• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অত্যাচারী সম্রাট ক্যালিগুলার ধ্বংস হওয়া জাহাজ

  মোঃ সাইফুল ইসলাম

২৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:০০
ক্যালিগুলার জাহাজ
ক্যালিগুলার জাহাজ; (ছবি- ইন্টারনেট)

শত শত বছর ধরে মধ্যযুগের মৎস্য শিকারী বা জেলেরা যারা নেমি হ্রদে মাছ ধরতে যেতেন একটা গোপন তথ্য জানতেন। জেলেরা সেই গোপন তথ্য প্রচার করার চেষ্টাও করতেন। তারা বলতেন নেমি হ্রদের তলদেশে বিশালাকার জাহাজের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। আর সেই জাহাজ ছিল রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার জাহাজ।

নেমি হ্রদ হচ্ছে রোম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি বৃত্তাকার হ্রদ। হ্রদটি মাত্র দেড় বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এছাড়াও হ্রদটির সাথে কোনো নদী বা সাগরের সংযোগ নেই। হ্রদের আকার ছোট ও ভিন্ন কোনো উৎসের পানির সাথে সংযোগ না থাকায় কেউই জেলেদের কথা বিশ্বাস করত না।

জেলেদের কথাকে কেউ বিশ্বাস না করলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের তথ্য লোকের মুখে মুখে প্রচলিত হয়েছিল। পনের শতকেও সকলের ধারণা ছিল শান্ত-স্থির জলের তলদেশে জাহাজ থাকার সম্ভাবনাই নাই। কিন্তু একদিন ঘটনাক্রমে রোমের অনুসন্ধানকারীর কাছে প্রাচীন কিছু হস্তনির্মিত নিদর্শন ধরা পড়ে। তদন্তকালে জানতে পারেন, নেমি হ্রদের তলদেশে জেলেরা হুক লাগিয়ে এসব নিদর্শন তুলে নিয়ে এসেছে।

সব তথ্যই গুজব হয় না। আবার সবাই গুজবে কানও দেয় না। অনেকেই গুজবে কান দেওয়ার পূর্বে সত্যতা যাচাই করে। ১৪৪৬ সালে রোমান পোপ পঞ্চম মার্টিনের ভাতিজা প্রোসপারো কলোনা ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে উন্মুখ হয়েছিলেন। ঘটনার রহস্য উন্মোচনে তিনি তার দলসহ হ্রদে যাত্রা করেছিলেন। তারা দড়ির মাথায় হুক বেঁধে ৬০ ফুট গভীর পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই গভীরতায় কিছু ভারী কাঠের টুকরা, ভেঙে যাওয়া তক্তা ব্যতীত আর কিছুই সংগ্রহ করতে পারেননি। তবে হ্রদের তলদেশে জাহাজ থাকার বিষয়টি কলোনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৫৩৫ সালে ইতালির উদ্ভাবক গুগলিয়েনমো দি লোরেনা ও তার সহকর্মী ফ্রান্সেসকো দি মারসি সেই হ্রদের কাছে যান। তবে তারা সেখানে চমৎকার একটি যন্ত্র নিয়ে যান। যন্ত্রটি ছিল ‘ডাইভিং বেল’। ঘণ্টার মতো দেখতে যন্ত্রটির ভেতর বাতাস আটকানোর সুবিধা ছিল। সেই যন্ত্র দিয়ে ডুবুরিরা গভীর পানির তলদেশে যেতে সক্ষম হন।

লোরেনার দল হ্রদের তলদেশে পৌঁছে অবাক হয়ে যান। তারা সেখানে সত্যিই বিশালাকার জাহাজ দেখতে পান। কিন্তু কর্দমাক্ত হ্রদের তলদেশ থেকে তেমন কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। তবে তারা মার্বেল পাথর ও ব্রোঞ্জ নির্মিত বেশকিছু মূর্তি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অনেকেই অনেকভাবে চেষ্টা করে পুরোপুরি জাহাজ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলেও সফল হয়েছিলেন বেনিটো মুসোলিনি। ইতালির শাসনভার তার হাতে চলে যাওয়ার পরপরই জাহাজ উদ্ধারে মনোনিবেশ করেছিলেন। মুসোলিনি উত্তরাধিকারসূত্রে অর্থকড়ি পাওয়ার জন্য অন্ধ ছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তাছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো বিষয়বস্তুর সাথে তার নিজের নামটাও জুড়িয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন।

তাই মুসোলিনি ১৯২৯ সালে হ্রদের পানি অন্যত্র নিষ্কাশন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রকৌশলীরা তার নির্দেশ পাওয়ার পর পানি নিষ্কাশন করেন। পানি নিষ্কাশনের পর প্রকৌশলীরা অবাক হয়ে দেখেন সেখানে দুটি জাহাজ রয়েছে। তারা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত খননের মাধ্যমে জাহাজ দুটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বড় জাহাজটির দৈর্ঘ্য ছিল ২৪০ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৭৯ ফুট।

হ্রদের তলদেশে প্রাপ্ত দুটি জাহাজে হয়তো মূল্যবান কিছুই পাওয়া যাবে না। তবুও কৌতূহলী মানুষ তা উদ্ধারের জন্য কঠোর শ্রম দিয়েছিল। কারণ কিছু না থাকলেও সেই জাহাজে লুকায়িত ছিল দুহাজার বছরের পুরোনো রোম সম্রাট ক্যালিগুলার ইতিহাস।

জাহাজ দুটি উদ্ধারের পরপরই পুনরায় আলোচনায় উঠে আসে ক্যালিগুলার নাম। ক্যালিগুলা ১২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ৩৭-৪১ খ্রিস্টাব্দে রোমের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। শাসক হিসেবে খুবই উন্মাদ, অত্যাচারী, যৌন সুখলাভের জন্য মানসিক বিকারগ্রস্ত, আনন্দ-উল্লাসে মত্ত ছিলেন ক্যালিগুলা।

নিজেকে জীবন্ত ঈশ্বর হিসেবে দাইব করেছিলেন এই উন্মাদ শাসক। বহু নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করেছিলেন। এছাড়াও বাধ্যতামূলকভাবে অনেক নারীকে পতিতালয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। জাহাজে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপকরণ থেকে ধারণা করা হয় ক্যালিগুলা অশ্লীল ও কামুক পিপাসা নিবৃত্ত করার জন্যই তৈরি করেছিলেন সেগুলো। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন সেনানায়ক ও সিনেটরের স্ত্রীর সাথেও তার সম্পর্ক ছিল। এছাড়াও জনশ্রুতি আছে, নিজের বোন দ্রুসিলার সাথেও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিলেন ক্যালিগুলা।

জানা যায়, এমন সব কাজ কর্মের জন্যই পতন হয়েছিল ক্যালিগুলার। ৪১ সালের ২৪ জানুয়ারি নিজের দেহরক্ষী ক্যালিগুলাকে ছুরিকাঘাত করে। সেদিন ৩০ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল তাকে। ক্যালিগুলার নাম চিরতরে মুছে ফেলতে তার স্ত্রী ও সন্তানদেরও হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়াও তার নির্মিত মন্দিরও ধ্বংস করা হয়েছিল।

ক্যালিগুলার মন্দির ধ্বংস করা হলেও জাহাজগুলো কিন্তু কেউ ধ্বংস করেনি। জাহাজগুলো নিজে থেকেই পানির নিচে তলিয়ে যায়। সেই সাথে তলিয়ে যায় ক্যালিগুলার ইতিহাস। কিন্তু তলিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে তুলে আনার পর কী হয়েছিল জাহাজ দুটির?

মুসোলিনি জাহাজ দুটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছিলেন। জাহাজে প্রাপ্ত মূল্যবান উপকরণও জাদুঘরে সংরক্ষণ করেছিলেন। তবে বেশিদিন ছিল না জাহাজ দুটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪৪ সালের ৩১ মে আমেরিকান সৈন্যদের আক্রমণে মাটির সাথে মিশে যায় জাহাজ দুটি। শুধু কিছু ব্রোঞ্জ নির্মিত উপকরণ ও যা কিছু যুদ্ধের আগেই সেখান থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল সেগুলোই টিকে থাকে।

আজ ইতালিতে ক্যালিগুলার পুরো জাহাজ নেই। কিন্তু কিছু উপকরণ এখনো টিকে আছে। ক্যালিগুলার দুঃশাসন ও অত্যাচারিতদের যে পতন অনিবার্য তা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই কিছু উপকরণ হয়তো যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে।

তথ্যসূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট, ডিসকভার ম্যাগাজিন ডট কম

ওডি/এনএম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড