• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার ঈদ সংখ্যা-১৯

কবিতার পরতে পরতে ঈদের বার্তা

  খোরশেদ মুকুল

০৩ জুন ২০১৯, ১৫:০৪
কবিতা
ছবি : কবিতার পরতে পরতে ঈদের বার্তা

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। সাম্য আর শান্তির বার্তা নিয়ে প্রতিবছর হাজির হয় ঈদ। ঈদের জোয়ারে সাঁতার কাটে সকলে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্কদের আকাশেও উঁকি দেয় শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ। বেজে উঠে উৎসবের সাইরেন। ছুঁয়ে দেয় প্রতিটি হৃদয়। এক রশিতে আটকে যায় বিশ্বাসী অন্তর। মুসলিম মিল্লাতের স্বতন্ত্র ইবাদত হলেও তা আজ ভেঙে ফেলেছে জাতিগত দেয়াল। সবাই মেতে উঠে মিলনের আনন্দে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে মিশে ঈদ হয়ে উঠেছে সার্বজনীন উৎসবে। সাহিত্য জাতির সংস্কৃতি ধারণ করে। কলমের কালিতে উঠে আসে সময়ের নানা অনুষঙ্গ। বাদ পড়েনি ঈদ। এমন কোনো মুসলিম লেখক পাওয়া যাবে না যারা ঈদ নিয়ে লেখেননি। এমনকি অনেক বিধর্মীও লিখেছেনে ঈদ নিয়ে। বাঙালি মুসলিম লেখকরাও পিছিয়ে নেই সেই দৌড়ে। তবে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আধুনিক যুগ পর্যন্ত। প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ঈদের কোনো চাঁদ দেখা যায়নি। বিংশশতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম ঈদের চাঁদ দেখা যায়। সৈয়দ এমদাদ আলী’র (১৮৭৫-১৯৫৬) হাতেই লিখিত হয় ঈদের প্রথম কবিতা। ১৯০৩ সালে ‘নবনূর’ ঈদ সংখ্যায় তিনি ‘ঈদ’ নামের কবিতাটি লেখেন। যেটি পরবর্তীতে তাঁর কবিতাগ্রন্থ ডালির দ্বিতীয় সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত করেন। যদিও সেখানে ‘ঈদ’ নামে আরও একটি কবিতা ছিল। ঈদের মূলশিক্ষা সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের চিত্র ফুটে উঠে তাঁর প্রথম কবিতায়। কবির ভাষায়- ‘কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে অরুণ তরুণ উঠিয়ে ধীরে রাঙিয়া প্রতিটি তরুণ শিরে আজ কি হর্ষ ভরে। আজি প্রভাতের মৃদুল বায় রঙে নাচিয়া যেনো কয়ে যায় মুসলিম জাহান আজ একতায় দেখ কত ব ধরে?’

‘ঈদ আবাহন’ এই একই নামে কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১) দু’টি কবিতা লিখেছিলেন। একটি তাঁর অশ্রুমালা এবং অন্যটি অমিয়ধারা গ্রন্থর্ভূত। উভয় কবিতায় কবি মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব এবং জাগরণ কামনা করেছেন। সম্ভাবনাময় মুসলিম ঐক্যের আশাবাদ ব্যক্ত করে কবি বলেন- ‘আজি এই ঈদের দিনে হয়ে সব এক মনঃপ্রাণ, জাগায়ে মোম্লেম সবে গাহ আজি মিলনের গান। ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিষ্মান রবি, জীবন সার্থক হবে, ধন্য হইবে এ ধরিদ্র কবি।’ ( অশ্রুমালা)

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এক অনন্য আলোক দ্যুতি। মুসলিম সাহিত্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টির অন্যতম কারিগর। ইসলামী বিষয়কে সাহিত্যিক রূপদানে বিরল দৃষ্টান্ত। এব্যাপারে কারো খুব একটা দ্বিমত নেই যে, ঈদ নিয়ে সবচে’ বেশি লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। যেমন লিখেছেন ঈদুল ফিতর নিয়ে তেমনি লিখেছেন ঈদুল আযহা নিয়েও। কবিতা-গানের পাশাপাশি রচনা করেছেন নাটকও। তাঁর ঈদ সংক্রান্ত কবিতায় আনন্দ-উল্লাস যেমন আছে তেমনি আছে সাম্যের আহবান, নবজাগরণের বাণী। আছে গরীব-দুঃখীর ঈদ অনুভূতি। নিচে দু’টি কবিতার পঙক্তি উদ্ধৃত করছি- ‘প্রজারাই রোজা হাকিয়াছে আজীবন উপবাসী, তাহাদের তরে এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি।’ ( ঈদের চাঁদ )

অথবা

‘জীবন যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ ( কৃষকের ঈদ )

নজরুলে ‘খুশির ঈদ’ কবিতা (পরবর্তীতে কবি যেটিকে গানে রূপ দেন ) ছাড়া আমাদের ঈদ যেন অপূর্ণই রয়ে যায়। যেটি হয়ে উঠেছে ঈদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আনন্দময়তা, সাম্যবোধ, আত্মার জাগরণের অপূর্ব মেলবন্ধনে কালোত্তীর্ণ এই লেখা। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ। তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।’

কবি গোলাম মোস্তাফা ( ১৮৯৭-১৯৬৪ ) ইদের চাঁদ দেখে বলে উঠেন- ‘আজ নতুন ঈদের চাঁদ উঠেছে নীল আকাশের গায়, তোরা দেখবি কারা ভাই-বোনেরা আয়রে ছুটে আয়।’ এর একটু পরেই সামাজিক সাম্য এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা বলেছেন এভাবে- ‘ওরে চাঁদ নহে ও, ওযে মোদের নূরেরি খঞ্জর ওই খঞ্জরেতে কাটবো মোরা শয়তানের পঞ্জর মোরা ভুলবো আজি সকল বিরোধ মিলবো গো ঈদগায়।’

কবি সুফিয়া কামালও (১৯১১-১৯৯৯) কবি গোলাম মোস্তাফার মত পশ্চিমাকাশে ইদের শিশু চাঁদ দেখে মুচকি হেসে ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায় বলেন- ‘চাঁদ উঠিয়াছে, ঈদের চাঁদ কি উঠেছে শুধায় সবে লাখো জনতার আঁখি থির আজি সুদূর সুনীল নভে। এই ওঠে, ওই উদিল গগনে সুন্দর শিশু চাঁদ- আমিন। আমিন। রাব্বুল আলামিন করে সবে মোনাজাত।’

ইসলামী জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ ( ১৯১৮-১৯৭৪ ) সাম্যের গানকে একটু ভিন্নরূপে চিত্রিত করেছেন। সামাজিক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, অসাম্যের গ্লানি দূরে ঠেলে দিয়ে এক নির্মল প্রশান্তির পৃথিবী কামনা করেছেন তাঁর ‘ঈদের কবিতা’য়। কবির ভাষায়- ‘আজ ঈদগাহে নেমেছে নতুন দিন, চিত্তের ধনে সকলে বিত্তবান, বড় ছোট নাই, ভেদাভেদ নাই কোন; সকলে সমান- সকলে মহীয়ান।’;

ইদের চাঁদ সবার জন্য সুখের বার্তা নিয়ে আসে না। বুকের ভেতর জমে থাকা হাহাকার ফুটে উঠে এ-দিনে। চিৎকার করে বেরিয়ে আসে সমস্ত অসহায়ত্ব। কবি সিকান্দার আবু জাফর ( ১৯১৮/১৯১৯-১৯৭৫ ) ঈদ উপলক্ষে দোয়া চেয়ে পিতার নিকট ‘ঈদের চিঠি’ কবিতায় লেখেন- ‘ঈদের সালাম নিও, দোয়া কর আগামী বছর কাটিয়ে উঠতে পারি যেন এই তিক্ত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা অন্ততঃ ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি একটি পাঞ্জাবী আর সাদা গোলটুপি তোমাকে যেন পাঠাতে পারি আর দিতে পারি পাঁচটি নগত টাকা।’

অন্যদিকে সৈয়দ আলী আহসান ( ১৯২২-২০০২ ) ইদের আগমনে, খুশির জোয়ারে নানা সাজ-সজ্জার কথা উল্লেখ করে ‘নতুন দিনের বার্তা’ কবিতায় বলেন- ‘এসেছে নতুন দিন আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে, কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ জরির জোব্বা, শেরোয়ানী আর আমামার সজ্জায় বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি, ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে, রাত্রি হয়েছে ভোর।’ নাগরিক কবি শামসুর রাহমানকেও ( ১৯২৯-২০০৬ ) ছুঁয়ে দেয় ইদের নির্মল বাতাস। বাঁকা চাঁদের আলোয় তিনিও রোমন্থন করেছেন ইদস্মৃতি। শুধু স্মৃতি বললে ভুল হবে, তাতে প্রকাশ পেয়েছে আবহমান বাংলায় চলে আসা সালামি প্রথা। ‘দশ টাকার নোট এবং শৈশব’ কবিতায় তিনি লেখেন- ‘মনে পড়ে যখন ছিলাম ছোট, ঈদে সদ্যকেনা জামা-জুতা প’রে সালাম করার পর আম্মার প্রসন্ন হাত থেকে স্বপ্নের ফলের মত একটি আধুলি কিংবা সিকি ঝরে যেত ঝল্মলে ঝনাৎকারে আমার উন্মুখ আনন্দিত হাতে...’

সদ্য প্রয়াত বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ আল মাহমুদ ( ১৯৩৬-২০১৯ ) ‘গৃহলতা’ কবিতায় মা ছাড়া ঈদ আনন্দ কেমন ফ্যাকাসে লাগে তার একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এই কবিতা। মা ছাড়া ঈদ অনুভূতি কবির ভাষায়- ‘ঈদের দিনে জিদ ধরি না আর কানে আমার বাজে না সেই মায়ের অলঙ্কার। কেউ বলে না খাও পাতের ভেতর ঠা হলো কোর্মা ও পোলাও।’

ঈদের শিক্ষা যদি আমরা আমাদের জীবনে সঠিকভাবে প্রতিফলন ঘটাতে পারি, তাহলে এদেশ থেকে দূর হবে সাম্প্রদায়িকতা। ফিরে আসবে সাম্য। ঈদ এলে যেভাবে ধনী-গরীব, বাদশা-ফকির, ছোটো-বড় ভেদাভেদ ভুলে যাই, সারাবছর যদি সে দেয়ালকে উপড়ে ফেলতে পারি তাহলেই ঈদ হবে সার্থক।

আরও পড়ুন- মাতৃভাষা চর্চায় ইসলামের গুরুত্ব

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড