• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শিবিরের অভয়াশ্রম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এখন কেমন? 

  নুরুজ্জামান খান, রাবি প্রতিনিধি

১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১২:১২
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজত্ব
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষের সময়ের তোলা ছবি (সংগৃহীত)

নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবির এক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য দেখালেও এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় দলে পরিণত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একক আধিপত্যে ছিল শিবির। সে সময় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন, রগ কাটার মতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ড ছিল তাদের নিত্যদিনের কার্যকলাপ। পাশাপাশি হলগুলোকে পরিণত করেছিল নিজেদের ‘টর্চার সেলে’। নেতাদের অবাধ্য হলে শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হতো নির্যাতন। বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি ছিল তাদের ‘দমন পীড়ন’ নীতি।

তবে শিবিরের এই পতনের জন্য তাদের ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ডকে দায়ী করছেন সকলে। কেউ কেউ বলছেন- শিবির প্রকাশ্যে কাজ না করলেও ক্যাম্পাসে নিজেদের আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। প্রশাসনকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিচ্ছে সচেতন মহল। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ভালো রাখতে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।

জানা যায়, ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে রাজশাহী এলাকাতে শিবির প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে তারা। সে সময় রাবিতে একক আধিপত্যে ছিল ছাত্র মৈত্রী। ওই বছরের ১১ মার্চ রাজশাহী বাবলা চত্বরে নবীন বরণের আয়োজন করে ছাত্রশিবির। তাদের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো বাধা দিলে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। সংঘর্ষে সাব্বির, হামিদ ও আইয়ুব নামের তিন শিবির কর্মী নিহত হয়, আহত হয় উভয়পক্ষের অনেকে।

তবে রাবিতে শিবির আধিপত্য বিস্তার করে নব্বইয়ের পরবর্তী দশকে অধ্যাপক ইউসুফ আলী উপাচার্য থাকাকালে। ‘কট্টর’ জামায়াতের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই উপাচার্যের আমলেই প্রথম শিবির প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা পায় বলে জানা যায়। এরপর থেকে এক দশকের বেশি সময় ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য বজায় রাখে দলটি।

শিবিরের অতীত ইতিহাসে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে ত্রাসের সৃষ্টি করত তারা। বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের দমনে তাদের ওপর হামলা, নির্যাতন, রগ কাটাসহ নানা পাশবিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তারা। ২০১৫ সালের নভেম্বরে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালিদ হাসান বিপ্লব ও মহানগর যুবলীগ নেতা ইকবাল হাসানের ওপর হামলা, ২০১৪ সালের এপ্রিলে ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ হাসান ও সালেহ মোহাম্মদ টগরকে কোপানো, ২০১০ সালের ০৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কর্মী ফারুককে হত্যা করে ড্রেনে লাশ ফেলে রাখা, ১৯৯৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলা, ১৯৯২ সালে নবাব আব্দুল লতিফ হলে গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড ঘটায়।

তবে শিবিরের এই ‘ত্রাসের’ রাজত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগের প্রচেষ্টায় ‘রাজত্ব’ হারাতে থাকে তারা। শিবির কোণঠাসা হয় মূলত ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যার পরে। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ শিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষে নিহত হয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। অনেকে মনে করেন, নোমানী হত্যার বদলা নিতে ফারুককে হত্যা করে শিবির। ফারুক হত্যার পর পুলিশ সাঁড়াশি অভিযানে নামলে ধীরে ধীরে শিবিরের আধিপত্য কমতে থাকে। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে কিছুটা শক্তি দেখালেও ক্যাম্পাসে টিকতে পারেনি শিবির।

তবে শিবির প্রকাশ্যে কাজ না করলেও গোপনে ঠিকই কাজ চালাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘শিবির একেবারে নেই এটা বললে ভুল হবে। শিবির এখনো আছে তবে হয়তো ওরা প্রকাশ্যে সাংগঠনিকভাবে কাজ করতে পারছে না। ওরা জামায়াতের অঙ্গসংগঠন, রাজনৈতিকভাবে জামায়াত নিবন্ধন হারিয়েছে তাই ওরা প্রকাশ্যে আসে না। তবে অন্যের ছত্রছায়ায় কাজ করে যাচ্ছে। আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি বিভিন্ন সময়ে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাবি ক্যাম্পাস এক সময় ভয়াবহ ছিল। বন্দুকের শব্দ আর মারামারি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এখন ক্যাম্পাসে এমন ঘটনা ঘটে না। শিবির নিজেদের আত্মঘাতী রাজনীতির কারণে হারিয়ে গেছে।’

তবে শিবিরের বর্তমান নিষ্ক্রিয়তার জন্য অনেকে মনে করেন প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কঠোর অবস্থান।

ছাত্রলীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষ, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারজনকে ‘শিবির সন্দেহে’ আটক ও মারধর করে পুলিশে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি হল থেকে নয়জন, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ৫ জন, একই বছরের ২০ আগস্ট ১৭ জন, ৩০ জানুয়ারি হবিবুর হল থেকে তিনজনকে আটক করে পুলিশে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ক্যাম্পাসকে শিবির মুক্ত করতে বিভিন্ন সময় অভিযান পালন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।

অন্য দিকে সর্বশেষ ২০১৮ সালে দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার একটি ঘটনা ব্যাপক সমালোচিত হয়। জানা যায়, গত বছর ২ জুলাই পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে পতাকা মিছিল বের করেন ২০-৩০ জন শিক্ষার্থী। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা বিনোদপুর থেকে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক দিয়ে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের দিকে আসছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে সামনে পুলিশ অবস্থান নেয়। বন্ধ ফটকের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদের নেতৃত্বে প্রায় ৫০-৬০ জন নেতাকর্মী অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীরা প্রধান ফটকের দিকে আসতেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফটকের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা (ছবি : সংগৃহীত)

এ সময় কয়েকজন আন্দোলনকারীদের মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। মহাসড়কে কোটা সংস্কার আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তারিকুল ইসলাম তারেক পড়ে গেলে তার ওপর চড়াও হন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। লাঠি, হাতুড়ি ও জিআই পাইপ দিয়ে তাকে বেধড়ক মারধর করেন ছাত্রলীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমান সিনহা, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান, সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, কর্মী লতিফুল কবির মানিকসহ কয়েকজন। পরে পুলিশ এসে তারেককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

যদিও পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, ‘তারা ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছিল। তাই তাদের প্রতিহত করেছি।’ তবে মারধরের বিষয়ে ওই সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মাসুদ মোন্নাফ বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছিলাম। এ সময় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে পুলিশের সামনেই মারধর করে।’

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘শিবির মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ জামায়াতের সংগঠন। তাদের মানবতা বিরোধী মনোভাবের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বর্জন করেছে। আমি যতটুকু জানি ক্যাম্পাসে শিবিরের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারপরও যদি থেকে থাকে ছাত্রলীগ তা প্রতিহত করবে। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে এই ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাতে দেব না।’

এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্তমান প্রশাসক অনেক সতর্ক। কোনো দল বা গোষ্ঠী এখানে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’

তবে এসব বিষয়ে শিবিরের দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ওডি/এআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড