খালিদ ফেরদৌস
মানুষ সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলো অবমূল্যায়ন করে। যেমন- পানি, সূর্যের আলো, বাতাস, মাটি এবং মায়ের অবারিত অসীম ভালোবাসা। এগুলো আমরা খুব সহজে পায়, তাই এর মূল্য বুঝি না। আবার সবচেয়ে কম প্রয়োজনের বা দুষ্প্রাপ্য জিনিসগুলো আমরা অতি মূল্যায়ন করি। যেমন সোনা, হিরা, চুনি, পান্না। কার্যত এগুলোর আমাদের কোনো কাজে আসে না। কিন্তু দুষ্প্রাপ্য এবং ঝলমল করার গুণের কারণে এত দামি এগুলো।
আমিও ঠিক মানুষের মতোই। মায়ের ভালোবাসা খুব সহজেই পেতাম বলে তাকে খুব গুরুত্ব দিতাম না। তেমন একটা খোঁজ নিতাম না। খাওয়ার সময় হলেই তাকে খুঁজতাম। সব সহপাঠীরা গ্রামীণ চেকের শার্ট বানাচ্ছে, এইজন্য মার কাছে বাহানা ধরে গ্রামীণ চেকের শার্ট বানাতাম। এই যা। এর ভেতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স হলো। পড়াশুনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। বিশাল কিছু হয়ে যেতে হবে। শুধু দুই ঈদে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যেতাম। এইজন্য বাড়ির লোক আমাকে নোয়াখাইল্ল্যা বলত। (দয়াকরে নোয়াখালীর লোক এইজন্য আমাকে গাল দিবেন না। এখানে তাদের ছোট করা হয়নি। এটা নোয়াখালীদের খুব ভালো গুণ। এইজন্যই হয়তো তারা এতো এগিয়েছে।) ছাত্রাবস্থায় একদিন বাড়ি থেকে ঢাকা যাচ্ছি। সাই সাই করে চলছে বাস। বাসের জানালা দিয়ে সবুজ-শ্যামল মাঠ-ক্ষেতস্নাত বাতাস এসে লাগছে গায়ে। হিম হিম ঠান্ডা অনুভূতি। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম- মনের আকাশে মেঘ নেই কিন্তু চোখের কোণে বৃষ্টি। অবশেষে আকাশেও মেঘ ঘনীভূত হলো। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। প্রকৃতির রোদনের সাথে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। এরপর আবিষ্কার করলাম আমি মনের অজান্তে মায়ের জন্য কাঁদছি। মাকে ফোন দিলাম। মাকে বললাম, মা আমি যদি তোমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করে থাকি ; তবে আমাকে মাফ করে দিও। মা টেনশনে পড়ে গেল। সে ভাবল- আমার ছেলে বাসে কোনো একসিডেন্ট করল না তো! সে বলল, কী হয়েছে তোমার? আমি বললাম, কিছু না। তোমাকে খুব মনে পড়ছে। সে এক পর্যায়ে বলল, মায়ের তার সন্তানের প্রতি মমতা কখনোই কমে না। হাজার গঞ্জনাতেও কমে না।সবসময় বেড়ে যায় হিসেবহীনভাবে। এরপর থেকে মায়ের বেশি বেশি খোঁজ নিতাম। মা আমার অসুস্থ হয়ে পড়ল। পরীক্ষা করে তার কিডনিতে পাথর ধরা পড়ল। অপারেশন করে পাথর অপসারণ করা হলো। সুস্থ হয়ে উঠলেন। এরমধ্যে মাকে একদিন ফোন দিয়ে মায়ের সাথে কথা বলতেই এ ওপাশ থেকে বলল, 'বাবা আমি ভালো নেই। আবার বুকের ব্যথাটা বেড়েছে।' বুকের ভেতরে ডুকরে উঠলো। হাজার অসুস্থ হলেও যে মা কোনোদিন রোজা ছাড়েনি, সে রোজা রাখতে পারছে না। বুঝতে কষ্ট হয়নি। মা সত্যিই খুব অসুস্থ। খুব কষ্ট পাচ্ছে মা।
আমি অস্থির হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল- আমার জীবনে আর কিচ্ছু দরকার নেই। দরকার শুধু মায়ের সুস্থতা। বাবা, 'আমি ভালো নেই।'এই কথা মনে হলেই আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। এখন তার সম্পর্কে একটু লিখতে গিয়েও কান্না ধরে রাখতে পারছি না। চোখ দিয়ে ঝড়ছে কেতলির গরম পানির মতো অশ্রু। এখন মায়ের কথা মনে হলেই চোখে নেমে আসে বর্ষণ। তখন পৃথিবী সব সুখ-সফলতা অর্থহীন মনে হয়। আমি প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহর কাছে দোয়া করি মায়ের পূর্ণাঙ্গ সুস্থতার জন্য। মায়ের প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার উদগীরণ আমাকে অবাক করেছে। এই পরিবর্তিত আমি- আমাকেই আমি চিনতে পারি না। মা এমন একটা মহামূল্যবান সত্তা যার কোনো বিনিময় মূল্য নেই। কী অসীম দরদ ও মাহাত্ম্যপূর্ণ শব্দ মা। মা যেন শান্তির পায়রা, সাহসের বাতিঘর। আমার মা এখন বেশ সুস্থ। পৃথিবীর সকল মায়েরা সুস্থ-সবলভাবে বাকি জীবন পার করুক; মা দিবসে এই দোয়া ও কামনা। আজ ১০ মে বিশ্ব মা দিবস। প্রতিদিন মা দিবস হয়ে উঠুক এই ধরণীতে। যত্নে থাকুক, আদর-ভক্তিতে থাকুক, বুকের পাঁজরের মধ্যিখানে অগুনতি বিশুদ্ধ ভালোবাসায় থাকুক মা। মা আমাদের সমগ্র আসমান। মা তুমি আমাদের নীলাকাশের ছাদ।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষক, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড