প্রত্যয় হাসান
তিথি বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিকশার অপেক্ষায়। এইচ. এস. সি ফাইনাল পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল খাতা সাইন করাতে যাবে কলেজে। তার সময়ের হিসাব অনুযায়ী যদি কোন জোয়ান-রিকশাওলার রিকশায় উঠে তবুও কলেজে পৌছাতে কমপক্ষে বিশ মিনিট দেরি হয়ে যাবে। বায়োলজির সনিয়া ম্যাডাম দেরি হলে ছাত্রীদের বিশ্রী গালাগাল দেয়। গার্লস কলেজের ছাত্রীরা সবাই তাকে গোপনে ‘গরম চুলা’ বলে ডাকে। তিথি ভাবছে- আজ মনে হয় আর রক্ষে নেই।
এদিকে রাস্তায় কোন রিকশাও দেখছে না। তার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। তিথি লক্ষ্য করছে ইদানিং তার শরীর বেশি ঘামছে। নাকগলানোর মতো তার শরীর কারণে-অকারণে গলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শরীরে এত গরম আসলো কোথা থেকে কে জানে। সে খানিকটা সামনে হেঁটে যাবে কিনা এমন দু’টানায় একস্থানে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষের অপচয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে অভাব, তা সময়ই হোক আর সম্পদই হোক। যার যাকিছু যত বেশি তার অপচয় তত কম। একারণেই মানুষ বলে, ‘ধনীরা কৃপণ হয়।’ হঠাৎ কে যেন তিথির হাতের কবজি শক্ত করে ধরে। তিথি হকচকিয়ে দেখে, অর্ধনগ্ন এক পাগল মহিলা তার হাত টেনে মুখের কাছে নিয়ে কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে। তিথির মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল অনুভূতি বয়ে যায়।
পাগলী তিথির হাত তার নাকের কাছে নিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে বলতে থাকে, ‘তোর শইলে গন্ধ, তোর শইলে গন্ধ...’ তারপর হাত ছেড়ে লাফাতে লাফাতে, একই কথা বলতে বলতে চলে যায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় তিথি খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিকশার বেলের শব্দে তার ঘোর কাটে। দেখে এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা হাসিমুখে বলছে, ‘আফামনি, কই যাইবেন?’
তিথি কোন কথা না বলে রিকশায় উঠে বসে। একটু পরপরই রিকশার চেইন পরে যাচ্ছে আর তিথি বারবার নিজের হাত শুকে দেখছে কিসের গন্ধ? সে বিশেষ কোন গন্ধ পায় না, তাছাড়া আজ সে কোন পারফিউমও ইউজ করেনি। পাগলের প্রলাপ, এমন সহজ যুক্তিটা কিছুতেই তার মনের খচখচানি দূর করতে পারছে না। মেয়েরা নিজের ব্যপারে সামান্য বিষয়গুলো নিয়েও খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পরে হোক তা যত বড়ই গুজব। শরীর থেকে যদি গন্ধ আসে, কী বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে? এমন ভাবনায় সে বারবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরছে। তাছাড়া নিলয় এখন তার খুব কাছাকাছি আসতে শুরু করেছে মাত্র, গা ঘেঁসে পাশে এসে দাঁড়ায়। তখন কী হবে? সে যেন আর কিছুই ভাবতে পারছে না।
তিথি কলেজে পৌঁছে পঁয়ত্রিশ মিনিট লেট করে। ‘শাউয়ায় চর্বি জমছে?’ মাত্র এটুকু গালি শুনেই সনিয়া ম্যাডাম থেকে প্র্যাকটিক্যাল খাতা সাইনও করে ফেলে সহজেই। কিন্তু সারাক্ষণই তার মনে খুঁতখুঁত করতে থাকে। একবার আমতা আমতা করে বান্ধবীদের কাছে জানতে চায় তার গা থেকে কোন গন্ধ পাওয়া যায় কিনা? তাদের একজন আর্নি, বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে, হুম, নিলয়ের চুমুর ঘ্রাণ আসতাছে? ‘অসভ্য তোরা’, বলে লজ্জায় সে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসেই কিছু না খেয়ে শুয়ে পরে । তিথি’র মা তার কপালে হাত রেখে বলে, ‘কই? জ্বর-টর তো কিছু নাই? নতুন বায়না’টা কী মহারাণীর? সময়মত না খাইলে কিচ্ছু পাবি না।’ তিথি তার মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, ‘মা, আমার শরীরে কোন গন্ধ পাও, তুমি?’ - হু, পাই তো। বেহেশতের গন্ধ পাই, নিজের জীবনের গন্ধ পাই। - উহু, বিশেষ কোন গন্ধ, বাজে কোনকিছু? - কী কস এইসব? পাগল হইছোস? সে মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে আবার বলে, ‘কী হইছে মা তোর, পরীক্ষা খারাপ হইছে, কী লাগবো তোর? তোর বাবারে এখনই ফোন দিতাছি, বল কী চাই তোর?’ - কিচ্ছু লাগবো না আমার, বিরক্ত কইরো না তো। যাও ঘর থেকে। আমি এখন ঘুমামু। তিথির মা ভাবে, পরীক্ষার চাপে বুঝি মেয়েটা সত্যিই ক্লান্ত। সে আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসে তিথির রুম থেকে।
তিথি’র বাবা অফিস থেকে আসলে তিথির এ বিষয়টা নিয়ে তার মা কথা বলেন। তিথির বাবাও বলে, পরীক্ষার চাপে ও রেজাল্টের টেনশনে হয় তো এমন করছে। তিনি প্লান করেন তিথির প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষ হলেই দূরে কোথাও থেকে একটা ট্যুর দিয়ে আসবেন। সম্ভব হলে দেশের বাহিরে কোথাও থেকে। মেয়ের খুশি তার কাছে সবার আগে।
কিন্তু তিথির মা কিছুতেই স্বস্তি পায় না। সে তার স্বামীকে আমতা আমতা করে বলে, ‘মনে নেই তোমার, তিথিকে আমরা যেখান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম সেখানকার লোকজন বলাবলি করছিলো কোন এক পাগলী নাকি বাচ্চাটাকে ফেলে রেখে গেছিল। মায়ের সেই পাগলামিই কি তিথির মধ্যে দেখা দিলো?’ তিথির বাবা বলেন, ‘একদম চুপ। এই কথা যেন জীবনে আর কোনদিন তোমার মুখে না শুনি। মইরা যামু আমি আমার মাইয়ার চোখে পানি দেখলে।’ তিথির মা তার স্বামীকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে।
নিলয়ের সাথে তিথির সম্পর্কটা এখনো বিশেষ অবস্থানে যায়নি। শুরুটা ছিলো এমন, তিথি’রা ক্লাসের সাত বান্ধুবি মিলে একবার ঠিক করলো লাকি-সেভেন টেস্ট করবে। তারা বিভিন্ন সময় এধরনের কর্ম বা অপকর্ম করে থাকে। সাতটা চিরকুটে তাদের এক একজনের নাম ও মোবাইল নাম্বারসহ ‘মনের ঘরে দাওয়াত’ বিজ্ঞাপন লিখে ক্লাসের জানালা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। তারপর থেকে সবার ফোনের অপেক্ষা।
প্রথম যে ফোন করে, দেখা করতে গিয়ে জানা যায় ওদের কলেজের সামনেকার ঝালমুড়িওয়ালা পিচ্ছি। দ্বিতীয়জন ফোন করে জানায় সে তালাচাবিওয়ালা, এবং সে আশ্বস্ত করে মনের তালাও ভাঙতে পারবে বলে তার ধীর বিশ্বাস আছে। তৃতীয়জন ফোন করে তিথিকে। ছেলেটিকে দেখার পর যৌথ আলোচনা ও ‘নাই মামার চেয়ে কানামামা ভালো’ এমন ফর্মুলায় তাকে তালিকায় রেখে কথাবার্তা আগাতে থাকে। কফিসপ ও শপিংমলে কয়েকদফায় দেখা-সাক্ষাত করে। কখন যেন তিথির সাথে তার সত্যিসত্যিই প্রেম হয়ে যায় তা সে নিজেও টের পায় না। তাই নির্জনে, একা পরস্পরকে স্পর্শ করার একটা তাগাদা অনেকদিন ধরেই দু’জনের মধ্যে চলছিল।
শেষটায় এক সন্ধ্যায় ধানমন্ডি লেকে নিলয় তিথির ডানহাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়ায়। তিথি লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে ঘামতে থাকে। তার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপে। হঠাৎ তার বাম হাতের কবজিতে অনুভব করে কেউ একজন শক্ত করে ধরেছে। তিথির বুকের মধ্যে ধক করে উঠে। তাকাতেই সেই চেনা ঘটনা। পাগলি’টা তার হাত নাকের কাছে নিয়ে বলছে, ‘তোর শইলে গন্ধ, তোর শইলে গন্ধ...’
লজ্জায় তিথির চোখে পানি এসে যায়। সে পাগলীটাকে কসে এক চড় বসিয়ে দেয় গালে। পাগলী হাত দিয়ে গাল ঘসে, সেই হাত আবার নিজের নাকের কাছে নিয়ে ‘তোর শইলে গন্ধ’ বলতে বলতে চলে যায়।
আরও পড়ুন- সাদিয়া আফরিন প্রমার চারটি অনুগল্প
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড