• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বাকৃবির গৌরবোজ্জ্বল ৫৮ বছর

  শাহীন সরদার, বাকৃবি প্রতিনিধি

১৮ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৩৪
বাকৃবি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ছবি : দৈনিক অধিকার)

ময়মনসিংহ শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে ১২শ একর জায়গার ওপর ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করে কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের পথিকৃৎ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছরে ক্ষুধামুক্ত দেশসহ অনেক অর্জনের মধ্য দিয়ে ৫৯ বছরে পদার্পণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শোকের মাস হওয়ায় জাঁকজমক পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন না করলেও রবিবার শোভাযাত্রা, মাছের পোনা অবমুক্ত ও গাছের চারা বিতরণের মধ্য দিয়ে সাদামাটা ভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যালিপ্যাডে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। পরে হ্যালি প্যাড থেকে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশ নেয়। শোভাযাত্রা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদে মাৎস্য খামারের সহযোগিতায় মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত মঞ্চে জার্মপ্লাজম সেন্টারের সহযোগিতায় স্থানীয় কৃষকদের মাঝে বনজ ও ফলজ গাছের চারা বিতরণ করা হয়। দুপুরের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মসজিদ ও উপাসনালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস বাস্তবায়ন উপ-কমিটির সভাপতি ও ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকিরের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জসিমউদ্দিন খান।

এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করার যে চ্যালেঞ্জ আমরা হাতে নিয়েছিলাম তাতে আমরা জয়লাভ করেছি। বর্তমানে আমরা দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হচ্ছি। এ পর্যন্ত বাকৃবি প্রায় ৪৭ হাজার দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরি করেছে। যারা দক্ষতার সহিত বিভিন্ন সেক্টরে দেশে বিদেশে কাজ করে সুনাম অর্জন করছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয় আরও সুনাম করবে। আমরা যেমন দেশে ক্ষুধা-মঙ্গার অবসান ঘটিয়েছি তেমনি আমরাই একদিন পারব মানুষের মাঝে নিরাপদ খাদ্য পৌঁছে দিতে।

পরাধীন দেশে খাদ্য নিরাপত্তা সন্তোষজনক ছিল না। এদেশের উর্বর জমি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে সমৃদ্ধ হলেও দুর্ভিক্ষ ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। জাতীয় খাদ্য ও কৃষি কমিশন এবং শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। লক্ষ ছিল কৃষি উন্নয়নের জন্য দক্ষ কৃষিবিদ তৈরি করা, কৃষিকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামুখী ও টেকসই করে তুলার জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা, কৃষির সকল বিষয়ে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী তৈরি করা এবং গবেষণালব্ধ প্রযুক্তিকে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সে লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করে যাচ্ছে।

গেল ৫৫ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদদের অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষত্রে পুরস্কৃত হয়েছেন এবং একই সাথে পেশাগত পূর্ণতায় বিকশিত হয়ে তারা দেশের কৃষি-সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে করেছে সমৃদ্ধ ও আলোকিত। এই দক্ষ কৃষিবিদদের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলেই দেশ আজ খাদ্য-শস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি জমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ধান, গম, ভুট্টা, সবজি, মাছ ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে ও অন্যান্য দেশের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করেছে। কৃষিক্ষেত্রে দৃশ্যমান সাফল্যগুলো ও কৃতিত্ব এ দেশের কৃষক ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের।

১৯৭৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন যার ফলে কৃষিবিদরা চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিন বদলের যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনুপাত শতকরা ১৫ ভাগ নামিয়ে এনে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে বর্তমান সরকার ‘ভিশন টুয়েন্টি ওয়ান’ ঘোষণা করেছে। সরকারের এ কর্মসূচি সফল করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ও কৃষি বিজ্ঞানীরা অতীতের ধারাবাহিকতায় অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রাজধানী ঢাকা থেকে ১২০ কিলোমিটার উত্তরে ও ময়মনসিংহ শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ এশিয়ার উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম বিদ্যাপীঠ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গৌরবমণ্ডিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরেই ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির মাঝেই নিহিত রয়েছে গোটা জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি।

বাকৃবিতে ভেটেরিনারি, কৃষি, পশুপালন, কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি, কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান, মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের আওতায় ৪৩টি বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে সাত হাজার ১০৩ জন শিক্ষার্থী ও ৫৮১ জন শিক্ষক রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ছেলেদের ৯টি ও মেয়েদের জন্য চারটি আবাসিক হল রয়েছে।

ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেম, ইনস্টিটিউট অব এগিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি, ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল, হাওর ও চর ইনস্টিটিউট, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন, কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, দুই হাজার আসন বিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলন ভবন, জিমনেশিয়াম, স্টেডিয়াম, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রকৌশল ভবন, অতিথি ভবন, ক্লাব ভবন, ৬৫৭টি আবাসিক ইউনিট, ১২টি ফার্ম, ফিল্ড ল্যাব, ভেটেরিনারি ক্লিনিক, ওয়ার্কশপ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, জার্মপ্লাজম সেন্টার, শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মরণে নির্মিত বধ্যভূমি, বিজয় ৭১, মরণ সাগর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি চত্বরসহ দেশের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এ ক্যাম্পাসেই। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন শস্য, ফসল, মাছ ও প্রাণীর জাত উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যাচ্ছে।

গৌরবের বিষয়সমূহ :

জার্মপ্লাজম সেন্টার, উদ্ভিদের অনন্য সংগ্রহশালা : এটি গবেষণায় বিশ্বের মধ্যে প্রথম এবং আয়তনে দ্বিতীয়। প্রায় ১১ হাজার ফলের প্রজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে জার্মপ্লাজম সেন্টারটি গেল ২২ বছরে ৬৭টি ফলের নতুন জাত আবিষ্কার করেছে।

কৃষি জাদুঘর : প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত এই মিউজিয়ামটি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র কৃষি মিউজিয়াম।

মৎস্য জাদুঘর : ‘বায়ো-ডাইভারসিটি সেন্টার’ বিচিত্র প্রজাতির মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় ফিশ মিউজিয়াম এটি।

কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি : কৃষি বিষয়ক বই সংগ্রহের বিচারে এশিয়ার বৃহত্তম লাইব্রেরি। পুস্তক সংখ্যক প্রায় ২লক্ষ ১২ হাজার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিন তলা বিশিষ্ট এই ভবনে একটি সাইবার কক্ষ রয়েছে।

ক্যাম্পাস : বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর ক্যাম্পাস এটি যা প্রায় ১২০০ একর জায়গা জুড়ে। ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদী। ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন।

বোটানিক্যাল গার্ডেন : বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতির সংরক্ষণের দিক থেকে বাংলাদেশের এক নম্বর এটি। দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালির সংগ্রহ নিয়ে ২৫ একর জায়গা জুড়ে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর পাড়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেনটি।

ভেটেরিনারি ক্লিনিক : প্রশিক্ষণ, পশু চিকিৎসা সেবা প্রদানের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম পশু চিকিৎসালয়।

প্লান্ট ডিজিজ ক্লিনিক : উদ্ভিদের রোগ নির্ণয়, গবেষণার কাজে ব্যবহৃত এই ক্লিনিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম উদ্ভিদ চিকিৎসালয়।

ওডি/আরএআর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড