• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

মিশর-রোমান-গ্রিক হয়ে এ যুগের ‘জন্মদিন’

  ইশরা-তুজ-জোহরা মারুফা

২৯ নভেম্বর ২০২১, ১৩:১৮
জন্মদিন
সাধারণ মানুষের জন্মদিন উদযাপন শুরু করেছিল প্রাচীন রোমানরা (ছবি : সংগৃহীত)

জন্মদিন, বেশিরভাগ মানুষের কাছে বছরের প্রতীক্ষিত একটি দিন। জন্মদিবস পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে একত্রিত হওয়ার একটি সুযোগ। একসঙ্গে কিছু সময় আনন্দে কাটানোর বা অভিনন্দন জানানোর একটি উপলক্ষ এটি। কিন্তু জন্মদিন পালনের শুরুটা হয়েছিল কবে থেকে? অতীতে কীভাবে পালন হতো বিশেষ এই দিনটি? তখনও কি কেক কাটা হতো কিংবা উৎসব করা হতো? অজানা সব প্রশ্নের উত্তর পেতে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়-

বর্ষপঞ্জিকা তৈরি না হওয়ার পূর্বে জন্মদিনের ধারণা ছিল না

প্রাথমিক সভ্যতায় চাঁদ, সূর্য বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ব্যবহার না করে সময়ের হিসাব রাখার কোনো উপায় ছিল না। আর এই কারণেই তাদের পক্ষে তখন মানুষের জন্মবার্ষিকী মনে রাখাটাও কঠিন ছিল। প্রাচীন মানুষরা চাঁদের চক্রের দিকে লক্ষ রাখতেন। একই সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের দিকেও খেয়াল করে দেখলেন, এই ছকটি বারবার পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তনগুলো মনে রেখেই তারা বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে এর আলোকেই জন্মদিন ও অন্যান্য বিশেষ দিন উদযাপনের ধারণা শুরু হয়েছিল।

মিশরীয়দের জন্মদিন পালন (ছবি : সংগৃহীত)

মিশরীয়দের থেকেই শুরু হয়েছিল জন্মদিনের ধারা

বাইবেলে সর্বপ্রথম জন্মদিন শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে ফারাওদের জন্মদিন উপলক্ষে। তবে আরও বিশদ গবেষণা থেকে জানা যায় যে, এটি পৃথিবীতে তাদের জন্ম নয় বরং ঈশ্বর হিসেবে তাদের জন্মকে বোঝানো হয়েছিল। প্রাচীন মিশরে যখন ফেরাউনদের মুকুট দেওয়া হতো তখন মনে করে হতো তারা মানুষ থেকে দেবদেবীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই মুকুট দেওয়ার দিনটিই তাদের কাছে পৃথিবীতে আসার দিন থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই দিনটিকেই জন্মদিন হিসেবে উদযাপন করতেন তারা।

বদ নজর থেকে প্রতিরক্ষা মেলায় জন্মদিন!

অনুমান করা হয় যে, গ্রীকরা জন্মদিন উদযাপনের উপলক্ষটি মিশরীয় ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করেছিল। তারা অন্যান্য বহু পৌত্তলিক সংস্কৃতিগুলির মতোই ভেবেছিল যে ‘জন্ম’ দিনের মতো বড় পরিবর্তনের দিনগুলি মন্দ আত্মাকে স্বাগত জানায়। তারা এই আত্মার প্রতিক্রিয়া হিসাবে মোমবাতি জ্বালাত, ঠিক যেভাবে অন্ধকারে কোনো আলোকে উপস্থাপন করা হয়। এভাবে, বদ নজর বা খারাপ আত্মার নজর থেকে সুরক্ষিত করার একটি বিশেষ দিন ভাবা হতো জন্মদিনকে। মোমবাতি ছাড়াও, বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার ব্যক্তির চারপাশে জড়ো হয়ে উৎসাহ ও শুভেচ্ছার মাধ্যমে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করত।

এখানেই শেষ নয়, তারা মনে করতেন এই দিনে উপহার প্রদান করলেও খারাপ প্রভাব থেকে দূরে থাকা যায়। এমনকি জন্মদিনকে ঘিরে হই-হুল্লোড় করাকেও খারাপ শক্তিকে দূর করার প্রভাবক ভাবা হতো।

সাধারণ মানুষের জন্মদিন উদযাপন শুরু করেছিল প্রাচীন রোমানরা

ইতিহাসে রোমানরা প্রথম সভ্যতা ছিল যারা অ-ধর্মীয় ব্যক্তির জন্মদিন উদযাপন শুরু করে। রোমানরা বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের জন্য জন্মদিন উদযাপন করত, অন্য দিকে সরকার বিখ্যাত নাগরিকের জন্মদিন পালন করতে সরকারী ছুটি ঘোষণা করত। যারা ৫০তম জন্মদিন উদযাপন করত, তাদের জন্য আয়োজন করা হতো গমের আটা, অলিভ অয়েল, মধু ও পনির কুচি দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ কেক। সম্ভবত এখান থেকেই জন্মদিনের কেকের আগমন ঘটে। তবে, ১২তম শতাব্দী পর্যন্ত মহিলাদের জন্মদিন উদযাপিত হতো না।

মোমবাতিকে প্রার্থনার প্রতীক ধরা হতো (ছবি : সংগৃহীত)

গ্রীকরাই প্রথম জন্মদিনে মোমবাতির প্রচলন করে

গ্রিক সভ্যতায় একটি বিশাল অংশ জুড়ে ছিল তাদের দেব-দেবীরা। তারা তাদের দেব-দেবীদের তুষ্ট করতে অনেক শ্রদ্ধা ও বলিদান করত। গ্রীকরা চন্দ্রদেবী আরতেমিসের জন্মদিনে চাঁদ আকৃতির কেক উৎসর্গ করতো। কেকের ওপর মোমবাতি জ্বালিয়ে কেকটিকে উজ্জ্বল করার ধারণা গ্রীকদের থেকেই এসেছিল। দেবতাদের কাছে প্রার্থনা পাঠানোর প্রতীক ধরা হতো মোমবাতিকে। আবার মোমবাতি নেভানোকে এক ধরনের বার্তা পাঠানোর উপায় মানা হতো।

খ্রিস্টান সংস্কৃতিতে জন্মদিনকে প্রথমে একটি প্যাগান আচার হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল

প্যাগান সমাজে জন্মদিন পালনের রীতি থাকলেও সেমেটিক সমাজে জন্মদিন মোটেও স্বাভাবিক নিয়ম ছিল না। বরং প্যাগানদের থেকে উৎপত্তি হবার কারণে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা প্রথমদিকে জন্মদিন পালনকে শয়তানের রীতি হিসেবে মনে করত। তবে খ্রিস্টানদের ধ্যানধারণা পাল্টাতে থাকে চতুর্থ শতাব্দীর পর থেকে। প্রথমদিকে কোনো নিয়ম না থাকলেও চতুর্থ শতাব্দীর পর থেকে যীশুর জন্মদিন পালন শুরু করে খ্রিস্টানরা। এর ফলে খ্রিস্টান চার্চগুলো জন্মদিন পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। প্রথমদিকে ধর্মীয় চরিত্রগুলোর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষেরাও কেউ কেউ জন্মদিন পালন শুরু করে। বর্তমানে ক্রিসমাস (যীশুর জন্মদিন) পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।

‘শুভ জন্মদিন’ সুরটি আসলে এক প্রকারের রিমিক্স ছিল

প্যাটি হিল এবং মিল্ড্রেড জে হিল নামের দুই বোন, যারা উভয়ই ‘কেন্টার্কি’ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তারা ১৮৯৩ সালে ‘গুড মর্নিং টু অল’ নামে একটি গান লিখেছিলেন যা অন্য স্কুল শিক্ষকদের জন্য একটি বইয়ে প্রকাশিত করা হয়েছিল। গানের আসল উদ্দেশ্য ছিল দিন শুরু হওয়ার আগে শিক্ষার্থীরা এটি ক্লাসে গাওয়া। পরে এই গানে নিয়ে আসা হয় বিভিন্নতা।

রবার্ট কোলম্যান ১৯২৪ সালে একটি গানের বই প্রকাশ করেছিলেন যেখানে এই গানের সাথে কয়েকটি অতিরিক্ত শব্দ যোগ করা হয় যা দ্রুত মূল গানটিকে আড়ালে ফেলে দেয়। সেই জনপ্রিয় পুরানো সুরের এই নতুন গানটি আমরা আজ ‘জন্মদিনের গান’ হিসেবে জানি।

১৯৩৩ সালে, এই গানের নতুন সংস্করণে একটি ইরভিং বার্লিন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল। একজন প্রতিষ্ঠাতা এই অভিযোগে মামলা করেছেন যে তারা সুরটির কপিরাইট রাখে। তারা মামলাটি জিতে যায় এবং কপিরাইট এখনও অবধি আছে। কিছু লোক এখনও মনে করেন যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই গানটি কপিরাইটের অধীনে থাকবে। কপিরাইটের আয়গুলি কপিরাইটের মালিক এবং হিলের এস্টেটের মাঝে বিভক্ত করা হয়, যা বছরে প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার হিসাবে অনুমান করা হয়।

জন্মদিনের কেক (ছবি : সংগৃহীত)

জন্মদিনের কেক আবিষ্কার করেছিলেন জার্মান বেকাররা

একটা সময় পুরো বিশ্বজুড়ে জন্মদিন পালন করা শুরু হয়, এমনকি চীনেও। সেখানে বাচ্চাদের প্রথম জন্মদিন বিশেষ গুরুত্বসহকারে উদযাপন করা হতো। ১৮ শতকের শেষের দিকে জার্মানরা কিন্ডারফেস্ট নামে একটি জন্মদিনের আয়োজন করতো যা বর্তমান সময়ের মতো আধুনিক। বাচ্চাদের জন্মদিনে যততম জন্মদিন ততটির থেকে একটি বেশি মোমবাতি দেওয়া হতো। বাড়তি মোমবাতিটি এই কারণে দেওয়া হতো যে এতে বাচ্চাদের আরও একবছর আয়ুর বাড়ার আশা করা যায়, এমনটাই মনে করতো জার্মানরা।

আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি মানুষের জন্মদিন ৫ অক্টোবর

আপনি যদি একটু খেয়াল করেন তবে দেখবেন যে ইংরেজি নববর্ষের আগের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাস হয় এবং এ দিনটি আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি মানুষের জন্মতারিখ বলে বিবেচিত। অপরপক্ষে ২২ মে সবচেয়ে কম মানুষের জন্মদিন দেখা যায় দেশটিতে।

ইতিহাস যাই হোক না কেন আর জন্মদিন যেভাবেই আসুক না কেন- এই দিনটি বর্তমানে আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই বিশেষ একটি দিন। যে দিনটিকে পালন করা হয় আনন্দ আর উৎসবে।

তথ্য সূত্র : পাম্প ইট আপ পার্টি ডট কম, ব্যগস অব লাভ ডট কো ডট ইউকে, হিস্টোরি অব ইয়েসটারডে ডট কম ইত্যাদি

ওডি/নিমি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড