• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বঞ্চিত মানুষের মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা ‘ভাসানী’

  নিশীতা মিতু

১৭ নভেম্বর ২০২১, ১০:৪৭
ভাসানী
মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ছবি : সংগৃহীত)

জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি সংগ্রাম ছিল তার সঙ্গী। তিনি ছিলেন অকুতোভয়, নির্ভীক। অধিকার আদায়ে তার অবস্থান ছিল জোরালো। পূর্ব বাংলার বঞ্চিত মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন; স্বাধীনতা, সংগ্রাম শব্দগুলোর বীজ বাঙালির মনে সর্বপ্রথম বপন করেছিলেন। তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অংশ থেকে শুরু করে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হওয়ার পুরো পথজুড়ে যার অবদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আজ (১৭ নভেম্বর) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।

ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক অত্যাচার-অনাচারে যখন ভারতীয় উপমহাদেশ জর্জরিত তখন ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পিতা হাজী শরাফত আলী খান ও মা বেগম শারাফত আলীর পরিবারের ৪টি সন্তানের মধ্যে ভাসানী ছিলেন সবার ছোট। ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া।

খুব কম বয়সেই পিতৃহারা হন মাওলানা ভাসানী। ১৮৮৪-৮৫ সালে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় মহামারী ওলাওঠা দেখা যায়। মারা যান মা, দুই ভাই আর বোন। পরিবারের একমাত্র সদস্য তিনিই বেঁচে থাকেন।

জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই সংগ্রাম ছিল তার নিত্যসঙ্গী। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থেকেছেন। সে সময় ইরাকের আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দিন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। ভাসানী তার আশ্রয়ে থাকেন কিছুদিন। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান এবং সেখানে তিনি মাদরাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। পরে ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম গমন করেন।

আসামে এসেই তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। কৈশোর কিংবা যৌবন ভাসানীর সবটা জুড়েই ছিল এই রাজনীতি। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে আসামে স্থানীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এসময় আবারও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলামি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। এই সময়ই রাজনীতির প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকেন তিনি।

১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশদের কারাগারে ১০ মাস কারাদণ্ড ভোগও করেন তিনি।

১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন মহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনের সঙ্গে। সংসার ধর্মের চেয়ে রাজনীতিই হয়তো মুখ্য ছিল ভাসানীর কাছে। বিয়ের পরের বছরই তাই সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে আয়োজন করেন প্রথম কৃষক সম্মেলনের। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় ‘ভাসানীর মাওলানা’। পরবর্তীতে যা তার নামের শেষে যোগ হয়।

বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবন ছিল ভাসানীর। ১৯৩৬ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দেন তিনি। আসামের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হন। ১৯৩৭ সালে আসামে কুখ্যাত লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন করেন এবং আসাম প্রাদেশিক পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করেন। ১৯৪৭ সালের ৫ মার্চ আসামে আন্দোলনের ডাক দেন। এরপর আবার এই বাংলায় ফিরে আসেন।

১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভায় বাংলা ভাষার পক্ষ সমর্থনে পাকিস্তানে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশ করেন ভাসানী। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা করে সভাপতি হন। ১৯৫৫ সালের ১৫ জুন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জনসভা করেন। ১৯৫৭ সালের ৬ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে বিখ্যাত “আসসালামু আলাইকুম” ঘোষণা করেন। ওই বছরের মার্চ মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধে আওয়ামী লীগ ত্যাগ এবং ২৬ জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বঙ্গবন্ধুও তাকে শ্রদ্ধা করতেন।

স্বাধীনতার পথকে সুগম করা নেতা মাওলানা ভাসানী। ১৯৬৫ সালে আইয়ুববিরোধী নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে অংশগ্রহণ করেন তিনি। পাক-ভারত যুদ্ধে অবতীর্ণ হন দেশপ্রেমিকের ভূমিকা। ১৯৬৬ সালে ন্যাপের পক্ষ থেকে ১৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন, ১৯৬৮ সালে আইয়ূবের পতনের লক্ষে ১০ দফা ‘দাবি সপ্তাহ’ পালন করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব আহূত গোলটেবিল বৈঠক বর্জন করেন তিনি। ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে সন্তোষে ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন, পাকিস্তানের টোবাটেক সিং-এ মার্চে কৃষক সম্মেলন, পাঁচবিবির মহিপুরে এপ্রিলে কৃষক সম্মেলন করেন। ৪ ডিসেম্বর পল্টনের জনসভায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ঘোষণা দিয়ে বলেন, “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালইয়া দ্বীন”।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ এ মামলার সকল আসামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছিলেন ভাসানী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি দেখেছেন ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের জন্ম হতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবদান অবিস্মরণীয়।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ-চেতনার সংমিশ্রণে একজন মানুষ। মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা আর মুক্তির লড়াইয়ে যুদ্ধ করে গেছেন সারাজীবন। তার দল ক্ষমতায় এলে ক্ষমতা স্পর্শ করেনি তাকে। সারাজীবন তালপাতার টুপি, ঢোলা পাঞ্জাবি আর সফেদ দাড়িকেই সঙ্গী করেছেন। মিশেছেন কৃষকের সঙ্গে, দিনমজুরের সঙ্গে, খেঁটে খাওয়া দরিদ্রের সঙ্গে। ১৯৭৬ সালের এই দিনে ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সিরাজগঞ্জে জন্ম হলেও ভাসানী তার জীবনের সবচেয়ে বেশি অংশ পার করেছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। মৃত্যুর পরে সেখানেই তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

বুধবার (১৭ নভেম্বর) ভোর থেকেই মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাজারে শ্রদ্ধার্ঘ জানাতে ঢল নেমেছে সর্বস্তরের মানুষের। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাপাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন প্রয়াত এই নেতার মাজারে।

এছাড়াও মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল কলেজ, মওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সূত্র : উইকিপিডিয়া

ওডি/নিমি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড