মোহাম্মদ আসিফ
বিগত বছরগুলোর মতো এবারও নকলমুক্ত পরিবেশে এসএসসি ও সমমানের দাখিল এবং এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষা চলছে। সেই সঙ্গে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও কম। এতে করে সবার মনে আশার সঞ্চার হয়েছে।
নকলমুক্ত পরিবেশ আর বহিষ্কারের হার কমলেও বাড়ছে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার। অনুপস্থিত ও ঝরে পড়ার উদ্বেগজনক সংখ্যা দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় বড় ধরনের সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষাতেই পাঁচ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী কেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকছে। ৮ পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল প্রায় অর্ধ লাখ। যাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার এই চিত্র উদ্বেগজনক। শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার আগের তুলনায় কমেছে। কিন্তু কোনোভাবেই হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। এই সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়েই আছে।
বিশেষজ্ঞরা ঝরে পড়া ও হলে অনুপস্থিত থাকার কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার রোধ করতে হবে। তা না হলে শিক্ষার লক্ষ্য পূরণ হবে না।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাধারণত ঝরে পড়া বলতে নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফরম পূরণ না করা শিক্ষার্থীদেরই বলা হচ্ছে। এই সংখ্যা উদ্বেগজনক। আবার ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে না আসার মতো ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। মাত্র দুই বছরে তিন লাখ ৯২ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে গত দুই বছর আগে নবম শ্রেণিতে ১১ শিক্ষা বোর্ডে মোট ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৮ জন রেজিস্ট্রেশন করেছিল। যাদের এ বছর এ পাবলিক পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৮৮ জন পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে।
পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, নবম শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনই ঝরে পড়ছে। সরকারের উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তার কারণে এ স্তরের শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও ঝরে পড়া কমছে না।
কমপক্ষে ১০০ জন পরীক্ষা দিচ্ছে এমন প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই বলছেন, নবম শ্রেণিতে ১০০ জন নিবন্ধন করলেও ৭০ জনের বেশি পরীক্ষায় আসছে না।
সবচেয়ে ভালো মানের কিছু প্রতিষ্ঠানে ঝরে পড়ার হার কিছুটা কম হলেও ৯০ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠানে এ হার উদ্বেগজনক। একই সঙ্গে নির্বাচনি বা টেস্ট পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে ফেল করলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসতে না দেয়ার একটি আদেশও ঝরে পড়ার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে বলছেন শিক্ষকরা। ভালো ফল দেখাতে অনেক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনি পরীক্ষায় সামান্য খারাপ করলেও তুলনামূলক দুর্বল শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসতে দিচ্ছে না। ফলে সেখানেই অনেকের শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে হচ্ছে।
ঝরে পড়ার সঙ্গে উদ্বেগের আরও একটি কারণ ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এখন পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষাতেই কেন্দ্রে কমপক্ষে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকছে। যাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা সবথেকে বেশি।
গত কয়েক বছরের মতো এবারও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃতদের সংখ্যা কম হলেও চিন্তার কারণ অনুপস্থিতি। বোর্ড সূত্রের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৯টি সাধারণসহ ১১ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে শুরু হওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রথম দিনে বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষায় বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র একজন। কিন্তু ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি ৫ হাজার ৪৪৭ জন!
দ্বিতীয় পরীক্ষায় সারাদেশে বহিষ্কার হয়েছে ১৮ জন, কিন্তু পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ৫ হাজার ৫৬১ শিক্ষার্থী। ৬ ফেব্রুয়ারি ৭৯ শিক্ষার্থী বহিষ্কার কিন্তু অনুপস্থিত ছিল ৫ হাজার ৮৬৯ জন। ৯ ফেব্রুয়ারি বহিষ্কার হয়েছে ১৭৬ জন কিন্তু অনুপস্থিত ছিল ৬ হাজার ৬০ জন। ১১ ফেব্রুয়ারি অনুপস্থিত ছিল ৬ হাজার ৯৩৯ শিক্ষার্থী, অথচ বহিষ্কার ছিল মাত্র ১৩৪ জন। সর্বশেষ সোমবার অনুষ্ঠিত পরীক্ষাতেও ৫ হাজার ৪৪৭ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, তাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা প্রায় শতভাগ। তবে শিক্ষা বোর্ড ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই আগামী বছর পরীক্ষা দিতে পারে। তবে অনুপস্থিতির ব্যাপক হার ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শিক্ষার্থীদের এই অব্যাহত ঝরে পড়ার পরিস্থিতি সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার পথে বড় অন্তরায়। যদিও এ ঝরে পড়া ও অনুপস্থিতি নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ভালো কোনো গবেষণাও নেই।
কী কারণে ঝরে পড়ছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও শিক্ষাবিদরা ঝরে পড়ার বেশ কিছু কারণ নির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- পুরোপুরি অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়া, অসচেতনতার জন্য বাল্যবিয়ে, দারিদ্র্য, নদী ভাঙন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি।
মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা নির্ধারণ ও এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির।
তিনি বলেন, ‘ভর্তির হার এখন আশাব্যঞ্জক। তবে ঝরে পড়া রোধ করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করে এখনই ঝরে পড়া কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভর্তির পর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে সচ্ছলতা আনতে অভিভাবকরা স্কুল থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নিচ্ছেন। সে কারণেই বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে।’
আরও পড়ুন : ৮ বছরে ২০০ ধাপ পেছাল ঢাবি
সংকট সমাধানের উপায় কী? এমন প্রশ্নের জবাবে এ শিক্ষাবিদ বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তারে সরকার বৃত্তি, উপবৃত্তি, বিনা মূল্যে বই ও খাবার সরবরাহসহ আরও নানা খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করলেও শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আসলে কেবল নবম থেকে সমস্যা নয়। দেখা যাবে প্রথম শ্রেণিতে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে তার অর্ধেকেরও বেশি এসএসসির আগে ঝরে পড়ছে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সংকট সমাধানে সরকারি উদ্যোগে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারিত করতে হবে। উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে কারিগরি স্কুল হতে হবে। মাধ্যমিক স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করে কোনোমতে চালালে ফল পাওয়া সম্ভব হবে না। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদেরও যুক্ত করতে হবে। সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার চিন্তা থেকে আগে বের হতে হবে।’
ওডি/এমএ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড