তৌহিদ তুহিন
আজ থেকে প্রায় দুই শত বছর আগে বর্তমান নাটুদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ছিল শ্রী নফল চন্দ্র পাল চৌধুরীর জমিদারি এস্টেট। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলা সদর থকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার পশ্চিমে এ প্রতিষ্ঠানটি। শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলটি।
কথিত আছে, তৎকালীন জমিদার পত্নী মানব দরদী, মহিয়সী, শিক্ষিত ও বিদূষী হিসাবে খ্যাতি ছিল। সে সময় জমিদাররা ছিলেন অটল ধন সম্পদের অধিকারী। তার স্ত্রী শ্রী রাধা রানী শিক্ষিতা, জনদরদী, বুদ্ধিমতি হওয়ায় এ অঞ্চলের দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার বাসনা থেকে তার স্বামীকে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা বলেন। তারপরেই ১৯০৬ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর নির্মিত হয় বলে জানা যায়।
ভূ-পৃষ্ঠের অনেক নিম্নস্থল থেকে ৪৫ ইঞ্চি চওড়া ভেতর দিয়ে দেয়াল গাঁথা হয়। ভূ-পৃষ্ঠের ওপরের দেয়ালে গাঁথুনি ২৫ ইঞ্চি। অভিজ্ঞ কারিগরি দিয়ে চুন-সুড়কিতে নির্মিত এ দালান। প্রত্যেক ইটে নফর চন্দ্র পাল সংক্ষেপে খোদাই করা আছে। জমিদার বাবু নিজের স্ত্রীর স্মৃতি ধারণার্থে তার নামানুসারে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় শ্রী রাধারানী ইনস্টিটিউশন। বিশাল আকৃতির দালানের পশ্চিম দিকে দক্ষিণমুখী কয়েক কামরা বিশিষ্ট একটা দালান নির্মিত হয়। দালানটার একটা কক্ষ ছাত্রাবাস হিসেবে রেখে অন্য কক্ষগুলোতে অ্যাকাডেমিক কর্মকাণ্ডের সূচনা করা হয়।
অনেকের ধারণা, যেহেতু এক হাজার দরজা বিশিষ্ট হবার কথা সেহেতু এটা বহুতল ভবনে রূপান্তরিত হতো। প্রতিষ্ঠানটি কোলকাতা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে ১৯০৯ সালে। ১৯১১সালে এ বিদ্যালয় থেকে প্রথম ব্যাচ এনট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বহু ছাত্র দূর-দূরান্ত থেকে এসে মেসে থেকে লেখাপড়া করে কৃতিত্ব অর্জন করেন। বৃহৎ দালনটির কাজ অজানা কারণে ধীরগতিতে চলায় এ দালানটা হাজার দুয়ারে রূপান্তরিত হতে পারেনি। এর পরেও লোকজন একে হাজার দুয়ারী ভবন বলেই জানে এবং দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসে।
পরবর্তীতে এটা পাকিস্তানের অংশে পড়ে এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। ফলশ্রুতিতে অঞ্চলের হিন্দু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ ও জমিদার পরিবার এদেশ ছেড়ে হিন্দুস্থানে (ভারত) চলে যান। এ জন্য এ বৃহৎ দালানের কাজ কেবলমাত্র একতলাতেই ছাদবিহীন অবস্থায় থেমে যায়। সে সময়ে এ এলাকায় শিক্ষা প্রদীপ কিছুটা বিস্তার লাভ করায় সকলের ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় ১৯৫৮ সালে একতলা ভবনের ছাদ নির্মাণ করে ক্লাস শুরু হয় এবং ছোট ভবনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। দেশ বিভাগের পর হিন্দু শিক্ষকরা এদেশ ত্যাগ করেন যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির লেখাপড়া কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে।
এ সময় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আসেন দামুড়হুদার হরিরামপুর গ্রামের সুরাত আলী। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর আপ্রাণ চেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান প্রশংসনীয় হয়। এ সময় অজানা কারণে স্কুলটির নামকরণ করা হয় নাটুদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তারপর স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় সেনা ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করে স্কুলের ভেতর যুদ্ধ সরঞ্জামসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র রাখার ফলে স্কুলটির চরম ক্ষতিসাধন হয়।
পরবর্তীতে বিদ্যালয়টির প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সাংসদ সদস্য মৃত হাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক এ স্কুলটির উন্নয়নকল্পে একাধিকবার বিপুল অঙ্কের অনুদানের ব্যবস্থা করে দেয়। ঐতিহ্যবাহী এ স্কুলটির জমির পরিমাণ ৯ একর ১২ শতক। স্কুলটির পশ্চিমে পটে আঁকা ছবির মতো এক পুকুর, পূর্বে সুশীল ছায়াঘেরা একটা আম্রকানন ও সামনে রয়েছে সুপ্রশস্ত সমতল খেলার মাঠ। এগুলো বিদ্যালয়টির সৌন্দর্য অনেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যালয়টি এক অক্ষয়কীর্তির বাহক।
ওডি/আরএআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড