নিশীতা মিতু
ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে পাওয়া যায় ভয়াবহ কিছু মহামারীকে। অজস্র মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল যে ফ্লু বা ভাইরাসগুলো। তবে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ এর কথা বললেই আঁতকে উঠতে হবে আপনাকে। যুদ্ধ বা বিদ্রোহ নয়, একটি ভাইরাসই কেড়ে নেয় ১০ কোটি মানুষের জীবন। সংখ্যাটা বেশ বড় তাই না?
এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা একসময় ছিল কল্পনাতীত। সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। এই সংখ্যাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মৃতের সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি।
উৎপত্তি হলো কোথায় থেকে?
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, কোনো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে স্প্যানিশ ফ্লু হচ্ছে। স্পেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এমন খবরই প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জানা যায় তা ভুল ধারণা। সম্পূর্ণ নতুন এক ভাইরাসই এই ফ্লুয়ের জন্য দায়ী ছিল। গবেষণার মাধ্যমে তা শনাক্ত করা হয়। এই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় ‘এইচ ওয়ান এন ওয়ান ভাইরাস’ (H1N1) তার আগে প্রাথমিকভাবে এর নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্লু।
নাম কেন ‘স্প্যানিশ ফ্লু’?
১৮৮৮ সালে অর্থাৎ, স্প্যানিশ ফ্লুর ৩০ বছর আগে ইউরোপে সংক্রমণ হয়েছিল রাশিয়ান ফ্লুর। এর উৎপত্তিস্থল ছিল উজবেকিস্তানের বুখারা। সে সময় উজবেকিস্তান রাশিয়ার অংশ ছিল। যার কারণে সেই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রাশিয়ান ফ্লু’।
স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি কিন্তু স্পেনে ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্পেন কোনো দেশের পক্ষে যুদ্ধে জড়ায়নি। তাদের এই নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণেই অন্যায়ভাবে তাদের নাম জুড়িয়ে দেওয়া হয় ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের সঙ্গে। আরেকটু খোলসা করে বলা যাক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে দেশগুলো অংশ নিয়েছিল তাদের সরকার সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। এসব দেশের তালিকায় ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রও। সেসব দেশের সংবাদমাধ্যম সরকারের অনুমতি ব্যতীত সংবেদনশীল কোনো খবর প্রকাশ করতে পারতো না। স্পেন যেহেতু নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল তাই তাদের সংবাদ মাধ্যমের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার প্রয়োজন ছিল না।
রাজা ত্রয়োদশ আলফানসো এবং তার মন্ত্রীসভার বেশ কয়েকজন সদস্য যখন এই বিশেষ ভাইরাসে সংক্রমিত হন, তখন সেই খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম। তাদের কারণেই ইউরোপে এই ভাইরাসের কথা প্রথম শোনা যায়।
যদিও এর আগেই ভাইরাসটি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ব্রিটেন, ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার চায়নি তাদের জনগণ এমন রোগের কথা জানতে পারুক। বরং, নিজেদের যুদ্ধের যৌক্তিকতাকে ধরে রাখতে তারা এই খবর গোপন করেছিল।
স্পেনের সংবাদপত্র যখন তাদের রাজার অসুস্থ হওয়ার খবর প্রকাশ করে, তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নেতারা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্পেনের নাম প্রচার করে। সেখান থেকেই ভাইরাসটির হয়ে যায় 'স্প্যানিশ ফ্লু'।
স্প্যানিশরা জানতেন তারা এই ভাইরাসের জন্য দায়ী নন। মিথ্যা অপবাদ ঘুচাতে অভিনব এক উপায় বের করেন তারা। রাজধানী মাদ্রিদের জারজুয়েলা থিয়েটারে ডন জুয়ানের একটি মিথ মঞ্চায়নের সময় 'দ্য সোলজার অব নেপলস' নামে একটি গান খুবই জনপ্রিয় হয়। গানটি ভাইরাসের মতই দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্প্যানিশরা ভাইরাসটির নাম দেন 'সোলজার অব নেপলস'। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। শত বছর পরে এখনও মানুষ মহামারী সেই ভাইরাসকে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামেই চেনে।
স্প্যানিশ ফ্লুতে সবচেয়ে বেশি জীবনহানি ঘটেছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। এখানকার দেশগুলোতে মৃত্যুর হার ইউরোপের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি ছিল। অথচ ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই হার ছিল সর্বনিম্ন।
স্প্যানিশ ফ্লুতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছিল এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। এখানকার দেশগুলোতে মৃত্যুর হার ছিল ইউরোপের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি। এই ফ্লুর আক্রমণে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি মারা যান। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুহার ছিল তুলনামূলক কম।
ভাগ্যবান ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী
১৯১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের কথা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে। তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডেভিড লয়েড জর্জ। মিত্রশক্তির সাফল্যে তিনি তখন বেশ উল্লসিত। দেশে অবস্থানরত সৈন্য ও যুদ্ধোপকরণ তৈরির নারী কর্মীদের সাময়িক ছুটি দিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে ম্যানচেস্টার সফরে যান লয়েড জর্জ। পুরো যাত্রাপথ উল্লাসে কাটে তাদের।
সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জ্বর ও গলাব্যথা শুরু হয়। তিনি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েন। টানা ১০ দিনে তাকে ম্যানচেস্টারের টাউন হলে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিল। তিনি এত বেশি অসুস্থ ছিলেন যে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিস্থিতিও ছিল না। টাউন হলে তাকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।
লয়েড জর্জের বয়স তখন ৫৫ বছর। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ধারণা করেছিল যে তার এই অসুস্থতার পেছন জার্মানির হাত রয়েছে। তাকে মেরে ফেলতে কোনো বিষ হয়ত প্রয়োগ করা হয়েছিল। চিকিৎসকরা অবশ্য সেই দাবি নাকচ করেন। পরবর্তী সময়ে জানা যায় তিনি স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ভাগ্যবান ছিলেন। আর তাই সে যাত্রায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। অবশ্য তার ভাগ্য ভালো হলেও, ব্রিটেনের প্রায় আড়াই লাখ মানুষের ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি। তারা মৃত্যুবরণ করেন স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাওয়া মোট ব্রিটিশ সেনা ও সাধারণ নাগরিকের চেয়েও এই সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।
জীবনহানির ভয়ঙ্কর গতি
এত দ্রুত এর আগে বা পরে কখনোই কোনো ফ্লু সংক্রমিত হয়নি। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছিল ভাবনার চেয়েও দ্রুত গতিতে। যুক্তরাষ্ট্রে এমনও হয়েছে যে একজন ব্যক্তি সকালে ঘুম থেকে উঠে অসুস্থতা বোধ করছেন। এরপর নাস্তা শেষ করে অফিসে যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়েছে।
এ রোগের লক্ষণগুলো ছিল বেশ ভয়ঙ্কর। শুরুতে জ্বর হতো, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। দেহে অক্সিজেনের অভাবে পুরো শরীর নীলবর্ণ ধারণ করত। এরপর শ্বাসযন্ত্রে রক্তে জমে শুরু হতো বমি সেসঙ্গে নাক দিয়ে রক্ত ঝরা। অনেকেই রক্তে গড়াগড়ি খেতে খেতেই মারা যেতেন।
স্প্যানিশ ফ্লু সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের ১৩ সপ্তাহে পুরো পৃথিবীজুড়ে ভয়াবহ তাণ্ডব চালায় এই ভাইরাস। কেবল অক্টোবর মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায় প্রায় ২ লাখ মানুষ। অথচ, পুরো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মারা গিয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজারের কিছু বেশি।
১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে শেষবারের মতো আঘাত হানে স্প্যানিশ ফ্লু। মাসের প্রথমভাগে এর গতি কম ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ভাগে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। মাসের শেষ ধাপে ভাইরাসটির ক্ষিপ্রতা অনেকটাই কমে যায়। তারপরও পুরো বছর ভাইরাসটি তার ধ্বংস লীলা চালায়। ১৯২০ সালের মার্চে বিদায় নেওয়ার আগে স্প্যানিশ ফ্লু ব্রিটেনের ২ লাখ ৫০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রের ৬ লাখ ৭৫ হাজার, জাপানের ৪ লাখ এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ সামোয়ার এক-পঞ্চমাংশ মানুষের জীবন নেয়।
সে সময়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশগুলো যদি এই ফ্লুর খবর শুরুতে গোপন না করত, সংক্রমণের শুরুতেই যদি প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিত তবে মৃতের মিছিল হয়ত একটু হলেও ছোট হতে পারতো। আজও মানুষ আতঙ্ক নিয়ে স্মরণ করে শতবর্ষ আগের মহামারী ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ কে যা কেড়ে নিয়েছিল ১০ কোটি মানুষের প্রাণ।
তথ্যসূত্র- দ্য গার্ডিয়ান, হিস্টোরি এক্সট্রা, হিস্টোরিডটকম
ওডি/এনএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড