• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

স্বাস্থ্যসেবায় সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে নারী মৈত্রীর ‘ইয়ুথ’

  নিশীতা মিতু

০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১১
ইয়ুথ
আলোচনা সভায় 'সামাজিক নিরীক্ষা দল' এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ

একটি অলাভজনক সামাজিক সংগঠন ‘নারী মৈত্রী’। ১৯৮৩ সালে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশকিছু জেলায় কাজ করেছে নারী মৈত্রী। এর মধ্যে ঢাকার প্রায় সবগুলো ওয়ার্ডেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহায়তায় নারী মৈত্রী ২০১২ সাল থেকে স্থানীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কাজ করছে। নারী মৈত্রীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী অংশ হচ্ছে ইয়ুথ বা যুবসম্প্রদায়। তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার দায়িত্ব পালন করে সংগঠনটি। তবে কোনো ইয়ুথকে সরাসরি অর্থ দেওয়া হয় না। বরং বছরের পর বছর তাকে যোগ্য নাগরিক করে তুলতে সেই অর্থ ব্যয় করা হয়। তাদের নানারকম প্রশিক্ষণ প্রদানের মধ্যে করা হয় স্বাবলম্বী। সেসঙ্গে এই সুবিধাবঞ্চিত যুবসম্প্রদায় যেন নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হয় তাও নিশ্চিত করার কাজ করছে নারী মৈত্রী।

অ্যাকশনএইড এর সহায়তায় বর্তমানে প্রায় ২০০ জন ইয়ুথের একটি দল নিয়ে কাজ করছে নারী মৈত্রী। এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আজকের যুব প্রজন্ম’। দলে রয়েছে ৬০ শতাংশ নারী সদস্য এবং ৪০ শতাংশ পুরুষ সদস্য। ২০১৯ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে রেজিস্ট্রেশন পেয়েছেন দলটি যা একটি বড় সফলতা।

‘আজকের যুব প্রজন্ম’ দল নিয়ে বলতে গেলে যেতে হবে ২০১৮ সালে। সে বছরের শেষ দিকে এই ইয়ুথ টিম ‘সোশ্যাল অডিট গ্রুপ’ বা ‘সামাজিক নিরীক্ষা দল’ গঠন করে। তিন বছর ধরে যারা অসাধারণ কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের কমিউনিটিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। এই সামাজিক নিরীক্ষা দলের চারজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক অধিকারের। আলোচনায় তারা জানান দল ও দলের কার্যক্রম সম্পর্কে।

যেভাবে গঠিত হয় দল- ইয়ুথরা সামাজিক নিরীক্ষা দল গঠন করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট। এরপর এই গ্রুপকে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষনের মাধ্যমে ইয়ুথরা জানতে পারে কিভাবে সামাজিক নিরীক্ষা করতে হয়। তারা তাদের নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে একটি পরিকল্পনা করে।

দলটি যেভাবে কাজ করে- চিহ্নিত সমস্যা সমাধানে দায়িত্বগুলো দলের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। শুরুতেই কমিউনিটির মধ্যে সমস্যা নিয়ে ব্যক্তিপর্যায়ে একটি জনমত জরিপ বা সার্ভে করা হয়। এরপর কমিউনিটির বেশ কজনকে নিয়ে একই সমস্যা নিয়ে আরেকটু বিশদভাবে আলোচনা করা হয়। সকলের মতামতের ওপর নির্ভর করে সামাজিক নিরীক্ষা টিম একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সমস্যা সমাধানের জন্য কোন অধিদফতরে যেতে হবে এবং এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তা রিপোর্টে লিপিবদ্ধ করা হয়।

এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচ্য সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসেন এই দলটি। পরের ধাপে এলাকায় আয়োজন করা হয় গণশুনানি বা উন্মুক্ত আলোচনা সভার যেখানে এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আমন্ত্রিত থাকেন। অর্থাৎ অধিদফতর বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের একটি কথোপকথনের সুযোগ করে দেন সামাজিক নিরীক্ষা দল। যার মাধ্যমে এই কমিউনিটির ব্যক্তিরা খুব সহজেই নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারছেন, কী সমাধান চাই জানাতে পারছেন। এই আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি সম্ভাব্য সমাধান বলে যান কিংবা আশ্বাস দিয়ে যান।

যা কিছু অর্জন- তিন বছরে সামাজিক নিরীক্ষা দল বেশকিছু পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এসব অর্জনের মধ্যে দুটি অর্জনকে বেশি বড় করে দেখেন দলটি। একটি হলো- মিটফোর্ড হাসপাতালে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা লাইন নিশ্চিতে সক্ষম হওয়া। এই হাসপাতালটিতে আলাদা লাইনের কথা থাকলেও নারীদের লাইনে পুরুষের উপস্থিতি দেখা যেত। অর্থাৎ নিয়ম মানা হচ্ছিল না। সামাজিক নিরীক্ষা দল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে এটি নিশ্চিত করে। বর্তমানে এর সুফল ভোগ করছে কয়েক লাখ মানুষ।

আরেকটি অর্জন হলো ন্যাশনাল হাসপাতালের ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারকে নারী ও শিশুদের জন্য উপযোগী করে তোলা। এখানে নামমাত্র ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার থাকলে তা সচল ছিল না, পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর, আশেপাশেই ছিল পুরুষের হরহামেশা যাতায়াত। বর্তমানে হাসপাতালটির এই ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটেছে। ফলে একজন মা নিশ্চিন্তে ও স্বাচ্ছন্দ্যে শিশুকে দুগ্ধ দানে সক্ষম হচ্ছেন। সেই সঙ্গে এই হাসপাতালে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছে এই সামাজিক নিরীক্ষা দল। এর ফলে প্রতিদিন প্রায় দুই শতাধিক মা এখানে ব্রেস্ট ফিডিং করানো সুযোগ পাচ্ছেন।

আলোচনা সভায় 'সামাজিক নিরীক্ষা দল'

নিয়মিত চলছে দেখভাল- কাজ করেই যে শেষ তা নয়, নিয়মিত তার তদারকি করে যাচ্ছে সামাজিক নিরীক্ষা দল। দলটির সদস্যরা বলেন, ‘আমরা কাজগুলোর শুরু করেছি ২০১৮ সালের শেষের দিকে। ২০১৯ এর শুরুতে আমরা সমস্যার সমাধানে সক্ষম হয়েছি। ২০২১ এসে তা এখনো চলমান আছে কি না, সে বিষয়েও নিয়মিত খেয়াল রাখছি আমরা। সম্প্রতি আমরা আবারও এই দুই হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিই। সেখানে গিয়ে দেখি নারী পুরুষের আলাদা লাইন রয়েছে এবং স্বাস্থ্যসম্মত ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার রয়েছে।

রয়েছে কিছু ঘাটতিও- কাজ করতে গিয়ে যে প্রতিবারই যে সফল হয়েছেন এই সামাজিক নিরীক্ষা দল তা কিন্তু নয়। বরং পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তারা। বিশেষ করে শুরুর দিকে পথ চলাটা বেশ কঠিন ছিল। অনেক প্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সভা উপস্থিত থাকার কথা বলেও থাকেননি, আলোচনায় অংশ নেননি। অনেকগুলো দাবি থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বল্প পরিমাণ পূরণ হয়েছে। কিছু সমস্যার সমাধান হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে আবারও সে সমস্যা দেখা দিয়েছে- এমনও ঘটেছে বহুবার।

কাজের ক্ষেত্রে থাকে চ্যালেঞ্জ- দলটির সদস্যদের মতে, কাজের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জই রয়েছে তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন স্টেক হোল্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না কিংবা সমস্যার কথাই শুনতে চান না। প্রথমদিকে, জরিপের কাজে নিজেদের কমিউনিটিতেও বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। তবে এখন আর তা পড়তে হয় না।

দলের সদস্য সাগর বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনায় বসা। রিপোর্ট নিয়ে প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে গেলেও শুনতে হয়েছে দেখা করা যাবে না, ওমুক জায়গার অনুমতি লাগবে, সময় নাই ইত্যাদি কথা।

দলের আরেক সদস্য রানা বলেন, এমনও হয়েছে আমরা অনুমতি নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার পর আমাদেরকে কাজ করতে বা ছবি তুলতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমাদের হাত থেকে ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকবার অপমানের শিকার হয়েছি আমরা।

প্রত্যাশা কিছু রয়েছে বাকি- সামাজিক নিরীক্ষা দলের সঙ্গে উঠে আসে কিছু প্রত্যাশার কথা। দলটির সদস্যরা বলেন, ‘প্রত্যাশা আসলে অনেক। আমরা আমাদের এই সুবিধাবঞ্চিত কমিউনিটির জন্য যা যা চাই তার সিকি ভাগ হয়তো পূরণ হয়। তবে বর্তমানে আমাদের একটি বিশেষ চাওয়া রয়েছে যার সমাধান মেলেনি। এটি হলো ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালে ‘দালালের দৌরাত্ম্য’। হাসপাতালটিতে সাধারণ জনগণের চিকিৎসা নেওয়ার অধিকার থাকলেও তা সম্ভব হয় না দালালদের কারণে।’

এ বিষয়ে সামাজিক নিরীক্ষা দলের সদস্য রানা বলেন, ‘একজন রোগীকে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে বেড পাওয়া, টেস্ট করানো, ওষুধ পাওয়া- সব ক্ষেত্রেই পড়তে হয় দালালদের খপ্পরে। তাদের কারণে ২০ টাকার টিকিট কখনো কখনো হয়ে যায় ২০০ টাকা। রোগীর গুরুতর অবস্থা থাকলেও মেলে না বেড, কম খরচে টেস্ট করানোর আশ্বাস দিয়ে রোগীর থেকে আদায় করা হয় বাড়তি টাকা, বিনামূল্যে পাওয়ার কথা এমন ওষুধও কিনতে বাধ্য করা হয় রোগীকে। সবমিলিয়ে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মিডফোর্ড হাসপাতালে একজন রোগী গেলেও দিনশেষে দালালের কারণে তাকে গুণতে হয় নির্ধারিত পরিমাণের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি অর্থ।’

নারী মৈত্রীর সামগ্রিক কাজ নিয়ে সংগঠনটির প্রজেক্ট ম্যানেজার তাসলিমা হুদা স্বপ্না বলেন, আমরা নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতনতা তৈরিতে সরকারের পদক্ষেপ খুবই জরুরি।

ইয়ুথ সদস্য আমেনা আক্তার বৃষ্টি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা দলে থাকতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত। আমি মনে করি ইয়ুথদের এই ধরণের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া খুবই জরুরি।

বর্তমানে নিজেদের কমিউনিটির কাছে বেশ শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছে সামাজিক নিরীক্ষা দল। সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে সবার আগে খোঁজ নেয় তাদের। এলাকার কাউন্সিলরের কাছেও পরিচিতি পেয়েছে দলটি। যে কোনো সমস্যা সমাধানে তাদের সঙ্গে আগ্রহের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তিনি। এলাকার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সুনাম রয়েছে তাদের। করোনাকালীন জরুরি ত্রাণ সরবরাহ, হাত ধোয়া নিশ্চিত, স্কুলে নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা নিশ্চিত করা, মশক নিধন কার্যক্রম চালু করাসহ বিভিন্ন কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে দলটি। সম্প্রতি গণটিকা কার্যক্রমেও তারা রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে।

মিডফোর্ড হাসপাতালসহ দেশের সব সরকারি হাসপাতাল হবে দালালমুক্ত, এমনটিই প্রত্যাশা করে সামাজিক নিরীক্ষা দল। এছাড়াও নার্স/ওয়ার্ড বয়দের দুর্ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পর্যাপ্ত ওষুধ এই বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্টদের নজর কামনা করেন। একজন নাগরিক যেন বাড়তি নয় বরং তার প্রাপ্য অধিকারটুকুই ঠিকমতো বুঝে নিতে পারেন তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যেতে চান তারা।

ওডি/নিমি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড