নিশীতা মিতু
‘বেঁচে থাকার মতো আনন্দ আর কিছুই নেই। কত অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে। মন দিয়ে আমরা কখনো তা দেখি না। যখন সময় শেষ হয়ে যায়, তখনি শুধু হাহাকারে হৃদয় পূর্ণ হয়।’— লাইন তিনটি পড়ে আপনার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি উঁকি দেবে তা হলো জীবনকে এর গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে কজন? কথাগুলো যিনি বলেছেন তাই হয়তো তাকে বলা হয় জাদুকর, কথার জাদুকর। ডাক নাম কাজল হলেও আমাদের কাছে তিনি পরিচিত হুমায়ূন আহমেদ নামে।
আজ (১৩ নভেম্বর) নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। সহজ কথার গল্পকার ছিলেন তিনি। চেনাজানা শব্দগুলোকে এক এক করে গেঁথে তৈরি করতেন মায়ার ধুম্রজাল। যে জালে আঁটকে যেতেন পাঠক, ভুলে যেতেন খাওয়া, ঘুম বা অন্য কাজ। বর্তমানে হুমায়ূন সশরীরে বেঁচে না থাকলেও বেঁচে রয়েছেন তার অলৌকিক রসবোধ আর রহস্যের মিশেলে সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের মাঝে।
আজও পাঠক হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। মুগ্ধ হয়ে পাতা উল্টায়, কখনোবা জট ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন আবার কখনোবা গল্পের শেষে এসে কী জানি শেষ না হওয়ার চিন্তায় বিভোর হন। বই পড়িয়ে পিপাসিত করার জাদুটা হুমায়ূনের বেশ ভালোই রপ্ত করা। তাইতো হুমায়ূনপ্রেমীরা আজও বৃষ্টি, জোছনা কিংবা চায়ের কাপে খুঁজে নেন প্রিয় লেখককে।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার ডাক নাম ছিল কাজল। বাবার রাখা প্রথম নাম শামসুর রহমান হলেও পরে তার বাবা ছেলের নাম বদলে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ।
১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। পাঠকমহলে এই উপন্যাসই যে ঝড় তোলে তাতে হুমায়ূনকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। একেক পর এক উপন্যাস লিখে গেছেন তিনি। সৃষ্টি করেছেন হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, বাকের ভাই, রূপার অতো অমরত্ব কিছু চরিত্র।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই মারণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে হার মানার আগে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, গীতিকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক- প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন তিনি।
১৯৮০-১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ধারাবাহিক এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রচনা শুরু করেন তিনি৷ ১৯৮৩ সালে তার প্রথম টিভি কাহিনীচিত্র ‘প্রথম প্রহর’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার শুরু হলে বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরো মনোযোগ দেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর টেলিভিশন ধারাবাহিকগুলোর মধ্যে ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’, ‘নিমফুল’, ‘তারা তিনজন’ ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম', ‘সবুজ সাথী’, ‘উড়ে যায় বকপঙ্খী’, ‘এই মেঘ এই রৌদ্র’ উল্লেখযোগ্য। এখনও ইউটিউব ঘেঁটে এসব ধারাবাহিকে মুগ্ধ হন দর্শক শ্রোতা। আজ রবিবার কিংবা কোথাও কেউ নেই এর নানা ডায়ালগ ঘুরে ফিরে চলে আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেসঙ্গে ফিরে আসেন হুমায়ূন আহমেদও।
প্রেমকে অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবেই আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তাই হয়তো লিখেছেন, ‘গভীর প্রেম মানুষকে পুতুল বানিয় দেয়। প্রেমিক প্রেমিকার হাতের পুতুল হন কিংবা প্রেমিকা হয় প্রেমিকের পুতুল। দুজন এক সঙ্গে কখনো পুতুল হয় না। কে পুতুল হবে আর কে হবে সূত্রধর তা নির্ভর করে মানসিক ক্ষমতার উপর। মানসিক ক্ষমতা যার বেশী তার হাতেই পুতুলের সুতা।’
হুমায়ূন আহমেদের চিত্রনাট্য ও পরিচালনার ছবিগুলোর মধ্যে ‘আগুনের পরশমণী’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করেছে৷ ‘খেলা’, ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘খাদক’, ‘একি কাণ্ড’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অন্যভূবন’ উল্লেখযোগ্য।
হুমায়ূন আহমেদ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও বেঁচে রয়েছেন তার সৃষ্টিতে। আজ থেকে বহু বছর পরেও তাই কিশোরী মেয়ে হয়তো কানের পাশে লাল জবা গেঁথে গেয়ে উঠবে- ‘কন্যার চিরল বিরল চুল, তাহার কেশে জবা ফুল’। হয়তো তখনও বিরহের সুরে কেউ বলবে- ‘যদি মন কাঁদে/ তুমি চলে এসো, চলে এসো/ এক বরষায়...’। আর এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ থেকে যাবেন যুগের পর যুগ।
ওডি/নিমি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড