘স্কেল ইনসেক্ট’ বা আঁশপোকা যার সাধারণ নাম ‘কোচিনীল’।
প্রজাতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় ফণিমনসা ফুলের রং। (ছবি : সংগৃহীত)
একে প্রথম ব্যবহার করে মেক্সিকোবাসীরা। খুব সহজে কোচিনীলের চাষ করা যায়, ১৮ রকম ফণিমনসার মাংসল কাণ্ডে, যার মধ্যে 'ফাইকাস-ইন্ডিকা’ অন্যতম। পোকাগুলো দেখতে সাদা, মনে হয় এদের গায়ে পাউডার ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। মূলত এরা অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকে রক্ষা পেতে এবং আর্দ্রতা বজায় রাখতে দেহের চারদিকে এই মোড়ক তৈরি করে রাখে। তবে দেখতে সাদা হলেও ভিতরে প্রচণ্ড লাল। আধা সেন্টিমিটার মাপের এই পোকার শরীর অত্যন্ত নরম। আঙুলের ডগায় নিয়ে একটু টিপলেই ফেটে যায়। দেখে মনে হবে আঙুল কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
প্রাকৃতিক নল দিয়ে তৈরি সিলিণ্ডার আকৃতির বাসায় এসব পোকা রেখে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ফণিমনসার কাণ্ডে। কাণ্ডের রস খেয়ে স্ত্রী পোকারা মাস তিনেকের মধ্যে পুষ্ট হলে ব্রাশ করে এদের সংগ্রহ করা হয় রং তৈরির জন্য। এদের দেহ থেকে কারমাইনিক এসিড সংগ্রহ করা হয়। এর সাথে অ্যালুমিনিয়াম ও ক্যালসিয়াম সল্ট মিশিয়ে তৈরি করা হয় কারমাইন রং। যা লাল থেকে মেরুন হতে পারে। এসব রং লিপস্টিক, ফেসপাউডার, ব্লাশ ইত্যাদি প্রসাধনসামগ্রীতে ব্যবহার হয়।
বিখ্যাত ফাস্টফুড চেইন কোম্পানি ‘স্টারবাকস্’ ‘ফ্রাপুচিনো’ তৈরিতে এই রং ব্যবহার করে থাকে। বাজারে কৃত্রিম রং ‘এলিজারিন ক্রিমজন’ আসার পর প্রাকৃতিক রঙের বাজার বেশ মন্দা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কৃত্রিম রঙের ব্যবহারের কারণে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। ক্যানসারের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য মানুষ আবার প্রাকৃতিক রঙে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কর্তৃক অনুমোদিত ‘সিন্থেটিক কোচিনীল’-এর সিম্বল ই-১২অ এবং এ-১২৪ যা পাত্রের লেবেলে উল্লেখ থাকে।
ব্রিটিশরা নানা কাজে এই লাল রং ব্যবহার করত, বিশেষত সৈনিকদের লাল কোট নির্মাণ করার জন্য। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়াতে ‘ওপানশিয়া’র কিছু প্রজাতি বিশেষত ‘স্ট্রিক্টা’ প্রজাতির চাষ করা হতো কৃষিক্ষেত্রে, বাগানের হেজ নির্মাণে এবং রং তৈরিতে। কিন্তু পরিবেশ অনুকূল না হওয়াতে পোকারা বেঁচে থাকতে পারেনি। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় ফণিমণসা দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। এর ফল খেয়ে পাখিরা বহুদূরে এর বীজ বিচরণ করে। খুলে পড়া কাণ্ড এমনকি অপুষ্ট ফল মাটিতে পড়েও শিকড় গজাতে থাকে। বৃষ্টির জলেও কিছু বিসরণ হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় এক লক্ষ বর্গমাইল এলাকা মানুষের ব্যবহার থেকে বেদখল হয়ে যায়। বহুকাল ধরে ফণিমনসার বৃদ্ধিকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি মানুষের পক্ষে। অবশেষে ১৯২০ সালে ব্রাজিলের এক বিশেষ ধরনের মথ ব্যবহার করে এর বিস্তারকে জৈবনিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে শূককীটের মাধ্যমে।
ঘন লাল কারমাইন রং তৈরি করে কোচিনীল। (ছবি : সংগৃহীত)
এটা একপ্রকার হাইব্রিড গাছ। এই হাইব্রিড কোথা থেকে কবে তৈরি হয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে পৃথিবীতে তা নিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও ট্যাক্সোনমিস্টদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে এর আদি নিবাস সেন্ট্রাল মেক্সিকো। এই অঞ্চলের প্রাচীন অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতার অধিবাসীদের মধ্যে যে ‘নির্বাচিত প্রজনন’ বিষয়ে জ্ঞান ছিল তা অনুমান করা অযৌক্তিক নয়। ইরাকের দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা মেসোপটেমিয়াতে খেজুর গাছের নির্বাচিত প্রজনন হয়েছে। নির্বাচিত পুরুষ গাছের ফুলের ঝাড় কেটে সেগুলো পরাগায়নের জন্য স্ত্রী-ফুলে ঘষে দেয়া হয়েছে, উন্নত মানের খেজুর ফলানোর জন্য। উৎকৃষ্ট খেজুরের ফলন ত্বরান্বিত করতে এমন কায়িক-পরাগায়ন এখনও চালু আছে আরব দেশগুলোতে। মরুভূমিতে এমন নির্বাচিত পরাগায়ন করার সুবিধা বেশি, কারণ সেখানে পরাগায়নকারী কীটপতঙ্গের প্রচণ্ড অভাব থাকে। মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো অঞ্চল থেকে উপরে উত্তর আমেরিকা এবং নিচে দক্ষিণ আমেরিকাতে ‘ফাইকাস-ইন্ডিকা’ ফণিমনসা গাছ বিস্তার লাভ করে এবং প্রাচীন ‘ইনকা সভ্যতা’র কেন্দ্রস্থল পেরুতেও। পরবর্তীতে ইউরোপীয় পরিব্রাজক ও মিশনারীগণ একে বিস্তার করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
ভারতে ফণিমনসা নিয়ে বিগত ৮০র দশক থেকে গবেষণা শুরু হয়েছে। রাজস্থান, আগ্রা, ঝাঁসির বেশকিছু রিসার্চ ইনস্টিটিউটে বিদেশি ও স্বদেশি ফণিমনসার চাষ করে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। যে জমিতে অন্য ফসল হয় না সেসব এলাকায় ফণিমনসা জন্মাতে পারলে এর ফল ও কাণ্ড থেকে উপার্জিত হতে পারে প্রচুর অর্থ। যা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ফণিমণসার স্বল্প উচ্চতার যে প্রজাতি দেখা যায়, বিশেষত পার্বত্য অঞ্চলে, সেটি ‘ওপানশিয়া ডিলেনিয়াই’। গারো, খাসিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে এই গাছ ফণীনাগ, রাজমণি ইত্যাদি নামে পরিচিত। কিছু রোগের জন্য দেশের বিভিন্ন শহরের বাগানেও এই গাছ দেখা যায় যা অন্তত ফণিমনসার পরিচয়টুকু বহন করে। এখন সময় এসেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর যেখানে কিছুই জন্মাতে চায় না সেখানে বিদেশ থেকে বাছাই করা ফণিমনসার জাত এনে কৃষির কিছু অগ্রগতি ঘটানো।
ওডি/এসএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড