• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সমুদ্র রক্ষায় চবি শিক্ষার্থীদের অনন্য শিক্ষা সফর

  মাহবুব এ রহমান, চবি প্রতিনিধি

২৬ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৩৪
সেন্টমার্টিনে চবি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফর
সেন্টমার্টিনে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনন্য শিক্ষা সফর (ছবি : সংগৃহীত)

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে প্রায় প্রত্যেক বিভাগ থেকেই শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা সবুজাভ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকেও আয়োজিত হয় বার্ষিক শিক্ষা সফরের। স্থান সেন্ট মার্টিন সমুদ্র সৈকত। যাতে অংশ নেন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। তবে এ শিক্ষা সফর গতানুগতিক কোনো শিক্ষা সফর ছিল না। শিক্ষা সফরে ছিল নান্দনিক আর অনন্য সব আয়োজন।

'সমুদ্রকে রাখিব প্লাস্টিক মুক্ত' এই নীতিকে বুকে ধারণ করে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় 'সৈকত পরিষ্কার কর্মসূচি' পালন করে। যার নেতৃত্বে ছিলেন- বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন মুন্না, সহকারী অধ্যাপক মো. এনামুল হক ও সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার। এ সময় শিক্ষার্থীরা কয়েকটি ডাস্টবিনে বিভিন্ন প্রকার প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন।

অসংখ্য প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন, সিগারেটের উচ্ছিষ্ট প্লাস্টিক স্ট্র, চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেট ইত্যাদি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপকে পরিণত করেছে ময়লার স্তূপে। এইভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের থেকে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হবে।

অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য সামুদ্রিক জীবকুলের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিয়ন সামুদ্রিক প্রাণি প্লাস্টিক দূষণের ফলে মারা যায়। পলিথিন, প্লাস্টিকের ফলে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে পতিত হয়। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছে ৷ এই প্লাস্টিক পদার্থের পরিমাণ প্রতি বছর বেড়েই চলেছে ৷ প্লাস্টিক থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন- বায়োস ফেনল, পলিস্টিরিন ইত্যাদি পরিস্রুত হয় ৷ এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, সমুদ্রের পানিতে ৫ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে।

প্লাস্টিক দূষণ প্রাণিকুলের খাদ্যচক্রের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। এটি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বেশকিছু সামুদ্রিক প্রজাতি, যেমন- সামুদ্রিক কচ্ছপের পাকস্থলীতে বিজ্ঞানীরা প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য পেয়েছেন। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য তাদের পরিপাকতন্ত্রকে নষ্ট করে দেয়। প্লাস্টিক দূষণের কারণে সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু ঘটছে। সামুদ্রিক কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ, সামুদ্রিক কীট খেয়ে জীবন ধারণ করে। জেলিফিশের আকার ও আকৃতি প্লাস্টিক ব্যাগের মত হওয়ায় কচ্ছপ ভুল করে প্লাস্টিক ব্যাগ ভক্ষণ করে। এতে তাদের খাদ্য নালিকা বন্ধ হয়ে যায়, প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় এবং খাদ্য গ্রহণ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ফলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়তে থাকে। কচ্ছপের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক তিমি। সাম্প্রতিক গবেষণায় সামুদ্রিক তিমির পাকস্থলীতেও প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। যা একইসঙ্গে তাদের অস্তিত্ব ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধুমাত্র সামুদ্রিক মাছেরও নয় সামুদ্রিক পাখির ওপরও রয়েছে। বেশিরভাগ সামুদ্রিক পাখির পেটে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া যায়। সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ও মাছের মধ্যে তুলনা না করতে পারায় পাখিরা বিভিন্ন প্লাস্টিক দ্রব্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

২০০৪ সালের এক গবেষণার মাধ্যমে গবেষকরা জানান, 'সামুদ্রিক গিল' এর পেটে ৩০ খণ্ডের সম পরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া যায় যা বর্তমানে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। প্লাস্টিক পদার্থ থেকে সাধারণত বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়। এই বিষাক্ত রাসায়নিক দেহের বিভিন্ন টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাখিরা যখন প্লাস্টিক পদার্থ গ্রহণ করে তখন তাদের পেটেও বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়। এর জন্য তাদের দেহের টিস্যু ধ্বংস হয়, তাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ধীরে ধীরে পাখির মৃত্যু হয়। এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায় যে, উত্তর ক্যারোলিনায় প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লাইসন অ্যালবাট্রস বাস করে যাদের পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পদার্থ পাওয়া যায় এবং এর ফলে তাদের মৃত্যু ঘটে।

প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। খাদ্য জালের মাধ্যমে এসব প্লাস্টিক মানুষের দেহে প্রবেশ করে জটিল সব রোগ ব্যাধির সৃষ্টি করে। সাধারণত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এ সকল রঞ্জক কার্সিনোজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরিবেশকে এসব দূষণ থেকে বাঁচাতে এবং জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের এমন অভিনব আয়োজন।

আয়োজন নিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দিবস দেব বলেন, 'পৃথিবীর ও এর মানবজাতির নিকটবর্তী ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন। তার ওপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্লাস্টিক দূষণ। নতুন এই ইস্যুটি এ গ্রহে বসবাসরত জনমানুষের চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই এক ঝাঁক তরুণ সমুদ্র বিজ্ঞানীদের নিয়ে সৈকতের প্লাস্টিক সংগ্রহের মাধ্যমে বিচ ক্লিন আপ কর্মসূচি সম্পন্ন করেছি আমরা। সমুদ্র শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক সমুদ্র পাড়ের জনগণ এই আমাদের প্রত্যাশা।'

বিভাগের একই বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী সাফওয়া বিনতে সাইফ সুপ্তি বলেন, 'প্লাস্টিক দূষণ যদি এভাবে বাড়তে থাকে তবে বিলুপ্ত হবে প্রাণিকুল। তাই পর্যটকরা যাতে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং ভবিষ্যতে প্লাস্টিক দূষণ না করে সেজন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের এই আত্ম প্রয়াস। সকল পর্যটক সমুদ্রকে প্লাস্টিক মুক্ত রাখবে এবং পরিবেশ বান্ধব পর্যটন গড়তে সহায়তা করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।'

ওডি/এমএ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড