• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গেস্টাপো : যে গোয়েন্দা বাহিনীকে আজও ঘৃণা করে মানুষ

  মোঃ সাইফুল ইসলাম

২০ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৩১
গেস্টাপো
ছবি : সংগৃহীত

গেস্টাপো নামটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। এটি ছিল হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনী। এই পুলিশ বাহিনী তাদের কর্মকাণ্ডের ভুল-ভ্রান্তি ও বৈধতা সম্পর্কে কারও কাছে জবাবদিহি করত না। নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার লোকজনের ওপর কিংবা বিরোধী মতের ওপর দমন-নিপীড়নে ব্যস্ত একটি বাহিনী ছিল গেস্টাপো।

অ্যাডলফ হিটলার ১৯৩৪ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হন। চ্যান্সেলর হওয়ার পরপরই জার্মানির অবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের পর হারম্যান গোয়েরিংকে প্রুশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রুশিয়া ছিল ইউরোপের ইতিহাস ও শক্তির একটি বড় উৎস। এই প্রুশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোয়েরিংকেই গেস্টাপোর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গোয়েরিং ১৯৩৪ সালের ২৬ এপ্রিল গেস্টাপো প্রতিষ্ঠা করেন।

গেস্টাপো নামটি Geheime Staatspolizei- এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই জার্মান নামের অর্থ হচ্ছে ‘গোপন পুলিশ বাহিনী’। কোনো এক পোস্ট অফিস কর্মকর্তা স্ট্যাম্প ছাপাতে গিয়ে দেখেন স্ট্যাম্পের তুলনায় নামটি অনেক বড় হয়। তাই তিনি এটিকে সংক্ষেপ করে লিখেন গেস্টাপো (Ge-sta-po)।

যাই হোক, গেস্টাপো গঠনের জন্য গোয়েরিং প্রুশিয়ান পুলিশ থেকে রাজনৈতিকভাবে গুপ্তচরবৃত্তিতে পারদর্শী এমন সৈন্যদের আলাদা করেন। এরপর গেস্টাপোতে এসএস বা স্যুৎসাফল বাহিনীর প্রধান, নাৎসির আধাসামরিক বাহিনী ও বাভারিয়ার সৈন্যদল অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসে হিমলারকে গোয়েরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও তিনি স্যুৎসাফল বাহিনীরও প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৩৬ সালের ১৭ জুন হিমলার গেস্টাপোর নিয়ন্ত্রণ নেন। এছাড়াও তখন জার্মানির সাধারণ পুলিশ বাহিনী, রাজনৈতিক পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনীসহ সমস্ত পুলিশ তার অধীনে চলে যায়।

গেস্টাপোর কর্মকাণ্ডের কথা শুনলে আজও জার্মানির লোকজন তথা ইহুদীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়। গেস্টাপো তাদের কাজের জন্য সভ্য সমাজের কোনো প্রকার বাঁধাকে আমলে নিত না। এরা প্রতিরক্ষামূলক ধরপাকড়ের নামে যখন যাকে খুশি ধরে নিয়ে যেত। হাজার হাজার বামপন্থি, বুদ্ধিজীবী, ইহুদী, ব্যবসায়িক সংগঠনের শ্রমিক, রাজনৈতিক পাদ্রীবর্গ, সমকামী ব্যক্তিবর্গ গেস্টাপো কর্তৃক আটক হওয়ার পর অদৃশ্য হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দী হওয়া জনগণও এদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।

মূলত নাৎসি শাসনের জন্য যাকেই হুমকিস্বরূপ মনে হতো তাকেই গেস্টাপো ধরে নিয়ে গিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন করত। এদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মোক্ষম অস্ত্র ছিল ভীতি প্রদর্শন। তারা এমন ধরনের ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করত যাতে কেউ ভয়ে মুখ খুলতে না পারে।

আশপাশেই গোপনে গেস্টাপোর সৈন্যরা চলাফেরা করত। গোপনে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করত। এভাবে যাকেই নাৎসি নিয়মনীতির বিপক্ষে কথা বলতে শোনা যেত তাকেই ধরে নিয়ে যেত। আর একবার ধরা পড়লে ভাগ্যে জুটত বর্বরোচিত নির্যাতন।

বরফ শীতল পানিতে চুবানো, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এমনকি যৌনাঙ্গে তারের সংযোগ দিয়ে বৈদ্যুতিক শক, পুরুষের অণ্ডকোষ পিষে ফেলা, হাতের কব্জি বেঁধে ঝুলানো, লাঠি ও চামড়ার চাবুক দিয়ে পেটানো, ম্যাচ বা তাতাল দিয়ে শরীরে ছ্যাঁক দেওয়া ও পোড়ানোর মতো ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালাত। তাই ভয়ে কেউ হাসি-তামাশায়ও নাৎসির মতের বাইরে কথা বলার সাহস পেত না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ভয়ঙ্কর বাহিনী নরওয়ে ও ফ্রান্সে খুবই সক্রিয় ছিল। তারা যুদ্ধের সময়ের পলায়নরত ইহুদীদের খুঁজে বের করত। ইহুদীদের বলপূর্বক কাজ করাত। কাজ করালেও খাবার তেমন দিত না। আর নির্যাতনতো ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। গেস্টাপো ১৯৪১ সালে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার ইহুদীকে গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করে হত্যা করে।

হিটলার যাকে চান না তাকেই নির্মূল করার ক্ষমতা দিয়েছিল গেস্টাপোকে। তাই গেস্টাপোও নিজেরাই হয়তো যখন তখন আইন তৈরি করত। যে আইন নিয়ে কথা বলারও কেউ ছিল না। এভাবে নিজস্ব আইন ও ক্ষমতার বলে ৬০ লাখ ইহুদী নিধন করেছিল।

গেস্টাপোর অন্যতম লক্ষ্য ছিল মাত্র তের বছর বয়সী এক কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক। এই কিশোরীর রচিত ডায়েরি যা বর্তমানে ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ নামে প্রকাশিত ব্যাপক জনপ্রিয় একটি বই হিসেবে বাজারে পাওয়া যায়। সেই ডায়েরিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাতে গেস্টাপোর অনেক কু-কীর্তির কথা উঠে আসে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসের পাশাপাশি গেস্টাপোরও পতন হয়। গেস্টাপোর অনেক ক্ষমতাশীল সৈনিক পালিয়ে যায় ও অনেকেই সাধারণ মানুষের সাথে মিশে নতুন জীবন শুরু করে। অনেককেই আবার বিচারের আওতায়ও আনা হয়েছিল। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল গেস্টাপোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়।

বিশ্বে এখনও অনেক গোয়েন্দা সংস্থা আছে। তবে নৃশংসতার দিক দিয়ে গেস্টাপোর মতো কোনো গোয়েন্দা সংস্থার নাম হয়তো আর কেউ শুনবে না। যারা অত্যাচার করে তাদের একদিন পতন হবেই। গেস্টাপোরও পতন হয়েছে। কিন্তু মানব মনের ভেতর যে ঘৃণা, তার হয়তো কোনোদিন পতন হবে না।

তথ্যসূত্র- থটকো, জেরুজালেম পোস্ট, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি।

ওডি/এনএম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড