• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ব্রয়লার মুরগির দ্রুত বৃদ্ধির রহস্য কী?

  ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম

০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:২৭
ব্রয়লার মুরগি
ছবি : সংগৃহীত

পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশের একটি অন্যতম সম্ভাবণাময় খাত। এই খাতে বেকার নারী-পুরুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশ নারী এই শিল্পের সাথে জড়িত হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই শিল্পের মাধ্যমে।

পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম একটি প্রজাতি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। এই মুরগি নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের মাঝে কিছু বিভ্রান্ত্রি ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। সাধারণত অধিকাংশ লোকই একটি সাধারণ প্রশ্ন করে থাকে। প্রশ্নটি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি কিভাবে মাত্র ৩০ দিনে ২ কিলোগ্রামের মতো ওজন প্রাপ্ত হয়? এছাড়াও অনেকেই প্রশ্ন করেন ব্রয়লারে হরমোন ব্যবহার করা হয় কেন?

যদি কেউ কেন দিয়ে প্রশ্ন করে তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি মনে করেন ব্রয়লার মুরগিতে হরমোন ব্যবহার করা হয়। আর যদি কেউ প্রশ্ন করেন ব্রয়লার মুরগিতে হরমোন ব্যবহার করা হয় কী? এর অর্থ দাঁড়ায় তিনি জানতে চান ব্রয়লার মুরগিতে আদৌ কোনো হরমোন ব্যবহার করা হয় কিনা?

যা-ই হোক, সকলের সংশয় দূর করার জন্য ব্রয়লার মুরগির দ্রুত বৃদ্ধির রহস্য উন্মোচন করছি।

সাধারণত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনের নানাবিধ শারিরিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত হতে প্রাকৃতিকভাবেই হরমোন উৎপন্ন হয়। এই হরমোনগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ও টেস্টোস্টেরন যেগুলো শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ ও প্রাণীর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক হরমোনগুলো এক সময় শরীর থেকে পরিবেশে নিঃসৃত হয়ে পরিবেশ দূষণ করতে পারে। World Health Organisation (WHO) এর মতে, এই দূষণের ফলে প্রজনন ও এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের সমস্যা হতে পারে। একটু মনোযোগ দিয়ে ভেবে দেখুন। মানুষ ও প্রাণীতে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হওয়া হরমোন পরিবেশে নিঃসৃত হয়ে পরবর্তীতে মানুষের কিছু মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শুধু ব্রয়লার মুরগির দোষ কেন দিবেন?

বাস্তবতা হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্পে তথা ব্রয়লার মুরগির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে কোন প্রকার হরমোন ব্যবহার করা হয় না। সেখানে মুরগিতে হরমোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে এই ব্রয়লার মুরগিতে হরমোনের ব্যবহার আতঙ্কের সূচনা হতে পারে মূলত ক্যাটল ইন্ডাস্ট্রি বা গরু মোটাতাজাকরণ শিল্পের ধারণা থেকে। কারণ মুরগিতে হরমোনের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও গরুর ক্ষেত্রে এটি বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য একটি অনুশীলন। Food and Drug Administration (FDA), ১৯৫৬ সালে গরুর খাদ্যের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে এবং জবাইকৃত প্রাণীর মাংসের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য গরুতে হরমোন ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।

বর্তমানে পাঁচটি হরমোন প্রোজেস্টেরন, টেস্টোস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, জেরানল, ট্রিবোলন অ্যাসিটেড প্রাণীতে ব্যবহার করা যায়। ট্রিবোলন অ্যাসিটেট ও জেরানল সিনথেটিক হরমোন যা যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ অ্যাডমিনিস্টেশন ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পর্যবেক্ষণ করা হয়।

প্রোজেস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন প্রাকৃতিক হরমোন। এগুলো মানুষ ও প্রাণীর স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং প্রজননের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এছাড়াও মানুষ স্টেরয়েড হরমোন গ্রহণ করতে পারে হরমোন থেরাপির জন্য। জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল হিসেবেও স্টেরয়েড হরমোন ব্যবহৃত হয়। ইস্ট্রোজেন জনন, পুনরুৎপাদন এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্য তৈরিতে সহায়তা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ প্রাণীখাদ্যে গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করে না। তারা গরুর কানের চামড়ার নিচে পিলেট আকারের হরমোন ইমপ্লান্ট করে। যা ১০০-২০০ দিনের মধ্যে গরুর শরীরে হরমোন নিঃসরণ করে থাকে। এই হরমোনের কারণে প্রাণীর খাদ্যের কার্যকারিতা বেড়ে যায়, মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে কম দামে মাংস বিক্রি করা যায়।

যা-ই হোক, শুধুমাত্র মাংস উৎপাদরেন জন্য হরমোন ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও মুরগী, দুগ্ধজাত গরু, বাছুর থেকে মাংস উৎপাদন (Veal) ও শুকরের মাংস উৎপাদনে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় না।

তাছাড়াও গবেষণায় দেখা যায়, মুরগিতে গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করলেও অতিরিক্তি বৃদ্ধির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। মুরগিতে হরমোন কাজ না করার অনেকগুলো কারণের মধ্যে ব্রয়লার সম্ভবত বাইরে থেকে প্রদত্ত হরমোন কোনো কাজে ব্যবহার করে না। এছাড়াও হরমোন দুটি রাসায়নিক উপাদানে থাকতে পারে। একটি হচ্ছে স্টেরয়েড ও অপরটি হলো প্রোটিন হরমোন।

স্টেরয়েড হরমোন মুখ দিয়ে খাওয়ানো হলেও তা শরীরে কাজ করতে পারে। যেমন- জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল স্টেরয়েড হরমোন ও তা মুখে দিয়ে খাওয়ানো হয়। প্রোটিন হরমোন পাকস্থলীতে ভেঙে যায় ও অন্ত্র থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে শরীরে কাজের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

এজন্য প্রোটিন হরমোনকে কাজ করাতে চাইলে অবশ্যই ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। এ কারণেই গরুতে গ্রোথ হরমোন গুলো ত্বকের নিচে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় কিন্তু খাওয়ানো হয় না।

গ্রোথ হরমোন হচ্ছে প্রোটিন যেগুলো ইনসুলিনের মতো যা ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ইনসুলিন সাধারণত ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নিতে হয়। মুখে খাওয়ালে তা পাকস্থলীতে ভেঙে যায় ও শরীরে কোনো কাজ করে না।

গবেষকদের মতে, মুরগিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে হরমোন প্রয়োগ করা হলে তা কাজ করতে পারে। কিন্তু ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ব্রয়লার মুরগিতে হরমোন দিনে একাধিকবার দিতে হবে। যা যৌক্তিকভাবে অকার্যকর ও অসম্ভব। বাস্তবে ব্রয়লার মুরগিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে কোনো প্রকার হরমোন ও ওষুধ দেওয়া হয় না। যারা মুরগির খামার নিজের চোখে দেখেছেন তারা এই কথার সত্যতা সহজেই বুঝতে পারবেন। যদি বলেন কিছু জাতীয় পত্রিকাতেও পড়েছেন ব্রয়লার মুরগিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। তবে বলছি সংশ্লিষ্ট পত্রিকার লেখক স্বচোখে ব্রয়লার মুরগির খামার পরিদর্শন করেননি।

আধুনিক ব্রয়লার মুরগি জিনগতভাবে উন্নত গুণ সম্পন্নটিই নির্বাচিত করা হয়। অর্থাৎ জীনগতভাবে মানোন্নয়নের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে দ্রুত বর্ধনশীল ব্রয়লার মুরগি। জীনগত বৈশিষ্ট্যে বর্ধনশীল না হওয়ায় দেশি মুরগিকে ব্রয়লার মুরগির আদলে পালন করলেও তা কিন্তু দ্রুত বৃদ্ধি পাবে না।

যদিও অনেক পত্রিকায় দেশি মুরগির বৃদ্ধির সাথে ব্রয়লার মুরগির বৃদ্ধিকে তুলনা করে বোকামী করা হয়। জিনগত বৈশিষ্ট্য মুরগির শতকরা ২০ ভাগ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর বাকি শতকরা ৮০ ভাগ বৃদ্ধি নির্ভর করে ভাল উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও সুষম খাদ্যের উপর।

সুষম খাদ্য বলতে মুরগির ঠিক কতটুকু পুষ্টির দরকার তা হিসেব করে খাদ্য তৈরি করে প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে কোন জাতের মুরগির কতটুকু পুষ্টির দরকার তা আমাদের জানা আছে।

ভাল উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বলতে যা বোঝায় সেগুলোও আমরা জানি। মুরগির কী ধরনের পরিবেশ প্রয়োজন, যেমন- সঠিক তাপমাত্রা, বায়ুর গুণাবলী, বায়ু চলাচল, আলোক ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা, জায়গার পরিমাপ এসব কিছু মিলে একটি মুরগি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। যা গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করলেই পাওয়া যাবে এমনটা ভাবা যায় না।

তাই প্রাকৃতিকভাবেই ব্রয়লার মুরগি বৃদ্ধি লাভ করে। যেখানে কোনো হরমোন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া মুরগিকে যদি জোরপূর্বক দ্রুত বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয় তবে মুরগির পায়ে সমস্যা হতে পারে, পেটে পানি জমা বা অ্যাসাইটিস হতে পারে এবং মুরগি মারাও যেতে পারে।

তথ্যসূত্র : দি পোল্ট্রি সাইট.কম।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড