নিশীতা মিতু
আবহাওয়া গতকালও যা ছিল আজও তা। গরমে অতিষ্ঠ জীবন। তার মাঝে বইছে হালকা হাওয়া। আবহাওয়া না বদলালেও বদলেছে ক্যালেন্ডারের পাতা। বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে এসেছে নতুন মাস, সেসঙ্গে আগমন ঘটেছে নতুন ঋতুর। আজ পহেলা কার্তিক, হেমন্ত ঋতুর প্রথম দিন।
গরম আর শীতের সঙ্গমের ঋতু হেমন্ত, সোনালি ফসল ঘরে তোলার সময় এলো কৃষকের ঘরে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে দাপট কমবে সূর্যের, সেসঙ্গে ঘাস লতা-পাতা সাজবে শিশিরকন্যা অলঙ্কারে। হেমন্তের রূপে যতজন মুগ্ধ হয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম গ্রাম বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। হেমন্তের রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েছেন কবি অসংখ্যবার। মনের ভাব প্রকাশ করে লিখেছেন- ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/ হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল;/ অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/ বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা!/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!’।
প্রকৃতির স্বর্ণঋতু হেমন্ত। মাঠজুড়ে সোনালি ফসল ধানের দোলা শিহরিত করে মন। নুয়ে পড়ে কাশফুলে শিশির জমে জানান দেয়, এরপরই আসবে শীত। কবি জীবনানন্দ হেমন্তকে বলেছেন ঋতুকন্যা। কবির দৃষ্টিতে এ ঋতু যৌবনময়ী।
শহরাঞ্চলের ইট সিমেন্টের দালান আর নাগরিক কোলাহলে হেমন্তের আমেজ তেমন একটা বোঝা না গেলেও গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতিতে হেমন্তকে ঘিরে উৎসবের আমেজ যেন চিরকালীন শাশ্বত রূপ। কৃষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সোনা ফসল ঘরে তুলতে। আর তারপরও সোনালি রঙের ফসলকে নিয়ে কৃষক পরিবারগুলোতে শুরু হয় আনন্দ উৎসব। কিষাণীরা ব্যস্ত থাকেন ধান মাড়াই, রোদে শুকানোর কাজে।
কার্তিকের ফসল ঘরে তোলা হয় অগ্রহায়ণে। কৃষকের ঘরে ঘরে শুরু হয় বাংলার ঐতিহ্য ‘নবান্ন উৎসব’। নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই এই উৎসবের সূচনা। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজন করা হয় উৎসবের। অগ্রহায়ণে নতুন ধানের চাল দিয়ে রান্না করা হয় ফিরনি-পায়েস। কোনো কোনো অঞ্চলে বানানো হয় বাহারি পিঠা।
শুধু কী তাই? এই নবান্নকে ঘিরে বসে গ্রাম্য মেলা। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়া, পুতুল নাচ, বায়স্কোপ সব মেলে এখানে। সঙ্গে থাকে দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যদিও কালের স্রোতে নবান্নর আমেজও যেন গ্রামে কিছুটা পানসে হয়ে যাচ্ছে।
নবান্ন উৎসবে নিমন্ত্রণ জানানো হয় নতুন জামাইকে। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে আনা হয় ‘নাইওর’। সবকিছু মিলিয়ে চারপাশে যেন উৎসবের মেলা বসে। এর কিছু পরই আশেপাশে আনাগোনা ঘটায় অতিথি পাখিরা। হেমন্তের শেষের দিকটায় যেন এ দেশের প্রকৃতিকে ভালোবেসে তারাও চলে আসে। প্রকৃতিও তখন মুখর হয়ে পড়ে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে।
হেমন্তে সমারোহ ঘটে বিভিন্ন ফলের। তবে কামরাঙ্গা আর চালতা এ ঋতুর বিশেষ ফল। হেমন্তের প্রধান ফল নারিকেল। আর তাইতো নতুন চালের গুঁড়ার সঙ্গে নারিকেল মিশিয়ে নানা বাহারের পিঠা তৈরির ধুম চলে ঘরে ঘরে। সারা রাত জেগে পিঠা তৈরি করেন গৃহিণীরা। কষ্ট সার্থক করে পিঠা বানানো শেষে তা বিতরণ করেন পাড়া-পড়শিদের মাঝে। মজবুত হয় বন্ধন, বৃদ্ধি পায় পারস্পরিক ভালোবাসা।
অন্য ঋতুর চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হেমন্তে। তাকে না যায় ধরা, না যায় ছোঁয়া। হেমন্তকে তাই উপলব্ধি করতে হয়, মন থেকে অনুভব করতে হয়। এ ঋতুতে গ্রীষ্মের মতো খরতাপ নেই, বর্ষার বৃষ্টির মুখরতা নেই, শীতের তীব্রতার উপস্থিতিও নেই। হেমন্তকে তাই খুঁজে নিতে হয়, বুঝে নিতে হয়।
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;’- পাখির বেশে কার্তিকের ভোরে বার বার আসতে চেয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ।
আজ থেকে আগামী দুই মাস প্রকৃতিতে বিরাজ করবে শান্ত স্বভাবের হেমন্ত। কখনো পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণে, কখনো বনের পাখির অচেনা সুরে, কখনোবা ঝরে পড়া দুচারটে ফুল আর ভোরের ঘাসে শিশিরের উপস্থিতি জানান দেবে তার উপস্থিতি।
ওডি/নিমি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড