মো. সাইফুল ইসলাম
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি সাজসজ্জার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ নিজেকে পরিষ্কার রাখার প্রয়োজনে প্রাচীনকাল থেকেই অনেক সচেতন ছিলেন। তবে আজকের দিনের মতো বাথটাব ছিল না। ছিল না কোনো শাওয়ার। তাই তারা বাড়ি থেকে দূরের কোনো পাহাড়ি ঝরনায় গিয়ে গোসল করত। সেগুলোই ছিল মানুষের ব্যবহৃত প্রথম শাওয়ার।
শাওয়ারের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস খুবই মজার। সেই প্রাচীন মিশরে যার সূচনা হয়েছিল সেই শাওয়ার আজকাল নানাভাবে উন্নত হয়ে প্রায় প্রতিটি শহরের গোসলখানায় স্থান করে নিয়েছে। এই যেমন আজ আমরা গরম পানির যে সব শাওয়ার ব্যবহার করি এক সময় তা এত আধুনিক ছিল না। প্রাচীনকালের শাওয়ারই পরিবর্তিত হতে হতে আজকের আধুনিক শাওয়ার তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো এর আরও পরিবর্তন আসবে।
পাহাড়ি ঝরনায় গোসল করতে গেলেও মানুষজন গোপনীয়তা রক্ষায় সচেতন ছিলেন। তবে সেই গোপনীয়তা রক্ষা কঠিনই ছিল। বিশেষ করে মেয়েদের গোসলের সময় তাদের সচেতনতা আরও বেশি ছিল। তাই মানুষ নিজেদের ঘরেই কৃত্রিম শাওয়ারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সেই উপলব্ধি থেকেই প্রাচীন মিশরীয় ও মেসোপটেমিয়রা তাদের বাড়িতেই শাওয়ার তৈরি করে।
শাওয়ার তৈরির পরপরই তাদের গোসল করা অনেক সহজতর হয়েছিল। তবে মিশরে যে ধরনের শাওয়ার ব্যবহার করা হতো তা মূলত ধনী পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করত। কারণ তখনকার শাওয়ারে এক বা একাধিক দাসী কলসি দিয়ে মাথার ওপর পানি ঢালত। বিভিন্ন ভবন ও প্রার্থনালয়ের দেওয়ালে প্রাপ্ত চিত্রকর্ম থেকে রাণী ও রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের মাথায় দাসীদের পানি ঢালার প্রমাণ মেলে।
থেব, এল লাহুন ও আমারনা শহরের ধনী পরিবারের বাড়িগুলো খনন করলে সেখানে পানি গড়িয়ে যাওয়ার জন্য ঢালু মেঝে পাওয়া যায়। তবে পানি নিষ্কাশনের জন্য ভালো ব্যবস্থার প্রমাণ মেলেনি। এদের দাসীরা পানি ঠেলে কিংবা পাত্রে ভরিয়ে বাইরে ফেলে আসত।
মিশরীয়দের পর শাওয়ার ব্যবস্থা উন্নতকরণ করায় অবদান রেখেছিল গ্রিকরা। এরা পানি নিষ্কাশনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করে। এরাই প্রথম সীসার পাইপ ব্যবহার করে পানি নিষ্কাশন করে। এছাড়াও ছাদ থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি পতন ঘটিয়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে গোসল করার পদ্ধতি তৈরি করে।
শাওয়ার ব্যবহারে রোমানদের শ্রেষ্ঠ বলা যায়। তারা নিজেদের এলাকায় এমনকি কোনো এলাকা জয়ের পর সেই এলাকাতেও শাওয়ার তৈরি করত। রোমানদের শাওয়ার এখনও ইউরোপ জুড়ে দেখা মেলে। রোমানরা তৎকালে ভবনের পাশে ময়লা পানি প্রবাহের জন্য নর্দমাও তৈরি করেছিল।
বর্তমান সময়ের শাওয়ারগুলোর প্যাটেন্ট বা মালিকানা স্বত্ব নিয়েছেন লন্ডনের চুলা মিস্ত্রি উইলিয়াম ফিথাম। ফিথামের আবিষ্কারের পর নিয়ম অনুযায়ী গোসলকারী বেসিনের ওপর দাঁড়াত। এরপর হস্তচালিত পাম্পের মাধ্যমে মাথার ওপরের ট্যাংকে পানি তুলত। এরপর একটি চেইন টানলেই ঝরঝর করে পানি গোসলকারীর মাথার ওপর পড়ত।
তবে ফিথামের পদ্ধতিতে একই পানি বারবার ব্যবহার করা হতো। যেহেতু এতে পানি ময়লা হতো তাই ফিথামের শাওয়ার অভিজাত পরিবার তেমন পছন্দ করেনি। এছাড়াও অভিজাত পরিবার গরম পানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কিন্তু একই পানি বারবার ব্যবহার করলে পানি দ্রুত শীতল হয়ে যেত।
গরম পানিতে গোসল করার সহজসাধ্য উপায় ১৮৬৮ সালে ইংরেজ চিত্রশিল্পী বেঞ্জামিন মাওঘান আবিষ্কার করেন। তিনি গ্যাস বার্নার ব্যবহার করে প্রথম পানির হিটার তৈরি করেন। তবে মাওঘানের আবিষ্কারে একটু ঝামেলা ছিল। মাওঘানের যন্ত্রে বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় মাঝেমাঝে বিস্ফোরণ ঘটত।
মাওঘানের যন্ত্রটি আধুনিকায়ন করেছিলেন নরওয়ের যন্ত্র প্রকৌশলী এডুইন রুড। ১৮৮৯ সালে তিনিই সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় গ্যাস চালিত পানির হিটার তৈরি করেন। যা গরম পানির শাওয়ারের নবযুগের সূচনা করে।
তবে শাওয়ারের উন্নতি কারও একক পদ্ধতির দ্বারা হয়নি। রোমান, গ্রিকদের পদ্ধতিকেও সমন্বয় করা হয়। যেমন পূর্বের আবিষ্কৃত পাইপ পুনরায় ব্যবহার করার পদ্ধতি তৈরি করার ফলে একই পানি বারবার ব্যবহার করার দরকার হয় না।
শাওয়ারের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের অবদানকেও স্মরণ করা যায়। তারাই ১৯২০ সালে ধনী পরিবার ছাড়াও সবার মাঝেই শাওয়ার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৬০ সালের দিকে যুক্তরাজ্যেও শাওয়ার বিস্তার লাভ করতে থাকে। বৈদ্যুতিক গরম পানির শাওয়ার বাজারে আসার পর তারা দ্রুত শাওয়ার ব্যবহার করতে থাকে। তবে বর্তমান কালে আমরা যে বিভিন্ন ধরনের শাওয়ার দেখি সেগুলো বাজারে আসতে শুরু করে ১৯৮০ সাল থেকে।
বর্তমানে শহরাঞ্চল এমনকি গ্রামাঞ্চলেও নদ-নদী, পুকুরে পানির অভাব থাকায় ও সহজতর গোসলের জন্য শাওয়ার ব্যবহার খুবই জরুরি। আবার শীতকালে গোসলের সময় গরম পানির প্রয়োজনীয়তা কে না অনুভব করে? সেই গরম পানি যদি পাত্র দ্বারা না ঢেলে শাওয়ার থেকে পাওয়া যায়, তা নিঃসন্দেহে আমাদের গোসলকে আরামদায়ক তোলে। পাশাপাশি শীতকালে যাদের গোসলের প্রতি অনীহা রয়েছে তাদেরও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি হয় শাওয়ারে। তাই গোসলের পূর্বে শাওয়ারের মজার ইতিহাস জানা থাকলে মন্দ হয় কী?
তথ্যসূত্র : শাওয়ার ডক, অ্যামিউজিং প্লানেট ডট কম।
ওডি/এনএম
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড