• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার ঈদ সংখ্যা-১৯

শাহনুর ও দুটি কাক

  ইমামুল মোত্তাকিন

০৪ জুন ২০১৯, ১৩:১৭
গল্প
ছবি : শাহনুর ও দুটি কাক

এই ঘটনাটির জন্য প্রস্তুত ছিল না শাহনুর। সে বুঝতেও পারেনি কি হতে চলেছিল। অবশ্য তার বোঝার কথাও ছিল না। কতটুকুই বা বয়স ছিল তার তখন! এই বয়সেই তার দাদি-নানিদের বিয়ে হত! তখন তো আর তারা কিছুই বুঝত না। এখন অনেক কিছুই বোঝে এই সময়কার মায়েরা, মেয়েরা। শাহনুরকে নিয়ে ঘটনাটি প্রায় কিংবদন্তীর মত শুনায় গ্রামে। গ্রামের মানুষও পারে বটে! অবশ্য তারা এই বিষয়ে প্রথমে সহজ ,অন্ধ বিশ্বাসে ছিল কিন্তু ক্রমান্বয়ে তারা অবিশ্বাস, বিশ্বাসকে চিনতে পারে। কেউ কেউ ভাবে তাদের পার্থক্য বুঝতে পারার কথা। সে গল্প হবে পরে কোন একদিন। আমরা এখন শাহনুরের গল্প শুনবো। ছোটবেলায় শাহনুরের স্বাস্থ্য ভাল ছিলনা। রোগা, পলকা দড়ির মত, বেঁটে। একান্নবর্তী পরিবারে বাস তার। যেখানে বাবার কথাই সত্য বলে মনে হয় তাদের কাছে,বাবাই সর্বেসর্বা। মায়ের কথা তো দুরগ্রহ হতে ভেসে আসা কোন শব্দ! কিন্তু আমাদের এ গল্পে মায়ের ভূমিকা সবচে বেশি। বরং বাবা অনেকটা ফিকে এখানে। আপনারা গল্পে কাকে প্রধান অনুঘটক বলে দায়ী করবেন, সে দায়ভার আপনাদের হাতে।

আর যেমন আট দশটা পরিবারের মত, তারাও চলেছিল নদীর ঢেউয়ের মতন। খানিকটা মন্থর ,আবার খানিকটা গতিশীল। লোকে বলে থাকে যে, একদিন ভোর বেলায় শাহনুরের মা আম্বিয়া দেখলেন সে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছে না। প্রথমে ভেবেছিল হয়ত দুষ্টুমি করে, খোঁড়া হবার ভান করছে। ইতিপূর্বেও তার এমন অভিনয়ে সবাই মুগ্ধ হয়েছিল। সবাই বাহবা দিয়েছিল। সে যে ইচ্ছে করে খোঁড়া হবার অভিনয় করছে তা না, কারণ তাকে শাপলা ফুল আর বাঁশের চাকা দিয়ে খেলার বয়সে টাকা উপার্জন করতে হত। তার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটায় মুগ্ধ লোকে টাকা ছুড়ে দিয়েছিল। সেদিন তারা পেট ভরে ভাত খেয়েছিল গরম গরম ভাপ উড়া ভাত আর টকটকে ঝাল দেয়া পাঙ্গাশের ঝোল দিয়ে। যখন শাহনুরের মা দেখলো শাহনুর খুঁড়িয়ে হাঁটছে , সে বেশি খেয়াল করেনি। গরীবদের আরও অনেক ব্যাপারে বেশি খেয়াল করা লাগে, ফলে এমন শিশুসুলভ খেলায় মন না দিলেও তাদের চলে। প্রতিদিনের মত আজকেও শাহনুরের মা ভেবেছিল এটা হয়ত শাহনুরের খেলা; হয়ত অভিনয়টাকে ঝালিয়ে নিচ্ছে। মা, আমি হাঁটবার পারিনা। মরণ! আর খোঁড়াইয়া হাঁটতে অইব না। শাহনুর তার মাকে এ কথা সকাল আটটায় বলেছিল আর এখন দশটা। এইযে দুই ঘণ্টা সময় চলে গেল কত কি না ঘটে গেল এ জগতে! পৃথিবী দুই ঘণ্টা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে। হয়ত জল গড়িয়ে বরফ হল। নতুন পাতা গজালো আবার পুরনো পাতা চুপ করে খসে পড়লো। কেউ তার হিসেব নেয়নি। শাহনুর ঠায় উঠোনে বসে আছে এ দুই ঘণ্টা থেকে। সবাই ভাবল, হয়ত সে এমনিতে বসে আছে। পাশের ঘরের সইল্যা সবাইকে বোঝতে পারল যে ,আসলেই শাহনুর হাঁটতে পারছে না। কেউ দেখল ,কেউ দেখল না। কেউ বা দূর থেকে পান মুখে মজা দেখতে লাগলো। বুড়ি শরবতেন্নেসা দেখল ব্যপারটা মোটেই ভাল থেকছে না। বুড়িও ঘাটের মড়া, এ মরে তো ,এই বাঁচে। সে শাহনুরের মত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে আর সবাইকে বলতে লাগলো, মাইয়ার তো হাচাই ঠ্যাং গেছে গা। তখন শাহনুরের মা গরুর ঘাস-বিচুলি কাটতে ছিল। দূর থেকে বুড়িরে বলতে শুরু করলো, মাইয়া পেরাই এমন করে। এত দেখার কিছু নাই। শাহনুর তখন চিৎকার করে সবাইকে বলতে লাগলো, না, না, আমি অভিনয় করতাছিনা। আপনেরা বিশ্বাস যান ,আমি আর হাঁটতে পারি না। আস্তে আস্তে মা কাছে এসে দেখল আসলেই সে হাঁটতে পারে না। অনেক সময় এমন হয় মানুষ চাইলেও হঠাৎ করে কাঁদতে পারে না। ধীরে ধীরে তার কান্না বানের পানির মত সব ভেঙ্গেচুরে দেয়।

শাহনুরের মা ধীরে ধীরে হঠাৎ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। হাসি সংক্রামক হলেও কান্না বোধকরি সংক্রামক নয়। ফলে যখন আসিয়া কান্না করতে লাগলো তখন বুড়ি ছাড়া তেমন কান্না করেনি। কেউ তো বলা শুরু করলো, এটা হয়তো তাদের নতুন অভিনয়ের কলাকৌশল। পাশ থেকে মহিমার মা বলল, বউ, পা বাঁকা হইয়্যা গেছে গা। পা সজা কইর‍্যা দে। কাশেমের বউ বলল, শাহনুররে গরম পানিত বয়ায়ে রাখ। আরাম অইবার পারে। তখন সে সবাইকে কিভাবে তার সৎ ভাইয়ের ছেলের পা বাঁকা থেকে সোজা হয়েছে তা বলতে লাগলো। কেউ কেউ বলল পা টেনে দেখতে। কেউ কেউ বলল পা টেনে লাভ হবে না। যখন তারা দেখল কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, তখন কালামের মা বিজ্ঞের মত শাহনুরের কাছে এসে দেখতে লাগলো। কালামের মা দেখতে বিদঘুটে, গালে বসন্তের দাগ, শরীর থেকে বাসি ভাত আর মাছের মত বোটকা গন্ধ বের হয়। দাঁত দেখে মনে হয়, ডিমের কুসুম লেগে আছে বহু দিন থেকে। তার সম্পর্কে প্রায় সবাই একমত যে, তিনি নাকি সপ্তাহে দুই দিন দুপুরে আর রাতে জীনদের সাথে মলা মাছ আর বাসমতী চালের ভাত খান। একবার জীনদের কোন এক বাদশাকে এমন জোরে থাপ্পড় দিয়েছিল যে মনে হয়েছে পূজার ঢাক বেজে উঠেছিল। থাপ্পড় মারার পেছনে কারণ ছিল তরকারিতে লবণ কম ছিল। ওই পাচক এখন তার ঘর সকাল বিকেল ঝাড়ু দেয় আর তার পা টিপে দেয়। আবার অনেকে এটাও বলে যে, বদ জিন খারিজকে ৫ হাত উপর থেকে আছাড় মেরেছিলেন। সে থেকে খারিজ এক পা খুঁড়িয়ে হাঁটে। জামালদের ঘরের চাল বাঁকার পেছনে কালামের মায়ের বিশেষ ভূমিকা আছে বলে সবাই বিশ্বাস করে। এরপর থেকে সবাই তাকে ভয় আর ফ্যাকাসে মুখে তাকায়। তিনি যা বলেন সবাই কেমন যেন বাধ্য হয়ে শুনে। পিঁড়িতে বসে শাহনুরের মাকে হুকুম করল, কই গো, এক খিলি পান দে। সাথে হাকিমপুরি জর্দা দিস। আর একখান খেজুর দিস। তোদের তো আর বেহেশতের পানি নাই। জীনদের ওখানে পান খাইবার সময় দিসিল। পানি খেতে শাহনুরকে দেখতে লাগলো চোখ ছোট করে। ওই মাইয়া, কান্দস ক্যা। এত চিল্লাইস ক্যা। কানে কষ্ট লাগে। শাহনুরের মা বলে, কি করব চাচী। মাইয়া যে সকাল থাইক্যা এইখানে বইস্যা আছে। চুপ কর হারামজাদি,মাগী কোন হানকার। কার লগে পেট বাধাইছস হেই খবর মনে করছস আমি জানি না। উপস্থিত সবাই চোখ গোলগোল করে শাহনুরের মাকে দেখতে লাগলো। ফিসফিস শুরু হয়ে গেল। চাচী ,এইসব কি কন আপনে? যা সইত্যি তাই কইতাছি। গা জ্বলে হারামজাদি, বেশ্যা জানি কোন হানকার চাচী, মিছা কথা কইবেন না। আমি এমুন কোন কাম করিনাই। তাইলে তর পেট এত বড় হয় কেমতে, মাগী? হাবাগোবা জামাইতারে ইচ্ছামত খাইছস, এখন কারে খাবি আবার। তারপর যতই আম্বিয়া কথা বলুক না কেন, কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না। সেও আর বেশি জোর দেয় না। এখন তার প্রধান কাজ শাহনুরকে ভাল করা। ফলে সে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে এই মিথ্যে অপবাদ মেনে নেয় এই আশায়, যদি তার মেয়ে ভাল হয়। এখন সে প্রতিবাদ করলে তার মেয়ে আর ভাল হবে না। কেউ এগিয়ে আসবে না সাহায্য করতে। তার চেয়ে এটাই ভাল নিজে খারাপ অপবাদ নিয়ে সন্তানের কল্যাণ কামনা করা। শুন হারামজাদি, তর মাইয়ার বদ বাতাস লাগছে। খুব বদ বাতাস। আল্লাগো, কি হইব আমার। কি কইলা চাচী। যা কইসি, তাই হইসে এহন কি করমু আমি! বাতাস ছাড়ান লাগব। আমার জানাশুনা একজন থাকে আম বাগানে। তারে আনা লাগবো। সেই পারবো এই বদ বাতাস ছাড়াইতে। ছোট করে হাশেম বলল, এক বার ডাকডর দেখালে হইত না চাচী। চুপ কর, যা জানস না, হেই বিষয়ে কথা কইতে আহস ক্যান! তখন সবাই বলতে লাগলো তাই যেন হয়। আসলে মানুষ গা সওয়া জীব। যখন কেউ কাউকে মেনে চলে বা বিশ্বাস করে তখন তারা তার খারাপ কাজকেও মেনে নেয়। সে তার আপন ভাইকে হত্যা করলেও কিছু বলে না। গ্রামের মানুষরা বলে যে আম বাগানের হুযুর মস্ত বড় আলেম। লম্বা জামা পড়ে, সবসময় হাতে তসবি, চোখে সুরমা দেয় আর শরীর থেকে সৌদি আরবের আতরের সুবাস ছড়ায়। কেন যে তিনি আম বাগানে থাকেন তার কারন কেউ জানে না, জানতেও চায় না। তার চোখ রক্ত জবার মত লাল মনে হয় যেন এখনি টুপ করে এক ফোঁটা রক্ত পড়বে। গায়ের রং এমন কালো যা শুধু শয়তানের পক্ষেই সম্ভব কালো হওয়া। আম বাগানের হুযুর আসতে আসতে রাত হয়ে গেল। শীতের রাত। ঝপ করে রাত নামে যেমন করে গাছ থেকে ফল পড়ে। ঘন মিশমিশে কালো রাত। রাতে তেমন কেউ থাকে না। ছোটরা সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়রা ঘুমিয়ে গেল আরেকটু রাত বাড়তে। শুধু মহিমার মা আর শাহেনা শাহনুরের পাশে পবিত্র কোরআন পাঠ করতে লাগলো। আর কিছু পর পর আম্বিয়া চিৎকার করে বলে, হে আল্লাহ, আমারে তুমি কি পরীক্ষায় ফালাইলা। আমার জীবন নিয়া হইলেও আমার শাহনুররে বালা কইরা দেও। মাইয়ার দুখ দেখনের আগে আমার মরণ দিলা না ক্যান, খোদা।

পাশ থেকে শাহানা বলে, ওই আম্বিয়া চুপ কর। কান্দিস না। সব ঠিক হইয়্যা যাইব। খলিল হুযুর তো আইসে। আর চিন্তা কি! তার কাছে এই বদ বাতাস কিছুই না! তাইনে বাম হাত দিয়া পারে এসব! সব ঠিক হইয়্যা যাইব। তুই খালি দোয়া কর। ঘন কালো কিশোরীর চুলের মত শীতের রাত বাড়তে থাকে। রাত বাড়তে থাকে আর হাজার বছরের আদিম মায়ের মত আম্বিয়ার চিন্তা বাড়তে থাকে। সে শুধু তার স্বামীকে অভিসম্পাত দেয়। লোকটা বাজার থেকে এসে সেই যে ঘুমিয়েছে মনে হয় যেন মড়া কাঠ শুয়ে আছে! মাছের চোখের মত সকাল হতে শুরু করে। সবাই উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। তারা তাদের সকালের নাস্তা খেতে ভুলে যায়। গরুগুলোও হাম্বা ডাক দিতে ভুলে যায়। এক দৃষ্টিতে খলিল হুযুর চেয়ে আছে শাহনুরের দিকে রক্তজবা চোখ নিয়ে। সে চোখে এক ধরণের কামনা আর ক্রোধ দেখা যায়। এক আদিম কামনা ভর করে খলিল হুযুরের চোখে। ঝাড়ফুঁক দিয়ে বসে থাকল খলিল যেন সে ধ্যান করছে। কেউ কিছুই বলছে না। সবাই এমন চুপ করে থাকে যেন দূর থেকে গাছের মরা পাতা পড়লে তার মর্মর শব্দ শুনতে পারা যায়। এরে জিন্দা কবর দেয়া লাগবো। তাইলে বালা হইব। এছাড়া আর কোন গতি নাই। কবরে এক ঘণ্টা রাখতে অইব। কবরের উপর একখান গামছা ভিজাইয়া দিতে হইব। গামছা শুকাইলে মাইয়া মারা যাইব আর এক বারই গামছা ভিজাইয়্যা দিতে অইব।

হাশেম বলল, এইডা হইবার পারে না। সে তো মারা যাইব ১০ মিনিটেই। তার সাথে অনেকে এক মত হয় তো হয় না। সবার মনে এক ধরণের সাদা বিশ্বাস অবিশ্বাস ভর করে। কেউ দ্বিধায় থাকে। কেউ বা শুধু মুখ ভর্তি পান চিবোয়। সবাই বলল, তা কেমনে হয় হুযুর। মাইয়া তো মইরা যাইব গা।

ধমক দিয়া খলিল বলল, যা জান না হাশেম কথা কইতে আইবা না। না জানা মানুষ আমি পছন্দ করি না। চক্ষুশূল। আর মিয়ারা হুনেন, আপনারা তো মূর্খের বাপ, আপনেরা কি জানবেন গায়েবি বিদ্যা।

হাশেম আবার জোর দিয়ে বলল, আমি তা হইতে দিমু না। লাগলে আমি জান দিমু মাগার এই কাম হইতে দিমু না। তাইলে ল হাশেম, তুই ও তার লগে কবরে যা। শাহনুরের লগে কি তর ইটিসপিটিস চলেনি হারামজাদা, অনেক্ষণ পর কালামের মা মুখ খুলল। কি কন এসব! আমি কেন শাহনুরের লগে পিরিত করমু। হে কত ছোড মাইয়্যা তাইলে তুই কথা কস ক্যান। চুপ থাক। মাইয়্যা বালা হন দিয়া কতা। এরপর আর হাশেম কোন কথা বলেনা। সবাই আর কোন কথা বলার সাহস পায়না। কালামের মা বলে, আম্বিয়া কি করবি, তাড়াতাড়ি ক। অইদিকে আবার সময় শেষ হইয়্যা যাইতাছে গা। একটু পর খবিশ লাকামের লগে আমার মিটিং আছে। বেচারা বইস্যা আছে পান নিয়া। সবাই আম্বিয়াকে বোঝাতে লাগলো। কেউ বলে তো ,কেউ বলে না। কেউ বলে মাত্র তো এক ঘণ্টা ,দেখতে দেখতে যাইব গা। কেউ বলে ,না মিয়া ,আপনে পাগলা হইসেন। কবরে তো মিয়া রাখলেই শেষ। কেমনে আর আর বাঁচে। সবাই নানান কথা বলে একমত হল যে, শাহনুরের বাবা আফজল রাজি হইলেই হয়। আম্বিয়া মোটামুটি রাজি আছে বলে সবাই ধরে নে। কালামের মা বলে, ওরে আফজইল্যা, তুই কি কস।

এমন রাগ কেউ দেখেনি আফজলের। মনে হয় সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হঠাৎ করে ফুঁড়ে বের হল। আফজলকে সবাই অনেকটা সবজি হিসেবে জানে যে কোন কথা বলে না। তরকারিতে লবণ কম হলেও খায়,আবার বেশি হলেও খায়। কেউ হাবা আফজল বললেও কিছু বলে না, আবার গাধা আফজল বললেও কিছু বলে না। সে থাকে নিজের জগতে। সংসারে তার মন নেই। বাজারে যায় আর তরকারি বিক্রি করে। সে যে এমন রাগ করতে পারে আম্বিয়ারও জানা ছিল না। আম্বিয়ার মনে পড়ে না কখনো আফজল আম্বিয়াকে আদর করেছে কিনা!

আফজল ঘরে বসে ছিল। একমাত্র মেয়ের এমন হলে কে ভাল থাকে! আফজল ধমক দিয়া বলে, আমি রাজি না। আমি আমার মাইয়্যারে কবরে যাইতে দিমু না। আমার মাইয়্যা খোঁড়া থাকব, আমি দিমু না।

তার লগে হাশেম, কাশেম, আসগর একমত হয়। তারা বলে, হ ভাই, তা অইতে দেওন যাইব না। আফজল তার শরীরের যত শক্তি আর রাগ আছে সব এক করে বলে , আর তুই যদি রাজি থাকস মাগী, তুই আজ থিক্যা আমার কাছে হারাম। এই বলে সে চলে যায়।

হুযুর আর কালামের মায়ের প্রভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না। ফলে শাহনুরকে দশটায় কবর দেয়ার সময় ঠিক করা হল। সবাইকে বলা হয় শুধু হুযুর আর কালামের মা ছাড়া আর যেন কেউ না যায়। কি আশ্চর্য! কেউ কিছু বলল না। এমনকি প্রতিবাদি হাশেমেও কিছু বলেনি। তারা শুধু পশুর মত গোঙাতে লাগলো যেন বন্দি পশু ছাড়া পেতে চায়। শাহনুরকে কবর দেয়া হল। কবর দেয়ার আগে শাহনুরের সাথে কি করা হয়েছে তা শুধু খলিল, কালামের মা আর ঈশ্বর জানেন। কবরের উপর গামছা ভিজিয়ে দেয়া হল। আর সবাইকে সাবধান করা হল যাতে কেউ না যায়।কালামের মা সাবধান করল, কেউ যদি পানি দেয়, তবে তার দশাও এমন হবে। যেহেতু শীতকালে বাতাসে আদ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে তাই পনের মিনিটের মাথায় গামছা শুকিয়ে যায়।

তারপরের ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না; সবাই জানতো শাহনুর মারা যাবে। সবাই ঘরে ফিরল। কদম গাছে যে আফজলের লাশ ঝুলছে তা কেউ দেখেনি। সবাই ভাবে হয়ত সে দূরে কোথাও চলে গেছে। ঘরে শাহনুর বসে আছে! সবার চোখ বের হয়ে গেল দুই হাত। শাহানা তো মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে গেল। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করতে লাগলো। হাশেম ,কাশেম মহা খুশি। বাতাসে খুশির ধ্বনি শোনা যেতে লাগলো। সবাই আফজলকে খুঁজতে বের হল। আসগর তো বলেই দিল, সে জুম্মাতে শিরনি দিবে। হাশেম তাকে সোনার চেন বানিয়ে দিবে বলেছে। মহিমার মা সবাইকে বলল সে শাহনুরদের ঘর ঠিক করে দিবে। আর বুড়ি পান চিবোতে চিবোতে বলল, আমি আর কয়দিন, এই মরি তো ওই মরি। আমার নামে যে জমি আছে খাল পাড়ে, হেই জমি শাহনুররে দিয়া দিলাম। এদিকে আম্বিয়া কি করবে বুঝতে পারে না। সে শুধু এ বাড়ি, ও ঘর দৌড়াদৌড়ি করে আর বলে ,আমার শাহনুর। এ ঘটনার পর আম বাগানের হুযুর আর কালামের মা প্রায় দৌড়িয়ে আসে। কালামের মা বলে, আম্বিয়া পানি দে। পান দে হাকিমপুরি জর্দা দিয়া। আজকে আর খেজুর দিস না। বেশি মিষ্টি খান বালা না। তোদের কলের পানিই দিস। বেহেশতের পানিতে অরুচি হইচে। খলিল হুযুর সবাইকে বিশেষ করে হাশেমকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো, দেখলা মিয়া, আমি কইছিলাম না। যা জান না, হেই বিষয়ে কথা কইতে আইবা ক্যান। সব কুদরত বুঝলা মিয়া, সব গায়েবি। একজন বলল, হুযুরের হাত পা টিপা দিমু নাকি। আরেকজন বলল, হুযুর আপনে আমার ঘরে জায়গির থাকেন। গরীব ফতেহ আলী বলল, হুযুর আপনে আমার পীর, বাপ। আপনে যা কইবেন তা মাইনা চলবো। খলিল হুযুর বলল, কি যে কও মিয়ারা। আল্লাহ হুকুম কে পারে অবজ্ঞা করতে। যখন এত কইরা কইতাছ...দেও হাত পা টিপা। ফতেহ আলী জমিডা কিন্ত কইলাম...

সবকিছু মনে হচ্ছে এমন ভাবে চলার কথা ছিল যদি না ছোট মহিমা বিষয়টা না খেয়াল করতো। শিশুরা মনে হল প্রকৃতির অতি সূক্ষ্ম বিষয়ও খেয়াল করে, কিছুই এড়িয়ে যায় না তাদের অনুসন্ধিৎসু চোখ থেকে। সে সবাইকে বলল, আফজল কাকুরে কদম গাছের লগে দেইখ্যা আইসি ঝুলতাছে। সবাই যখন ব্যস্ত কি হল বুঝতে তখন মহিমা আবার বলল, আরে আরে! শাহনুর বুবুর চউখ লাল হইতাছে ক্যান। এমন করতাছে ক্যান বুবু!

সবাই কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখল, শাহনুর অতি ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হল। যেন একজন বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটছে। সে সবার দিকে একবার ,দুইবার ,তিনবার দেখল। হুযুর আর কালামের মাকে অতি আদর করে ডাকল। তাদের খোঁজ খবর নিতে লাগলো। তারাও বলতে লাগলো গদ্গদভাবে। সবাই দেখল মুহূর্তে আম বাগানের হুযুর আর কালামের মা দুটি কালো পাখি হয়ে গেল। তারা উড়ে গিয়ে কবরে বসল। কিছু পরে তারা যেন মিশে গেল বলে সবাই বিশ্বাস করতে লাগলো। আম্বিয়া শুধু বলতে লাগলো, আমার শাহনুর , আমার শাহনুর... আর শাহনুর সবাইকে ডেকে এনে বলল, আমি শুধু খুঁড়িয়ে হাঁটবার অভিনয় করতে চেয়েছিলাম।

আরও পড়ুন- মানুষ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড