• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হেমন্তের সঙ্গী সবুজাভ সফেদ ‘ছাতিম ফুল’

  ইশরা তুজ জোহরা মারুফা

২৮ অক্টোবর ২০২১, ১০:২৯
ছাতিম
ছাতিম ফুল (ছবি : সংগৃহীত)

শরৎ কিংবা হেমন্তের রাতে হঠাৎ নাকে ভেসে আসে কোনো এক ফুলের ঘ্রাণ। খুব চেনা এই ঘ্রাণ ছাতিম ফুলের। গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত ছাতিম ফুল ফোটে শরৎ বা হেমন্তে। পুরো গাছে অসংখ্য ছোট ছোট সবুজাভ সাদা গুচ্ছবদ্ধ ফুল বাড়ায় শোভা। শরতের সন্ধ্যায় বাতাসে ছাতিম ফুলের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায়। সারা বছর এ গাছের কথা মনে না থাকলে ও শরৎ এলে ছাতিম ফুল নিজেই তার অস্তিত্বের জানান দেয়। সেই সঙ্গে বার্তা নিয়ে আসে নবান্ন ও শীতের রিক্ততার।

সাধারণত এতে সাতটি পাতা থাকায় সংস্কৃত ভাষায় একে সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্ণী উদ্ভিদ বলে। কাণ্ডগুলো ছাতার মতো বেষ্টিত হয়ে থাকে। হয়তো এ কারণেও গাছটির নাম ছাতিম। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে এটিকে ছাতিয়ান, ছাতনি, ছাইত্তান, ছাইত্যানাসহ নানা নামে ডাকা হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটির আদি নিবাস ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া। আর্দ্র, কর্দমাক্ত ও জলসিক্ত স্থানে এটি বেশি জন্মে।

ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম ‘এলোস্টনিয়া স্কলারিস’। এটি ‘এপোসাইনাসিয়ি’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত উদ্ভিদ। ছাতিম ঘিরে অনেক কল্পকাহিনীও প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, এ গাছে নাকি ভূত থাকে। অন্ধকার রাতে ছাতিম গাছকে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দানবের মতো মনে হয়। পশ্চিমা বিশ্বেও আছে এর বদনাম। ইংরেজিতে একে ডেভিলস ট্রি বলা হয়। যার মানে হলো শয়তানের বৃক্ষ। তাছাড়া দাদী-নানীদের গল্পের ঝুলিতে ছাতিম গাছের ভূতের কথা শুনতে শুনতেই কেটেছে আমাদের ছেলেবেলা। কখনোবা ছড়ায় পড়েছি- শ্যাওড়া গাছে পেতনী ঠাসা/ ছাতিম গাছে ভুতের বাসা।

ছাতিম গাছ ৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এটি যৌগিক পত্র বিশিষ্ট উদ্ভিদ। ছাতিমের বৃন্তের গোঁড়ায় পাঁচ থেকে আট-নয়টি পর্যন্ত পত্র থাকে। এর সরল উন্নত কাণ্ড কিছুদূর ওঠে হঠাৎ শাখা-প্রশাখার একটি ছাতার মতো পল্লব সৃষ্টি করে, আবার এক লাফে অনেক দূরে ওঠে আবার একটি পাতার আবরণের ধাপ তৈরি করে। এর পত্রবিন্যাস আবর্ত। পাতা বল্লমাকার। উঁচু লম্বা চিরসবুজ ছাতিম গাছ দেশের প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়। গাছ ১৫-২০ মিটার উঁচু হয়। বাকল ঘন ধূসর বর্ণের। কিছুটা খসখসে। কাঠ সাদা বর্ণের ও নরম। পাতা ১০-১৫ সেমি লম্বা ও ৪ সেমি চওড়া। শরৎ থেকে হেমন্তে ফুল ফুটে। ফল সজোড়, থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে। বীজ সাদা বর্ণের, দু'দিক পশমের মতো। ছাতিম গাছ থেকে দুধসাদা ও অত্যন্ত তেতো কষ বের হয়।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ফুলগুলোর মধ্যে ছাতিম ফুল ছিল অন্যতম। তাই হয়তো শান্তিনিকেতনে ছাতিম গাছের এত সমারোহ দেখা যায়। এমনকি সেখানকার শিক্ষার্থীদেরকে সমাবর্তনে ছাতিম পাতা দিয়ে বরণ করে নেয়া হতো। ছাতিম নিয়ে কবি লিখেছেন- ‘ঊষার ছোঁয়া জাগায় ওরে/ ছাতিমশাখে পাতার কোলে’।

ছাতিমের নরম কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড, পেনসিল, দেয়াশলাই কাঠি ও চায়ের বাক্স তৈরি করা হয়। ছাতিমের কাঠ থেকে সাধারণ মানের আসবাবপত্র এবং কফিন ও পাতলা কাঠের বক্সও বানানো হয়। গাছটির তেমন কোনও বাণিজ্যিক মূল্য নেই। তাই হয়তো ছাতিম প্রেমীদের ছাড়া অন্য কারোও কাছে এর গুরুত্ব নেই। তবে ছাতিমের আছে অনেক ঔষধি গুনাগুণ। চলুন জেনে নিই এর উপকারী দিক সম্পর্কে-

ছাতিম ছাল চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় ১ চা-চামচ গুলঞ্চের রস মিশিয়ে খেতে হয়। আর সেই সঙ্গে ১০/১২ গ্রাম ছাল ৩ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে ওই পানি দিয়ে গোসল করলে কুষ্ঠ রোগ ভালো হয়।

হিক্কা শ্বাসে কফের আধিক্য থাকবেই, এক্ষেত্রে ছাতিম ছালের আধা চা-চামচ ৩০/৪০ ফোঁটা রস চার ভাগের এক কাপ দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।

জ্বর ও অরুচিতে ১০/১২ গ্রাম ছাতিম ছাল চার ভাগের তিন কাপ পানিতে সিদ্ধ করে ছেঁকে নিয়ে ঐ পানি সমান ভাগে সকালে ও বিকালে খেলে হয়। এতে জ্বর নামার সময় শরীরে ঘাম হয় না। ২/১ দিনের মধ্যে জ্বর সেরে যায়।

সর্দির বিশেষ প্রকোপ নেই কিন্তু হাঁপানির টান থাকলে এক বা দেড় গ্রাম ছাতিম ফুল চূর্ণ ও ২০০/২৫০ মি.গ্রা পিপুল চূর্ণ দইয়ের মাতের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হয়।

দাঁতের পোকার যন্ত্রণায় ছাতিমের আঠা পোকা লাগা দাঁতের ছিদ্রে দিলে যন্ত্রণা উপশম হয়।

পাইয়োরিয়ায় ছাতিমের আঠা ৫/১০ ফোঁটা গরম পানিতে মিশিয়ে গড়গড়া করতে হবে। আর যদি সম্ভব হয় ২/৫ মিনিট মুখে রেখে ফেলে দিন। এইভাবে একদিন অন্তর করলে এই সমস্যা দূর হয়।

যারা অ্যাসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যায় ভুগছেন তারা ছাতিম ছাল বা ফুল চূর্ণ আধা গ্রাম মাত্রায় কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে দুই বেলা খেলে ফল পাওয়া যায়।

বুকের দুধের স্বল্পতায় ৫/৬ গ্রাম ছাল থেঁতো করে ২ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে আধা কাপ হলে নামিয়ে ছেঁকে তার সাথে আধা কাপ দুধ মিশিয়ে খেলে কাজ হয়।

বাতের জন্য যাদের ব্যথা হয় তারা ৭/৮ গ্রাম ছাতিমের ছাল ৩ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে ঐ ক্বাথটা খেলে ব্যথা সেরে যায়।

তাছাড়া ছাতিমের বাকলের নির্যাস উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর রস, আঠা ও মূল টিউমার এমনকি ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগেও ব্যবহৃত হয়।

শরৎ আর হেমন্তের জ্যোৎস্না রাতে ছড়িয়ে পড়ে ছাতিম ফুলের মায়াবী ঘ্রাণ। সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব মায়াময় আবেশের। ভোরবেলা ছাতিম গাছতলায়, ফুটপাত ও সড়কগুলোতে বিছানো থাকে ঝরে পড়ে থাকা সবুজাভ সাদা ফুল। শীতের রিক্ততার আগে প্রকৃতিতে হেমন্তের এক অকৃত্রিম উপহার এই ছাতিম ফুল।

ওডি/নিমি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড