• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার ঈদ সংখ্যা-১৯

অচিন অ্যাপলের দেশে

  নিশো আল মামুন

০৭ জুন ২০১৯, ১০:৩৫
গল্প
ছবি : প্রতীকী

আমার বরাবরই ধরণা ছিল পশ্চিমারা জাতি হিসেবে আধাপাগল। এমন সব কাণ্ড-কারখানা করে যে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকে না। যেমন ওদের পশু-পাখির সাথে বন্ধুত্বের বিষয়টি বারবার আমাকে বিস্মিত করে। ডেগেন হামে অফ লাইসেন্স সপে কাজ করি। এই অফ লাইসেন্স সপের প্রত্যেকটি ক্রেতাই কোলে করে কুকুর নিয়ে আসেন। যদিও সপের মেইন দরজায় লেখা আছে -No Dog, No Smoking। তারা পরের বাক্যটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। কিš‘ প্রথমটি ঘুরিয়ে পালন করেন। তারা কুকুরকে হেঁটে নিয়ে আসেনা, কোলে করে আনে। কুকুরের সাথে ঠোঁটে ঠোঁট মিলায়, কিস দেয়। কুকুরকে কোলে নেয় আর তাদের বাচ্চাদের টলিতে করে। বাহ! কি সুন্দর সভ্যতা। বাচ্চারা যদি দোকানে এসে খাবার কিনতে চায়, তাহলে তারা নানান ধরনের ছুতা দেখিয়ে খাবার কিনা থেকে বিরত রাখে। আর যদি কোন কুকুর দোকানে এসে মুখ দিয়ে কোন খাবার দেখায়, সে খাবার কিনে দিতে বাধ্য হয়। একদিনের কথা বলি। আমি অফ লাইসেন্স সপে ডিউটি করছি। রাত্রি একটা কি দুইটা বাজে। একজন ভদ্র লোক এলেন। কোলে কুকুর।

সে প্রায় ৮০ পাউন্ড শপিং করলেন। তার মধ্যে নিজের জন্য ৩০ পাউন্ড আর কুকুরের জন্য ৫০ পাউন্ড। আমি টাকা বুঝে নিয়ে সব পণ্যই ব্যাগে গুছিয়ে দিলাম। সে দোকান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাকে বারবার ধন্যবাদ জানালাম। এর পর বেশ কয়েকদিন তিনি আমাদের সপে এলেন না। দোকানের মালিক একদিন আমাকে ভদ্রলোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। স্টিভ কয়েকদিন থেকে আমাদের দোকানে কেন আসে না। আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। দোকানের মালিক কারণ খুঁজে বের করলেন। তিনি আমাকে জানালেন আমি নাকি তার কুকুরকে ধন্যবাদ দেই নি। তাই সে মহা বিরক্ত। সে একটা শর্তে আসবে তার কুকুরকে স্যরি বলতে হবে। হায়রে সভ্য দেশের কি কাণ্ড! লন্ডনকে নিয়ে খুব ভাবনা হলো। দেশটা কেমন জানি, ফুল আছে গন্ধ নাই, মানুষ আছে মন নাই।

মানাস্টোর রোডে সন্ধ্যা বেলায় প্রায় নিয়মিত হাঁটা-হাঁটি করি। সে সময় লক্ষ করি একটা বিড়াল প্রায় রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রায় রাস্তার সব মানুষের কাছে আদর নিতে চায়। গাড়ি থামিয়ে পর্যন্ত ড্রাইভার বিড়ালকে আদর করে। কিন্তু বেচারা আমার কাছে কোন পাত্তা পায়না। একদিন সন্ধ্যা বেলায় হাঁটছি। হঠাৎ বিড়ালের মালিক আমার কাছে এসে বলল, তুমি কি আমার বিড়ালকে ঘৃণা কর? আমি বললাম, ‘না।’ - তাহলে তুমি আমার বিড়াল কে আদর কর না কেন? - আমি কোন উত্তর দিলাম না। তিনি আবার বললেন, ‘তুমি তার লোমে সিঁথি কাটনা কেন?’ আমি এবার হাসলাম। আমার হাসি দেখে সে অবাক হলো। সে মনে করলো আমি একজন ভিনদেশী উন্মাদ, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

কুকুর নিয়ে আমার অনেক ভুল ধারণা আছে। এরই মধ্যে কথাটি জেনে গেছে আমারই এক বন্ধু কাউসার। সে ম্যানেজমেন্ট পড়ার পাশাপাশি একটা মসজিদের ইমামতিও করায়। তার বাসায় কলেজ শেষে বেড়াতে গিয়েছি। কথায় কথায় কুকুরের প্রসঙ্গে চলে এলাম। কাউসার কুকুর প্রসঙ্গে আমার ভুল ভাঙিয়ে দিল। সে বলল, শিক্ষিত কুকুর দ্বারা বাড়ি পাহাড়া ও শিকার করার কাজ করা যায়। সে বেশ কয়টা ধর্মীয় বই খুলে উদাহরণ দিল।

দিন সাতেক পরের ঘটনা। আমি অফ লাইসেন্স সপে ডিউটি পালন করছি। একজন অন্ধলোক দোকানে প্রবেশ করলেন। অন্ধ লোককে গাইড দিচ্ছে কালো রঙের একটা কুকুর। এই কুকুরটিকে বিশেষ ধরনের একটা কোর্স করানো হয়েছে। রাস্তা পারা-পার ও চলাচল, গাড়িতে উঠা-নামা, দোকানে সপিং করা সম্পর্কে। আমি এ কুকুরটিকে দেখে খুব বিস্মিত হলাম।

আমি ডেগেন হামের যে বাসায় থাকি সে বাসায় আমার রুমের সাথে একটা আপেল গাছ রয়েছে। গাছটি দেখতে ঝাপড়ি মারা। আমি প্রায় রাতে আমার জানালা খুলে দিয়ে আপেল গাছটি দেখি আর সিগারেট টানি। একদিন লক্ষ করলাম আপেল গাছটিতে একটি কাঠ বিড়ালী থাকে। আপেল গাছের ডাল-পালায় ঘুরে বেড়ায়। উন্মাদ রোগ সম্ভবত ছোঁয়াচে, কারণ আমার সাথে কাঠ-বিড়ালীর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো। আমি যখন কাঠ বিড়ালীর দিকে তাকিয়ে থাকি তখন কাঠ বিড়ালীটিও কোন এক বিচিত্র কারণে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হয়। যেমন- আমি- খবর কী রে? কাঠবিড়ালী- চুচু (ভাল)। আমি- আপেল খেয়েছিস? কাঠবিড়ালী- চুচু (খেয়েছি)। আমি- শীত লাগে? কাঠবিড়ালী- চুচু (একটু একটু)। আপেল গাছটিও আমাকে বেশ ভাবায়। আমার চিন্তা শক্তি প্রসারিত করে। রহস্যময় জগতে আপেলে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যেমন F= MA এসেছে অ্যাপলকে কেন্দ্র করেই।

প্রাচীন চিত্র কলায় আদম, ইভ এবং সর্পের সঙ্গে যে ফলটি দেখা যায় তার নাম আপেল। পদার্থবিদদের গ্র্যান্ডমাষ্টারদের (স্যার আইজাক নিউটন) অ্যাপল নিয়ে বেশ ভেবেছেন। স্যার আইজাক নিউটন এক সময় আবিস্কার করলেন বিখ্যাত বিখ্যাত সূত্র। যা পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে গেল হাজার হাজার আলোক বর্ষ।

পৃথিবীতে এলেন আরেক কিংদন্তি অ্যাপেলের গুরু, স্টিভ জবস। যিনি অ্যাপল দিয়ে বিশ্বকে আরো ছোট থেকে ছোট। কাছে থেকে কাছে নিয়ে এলেন। বিস্মিত করলেন বিশ্বের সব মানুষকে। অ্যাপল নিয়ে আর মাতা-মাতি করলাম না। কারণ বেশি মাতা-মাতি করলে দাঁত ভেঙে যেতে পারে। ডেগেন হাম সম্পর্কে ধারণা নিতে শুরু করলাম। তেমন কিছু পেলাম না। শুধু একজন বৃদ্ধ মাতালকে চোখে পড়ে। বৃদ্ধ মাতালের বয়স ৮০ কি ৮৫ হবে। সব সময় মদ খায়। ড্রাঙ্ক হয়ে সন্ধ্যা বেলায় ডেগেন হাম বাস টার্মিনালে মাতলামী করে। প্রতি সন্ধ্যাতে দেখছি কারো না কারো সাথে মাতলামি করছে। হয়তো বা আর সে জীবনের বাকি সময় পাড়ি দিবে কি ভাবে– ভেবে পায় না। তাই এ মাতলামি। পশ্চিমাদেরতো আর আমাদের মতো চিন্তা নেই যে, তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স করতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে ভরণ-পোষণ কে করাবে? বৃদ্ধ বয়সে সরকার তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করে রেখেছে। শুধু বৃদ্ধ ভাতা না। বেকার ভাতা আরও কতো ধরণের ভাতা। তবুও তারা ভাতা নিতে রাজি না। হোয়াইল চ্যাপলে একজন বৃদ্ধকে দেখতাম তিনি ফুল বিক্রি করে। বৃদ্ধের বয়স ৯০ এর কাছাকাছি। একদিন তাকে আমি বললাম, তুমি ফুল বিক্রি করো কেন? তোমারতো এখন বিশ্রাম নেওয়ার সময়। সরকার তোমাকে ভাতা দেয় না?

ওলন্ড ম্যান আমাকে রাগ পেয়ে বলল, আমি কেন সরকারের ঘাড়ে বসে খাব। আমি কি পরিশ্রম করে উপার্জন করতে জানি না? যা হোক মূল গল্পে ফিরে আসি। বৃদ্ধমাতাল একদিন আমাকে পেয়ে বসলেন। সন্ধ্যাবেলায় হাটছি হঠাৎ আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। আমাকে প্রথমেই তার জেকেটর পকেট থেকে মদ বের করে এগিয়ে দিলেন। আমি বললাম আমি এই সব পান করি না। সে কারণ জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম আমি মুসলিম। মুসলমান ধর্মে মদ খাওয়া নিষেধ। তিনি মদ পকেট ঢুকালেন। পরে আমার সাথে অনেক গল্প করলেন। পড়াশুনা, দেশ, তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে। সর্বশেষ তিনি ডেগেন হাম সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে অনেক নাম করা একজন ব্যক্তি বাস করতেন। তার নাম আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। তিনি পেনিসিলিন আবিস্কার করেছেন। যখন বৃদ্ধ মাতালের কাছে আমি বিদায় নিলাম তখন তিনি অন্য পকেট থেকে একটা আপেল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি অভিভূত হলাম তিনি আমাকে হালাল খাবার খেতে দিলেন। অনেক শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

স্যার আইজাক নিউটনের দেশ, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর দেশ, অচীন অ্যাপেলের দেশ ইংল্যান্ড।

আরও পড়ুন- মোবাইল

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড