সাব্বির হাসান রাব্বি, রমেক প্রতিনিধি
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি কৃত বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীই বাহির থেকে আগত। তবে সবাই যে বাইরের না তার প্রমাণ মেলে পেডিয়াট্রিক্স ওয়ার্ডে গেলে। পেডিয়াট্রিক্স ওয়ার্ডে মোট ভর্তি কৃত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৯ জন। তারমধ্যে ৬ জনের ভ্রমণের হিস্ট্রি থাকলেও বাকি ৩ জনের নেই। তার মানে রংপুরেও যে ডেঙ্গু আক্রমণ করেছে এর কোনো অনিশ্চয়তা নেই।
এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি হলে আরও বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির সঙ্গে রংপুর মেডিকেলে ৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্মরত চিকিৎসক ডা. শাহেদুজ্জামান রিবেল বলেন, ‘রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২ সপ্তাহ আগে থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত ১৬৭ জন ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ে ভর্তি হয়েছে ও ৪৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।’
বর্তমানে প্রায় ৬১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে জানা গেছে। রংপুর মেডিকেলে ডেঙ্গু ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য। তবে প্রতিদিনই নতুন নতুন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্তদের অধিকাংশই ঢাকা ও এর আশে পাশের অঞ্চল থেকে আগত। স্থানীয় পর্যায়ে আক্রান্ত হওয়ার খবর খুবই কম বলে জানা গেছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত পাট গ্রামের অধিবাসী রুহুল মিয়া দৈনিক অধিকারকে বলেন, তিনি ঢাকায় কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেলে সিট না পেয়ে পারিবারিক সিদ্ধান্তে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে যাওয়ায় আজকে তাকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।’
আক্রান্তদের অধিকাংশই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চল থেকে আক্রান্ত হয়ে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন মেডিসিন বিভাগের বিভিন্ন ইউনিটে গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন নতুন করে ভর্তি হচ্ছে বলে জানায় ডা. মো হাবিবুর রহমান।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের একাংশ (ছবি : সংগৃহীত)
২৬ জন সিনিয়র লেভেলের চিকিৎসক, ৬ জন মিড লেভেল ও ইন্টার্ন চিকিৎসকের নজরদারিতে সার্বক্ষণিক পরিচর্যায় রয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা। দিনে দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। এই সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা আছে বলে আশংকা করছে অনেকেই। বর্তমানে রংপুর নগরবাসীর চাপা এক আতংকের নাম এই ডেঙ্গু। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ এনএস১ (NS1), সিবিসি (CBC) সহ সকল ধরনের টেস্ট রংপুর মেডিকেলে করা হয়। এ বিষয়ে সৃষ্ট অপপ্রচারে কান না দেওয়ার আহবান জানান ডা. শাহেদুজ্জামান রিবেল। যেকোনো নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছেন রংপুর মেডিকেলের সকল চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি স্বরূপ চিকিৎসকদের ঈদের ছুটি মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে।
ডা. রিংকু বলেন, শনিবার (৩ আগস্ট) থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবে ডেঙ্গু এনএস১ (Dengue NS1) পরীক্ষা চালু হয়েছে। এ পর্যন্ত দুই জন রোগীর এনএস১ পজিটিভ পাওয়া গেছে।’
হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে দুইজন ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তারা হলেন- মো. জলিল মিয়া (২৮) ও মো. সোহাগ আলী (১৮)। ভর্তি কৃত ডেঙ্গু রোগীরা হাসপাতালের ১, ৩, ২৯ ও ৩০ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত রবিবার (৫ আগস্ট) রংপুর মেডিকেলে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বক্তারা বলেন, ‘ডেঙ্গু সারাদেশে ভয়াবহ বিস্তার লাভ করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি হিসেবে সর্বমোট ২৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। সর্বস্তরের চিকিৎসকবৃন্দ নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যাপক সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। ঢাকার বাইরে মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।’
প্রশিক্ষণ কর্মশালা (ছবি : সংগৃহীত)
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১৬৭ জন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ৬১ জন ভর্তি আছেন। আশার কথা চিকিৎসক ও প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে এখন পর্যন্ত কোনো রোগী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়নি।
ডেঙ্গু নিয়ে সারাদেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ও মেডিসিন সোসাইটি রংপুরের আয়োজনে রংপুর মেডিকেল কলেজে গতকাল সোমবার (৫ আগস্ট) ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সকল শিক্ষক, চিকিৎসক ও ছাত্রছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন।
তাছাড়া গত ৩ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের নির্দেশনায় রংপুর মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগ ১০ জন লোক নিয়োগ দিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এ কাজে বিশেষ সহযোগিতা করেন হোস্টেল তত্ত্বাবধায়ক ডা. শাহজালাল পিন্টু।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রিয়ানা নামে তিন বছরের এক শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ভোরে তার মৃত্যু হয়। রিয়ানা গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার নেকিরহাট গ্রামের আশরাফুল ইসলামের মেয়ে।
কলেজ প্রাঙ্গণের আশপাশ পরিষ্কার অভিযান (ছবি : সংগৃহীত)
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আসাদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আরও তিনজন ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের রক্ত দেওয়া হচ্ছে। এদিকে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছে ৬১ জন। এদের মধ্যে ১১ মহিলা ও দুই শিশু রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৬ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ১৬২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবে ১০০ টি ডেঙ্গু এনএস১ এজি (NS1 Ag) কিট নিয়ে আসা হয়েছে। এতে সহযোগিতা করেন সমাজ সেবা অধিদপ্তর।
ডেঙ্গু নিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ভাবনা :
রংপুর মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী জুলফিকার সবুর বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি বর্তমানে আতঙ্কজনক। স্বাভাবিকভাবেই, মেডিকেল শিক্ষার্থী হিসেবে, আমরা শঙ্কায় আছি। কারণ, আমাদের শিক্ষা কলেজ ও হাসপাতালমুখী। যেভাবে তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তা রোধ করতে হবে। আর শুধু কিছুদিনের জন্যই না, দূরদর্শী ব্যবস্থা নিতে হবে যেন প্রতিবছর এ ধরণের মহামারী দুর্ভোগের সম্মুখীন না হতে হয় আমাদের। স্বাস্থ্য বিভাগ সহ সরকারি, বেসরকারি সকল সংস্থা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া ও এ জাতীয় অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।’
রংপুর মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ১ম বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী মোসাব্বির পারভেজ অভি বলেন, ‘সূর্য উঠার সময় আর সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা কামরায়। এই দুই সময়ে যদি আমরা সচেতন হতে পারি তাহলে অনেকাংশেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর একটা বিষয় সেটা হলো এডিস মশা হাটুর উপরে কামরাতে পারে না তাই ফুল প্যান্ট বা পা ঢেকে থাকে এমন পোশাক পরিধান করা শ্রেয়।’
ডেঙ্গু শনাক্তকরণ এনএস১ কিট (ছবি : সংগৃহীত)
মেডিকেল শিক্ষার্থী মো. ফারহাত বলেন, ‘ওডোমাস এর দাম কমানোর দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি মেডিকেল, হোস্টেল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় মশার শূককীটজন্মানোর সম্ভাব্য স্থান প্রচুর, এগুলো ধ্বংস করতে হবে, যা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বোত্তম উপায়। প্রতিটি মশার কামড় আমাদের জন্য আজ অজানা আতঙ্কের উৎস।’
সারাদেশে ডেঙ্গুতে চিকিৎসকদের মৃত্যুর কাফেলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সারাদেশে এ পর্যন্ত ৯ জন চিকিৎসক দায়িত্বপালন অবস্থায় মৃত্যবরণ করেছেন। হাজারো রোগীর জীবন বাঁচাতে পারলেও অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্ম অবহেলার শিকার হয়ে মারা গেলেন তারা। সর্বশেষ ডেঙ্গু জ্বর আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন ডা. মো. রাশেদুজ্জামান রিন্টু। গত শনিবার মারা যান তিনি। ডা. রাশেদুজ্জামান রিন্টু রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৩৩তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।
ওডি/এমএ
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড