অনুপ চক্রবর্তী
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনের সব চেয়ে গৌরবের অধ্যায়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনেন বীর বাঙালিরা। ইংরেজ বেনিয়াদের শৃঙ্খল এবং পাকিস্তানের শোষণের কারাগার থেকে মুক্ত হয় আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি; পৃথিবীর মানচিত্রে উদিত হয় লাল-সবুজের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র-বাংলাদেশ।
মুক্তির উদ্ভাসিত আনন্দে আমরা ভেসে যাই বিজয় দিবসে। কিন্তু প্রতিবছর এই বিজয় উৎসবের প্রারম্ভে এক সীমাহীন বেদনার স্মৃতি সামনে চলে আসে, মনে পড়ে যায় জাতিগত এক অপূরণীয় ক্ষতির কথা। ক্ষোভে- ঘৃণায় মন থেকে অভিশাপ উচ্চারিত হয় পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের জন্য।
১৯৭১ সনের ডিসেম্বরে বাঙালির সীমাহীন ত্যাগ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত বিজয়ে পরিণত হবে তার প্রাক্কালে ইতিহাসের এক ঘৃণ্যতম আঘাত হেনে ছিলো দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা। সে আঘাত ছিলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপর। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে জাতিগত ভাবে একটি দেশকে মেধাশূণ্য করার এক নীল নকশার বাস্তবায়ন করেছিল নিকৃষ্ট পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী।
তারা সুপরিকল্পিত ভাবে বেছেবেছে হত্যা করেছিলো এদেশের চিন্তাশীল শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকদের। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মেধায়-মননে শূন্য হয়ে পড়ে, যেনো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে এই ছিল ঘাতকদের দূরপ্রসারী লক্ষ্য। আর তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিলো আসন্ন পরাজয়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যা নিঃসন্দেহে কাপুরুষতা। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর এক ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। বুদ্ধিজীবীদের লাশ জুড়ে ছিল নিষ্ঠুর সব আঘাতের চিহ্ন। হাত-পা বাঁধা, কারো কারো চোখ উপড়ে ফেলানো, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ক্ষত চিহ্ন এতটাই ভয়ংকর ছিল যে কারণে অনেকেই তাঁদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। অসভ্য পাকিস্তানীদের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা আর হিংসার বলি হয়েছিলেন এদেশের সূর্য সন্তানেরা।
তবে এ কাজে তাদের সহায়তা করেছিল বাঙালি জাতির কলঙ্ক পাকিস্তানী দোসররা, যারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কখনোই চায়নি। ইতিহাসের এই ঘৃণিত কীটেরাই হানাদারদেরকে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান জানিয়ে, তাদের তুলে এনে এবং হত্যা করে সহায়তা করেছে। ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির যে ক্ষতি করেছে বর্বর পাকিস্তানী এবং রাজাকার-আলবদর তা আর কোনদিন পূরণ হবে না। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। তাঁদের মেধা-মনন এবং সৃজনশীলতায় বাংলাদেশ এক অনন্য বাংলাদেশ হয়ে উঠত। পাকিস্তানীরা শোষক এবং হত্যাকারী ছিল যাদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা যুদ্ধ করছিল। কিন্তু এদেশীয় যেসব দালালেরা তাদের হীন চক্রান্তের সঙ্গী হয়েছিল তাদের জন্য চিরদিন বাঙালি মাত্রই ঘৃণা আর ক্ষোভ নিয়ে বাঁচবে।
বাংলাদেশ এখন অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ পেয়েছে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি। বিভিন্ন ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক অনেক স্বীকৃতি আসছে বাংলাদেশে। কিন্তু যদি গভীরভাবে চিন্তা করা হয় তাহলে দেখা যাবে জাতিগত ভাবে অনেক কিছুতেই বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষে দেশ ভরে গিয়েছে, এমন এক ধরনের বিকৃত মস্তিষ্ক শ্রেণি তৈরি হয়েছে যারা যেকোনো বিষয়কেই রাজনীতি ও ধর্মের সাথে সংযুক্ত করে একটা ব্যাখ্যা তৈরি করিয়ে আঘাত করবেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু নজর রাখলেই এরকম হাজার হাজার বিষয় সামনে চলে আসে।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে একাত্তরের অনেক চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী পুনর্বাসিত হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সময়ের প্রেক্ষিতে তারা তাদের পাকিস্তান ঘোরানোর মতাদর্শের বিষবৃক্ষ বপন করে দিয়ে গেছে অসংখ্য যুবকের মধ্যে। বিজয় দিবসের মাত্র দুই দিন আগে যদি বাঙালিদের উপর এই ভয়াল থাবা নেমে না আসত তাহলে আমাদের ইতিহাস আরো ভিন্নতর হতে পারত। সাম্প্রদায়িকতার যে পারমানবিক বোমা বক্ষে ধারণ করে বাংলাদেশ এগোচ্ছে এমন পরিস্থিতি হয়ত তৈরি হত না। এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুযোগও হয়ত কেউ পেত না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, হয়ত বাংলাদেশ হত সেই বাংলাদেশই।
আজকের বাংলাদেশে দুই ধরনের মতাদর্শিক মানুষ দেখা যায়। একটি পক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্নের দেশ বিনির্মাণে সংগ্রাম করেছেন, শহীদ হয়েছেন সেই মতাদর্শ ধারণ করেন আর অপর একটি পক্ষ লালন করে ভিন্নতর আদর্শ যা এদেশের সাংবিধানিক মূল স্তম্ভের সাথে সাংঘর্ষিক। কোন আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে দরকার আদর্শবান শিক্ষক-শিক্ষাবিদ, কোন বিরূপ আদর্শকে রুখতে দরকার সংস্কৃতির চর্চা, দরকার বই, দরকার গান এবং চলচ্চিত্রের। এই অভাবগুলো এ জাতি আজও পূরণ করতে পারে নাই। দিন যত যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, অসমতা, আইনের শাসনের অভাব, ঘুষ-দুর্নীতি এসব শুধু বেড়েই চলেছে। কমছে শুধু দেশপ্রেমিকের সংখ্যা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্তরে লালন করা মানুষের সংখ্যা। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ হওয়া এ বাঙালি জাতির মেধাবী সন্তানেরা স্বাধীন বাংলাদেশে বিচরণের সুযোগ পেলে হয়ত এরকম অনেক কিছুই হত না। সেসব নিয়ে এখন শুধু এক বুক আক্ষেপে ঘুমরে কেঁদে ওঠা ছাড়া আর কোন উপায় আপাতত দৃষ্টিতে নেই।
তাই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতির এই সব নিভিয়ে দেওয়া আলোদের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে সাথে মনে পড়ে যায় এই নরপশু কাপুরুষদের কথাও; ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা নিয়ে প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির হৃদয় থেকে অভিশাপ উচ্চারিত হয় বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের জন্য।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড