মো. ওয়ালিউল্লাহ
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া সুর্বণা মজুমদার গ্রামের বাড়ি থেকে ভার্সিটির মেইনগেটের সামনে এসে নামেন। ক্লাসের দেরি হয়ে যাওয়ায় দ্রুত রাস্তা পার হতে যান তিনি, কিন্তু হঠাৎ তার চিৎকারে নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ।
আশেপাশের লোকজন এসে পড়ে থাকতে দেখে তার থেঁতলে যাওয়া নিথর দেহ। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গোপালগঞ্জের সদর হাসপাতালে, সেখানকার চিকিৎসকরা জানায়, রোগীর অবস্থা মারাত্মক তার বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় নিতে হবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে তাৎক্ষণিক এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নেওয়া হয় সুবর্ণাকে।
হ্যাঁ, আমি এতক্ষণ জীবনযুদ্ধে জয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেই সুর্বণা মজুমদারের কথাই বলছিলাম। দুইটা বছর তো পার হয়ে গেল এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলেন, এইতো ভালো আছি। এই ভালো থাকা দিয়ে শুরু তার। এই সেই মৃত্যুঞ্জয়ী সুবর্ণা।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুরমুনি গ্রামের এক দিনমজুরের ঘরে জন্ম নেওয়া সুবর্ণা। চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বড় বোনের যথেষ্ট মেধা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে পাবলিক ভার্সিটির কথা বাদই দিলাম জাতীয় ভার্সিটিতেও ফর্ম তুলতে পারেননি। টানাপোড়নের সংসারে বাবা পড়ালেখার খরচ চালাতে না পেরে নবম শ্রেণিতে থাকতেই বিয়ে দেয় একই উপজেলার কালশিরা গ্রামে আশিস কুমার মণ্ডলের সঙ্গে।
কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেননি সংসারের সব কাজ সামলানোর পরও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকে এবং এভাবে এইচএসসি পাস করে। তারপর সে ভাবে তার পড়াশোনার পরিসমাপ্তি বোধহয় এখানেই ঘটবে, ঠিক তখনই তার অনার্স ৪র্থ বর্ষে পড়ুয়া স্বামী ১৫০ টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে লাইব্রেরিয়ানের কাজ শুরু করে। পারিশ্রমিকের প্রাপ্ত টাকা থেকে সংসারের খরচ চালিয়ে ভর্তি ফরমের টাকা গোছাতে থাকে।
অবশেষে সকল অভাব অনটন ও সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে অদম্য মেধার স্বাক্ষর রেখে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তিনি কখনো ভাবেননি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ চালাতে পারবেন। তবুও তার স্বামীর অনুপ্রেরণায় স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। শুরু হয় তার স্বপ্নের পথ চলা, কিন্তু হঠাৎ করেই সেদিন থমকে যায় তার পথচলা।
দীর্ঘ ৭ (সাত) দিন আইসিইউতে থেকে ১৫ (পনের) দিনের মাথায় জ্ঞান ফেরে সুবর্ণার। আমি কে, তুমি কি আমাকে চেন মা, মৃদুস্বরটি ভেসে আসে তার কানে। তখন তিনি আবছা দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে জবাব দেয় ‘জ্বী আমি আপনাকে চিনি, আপনি আমাদের উপাচার্য।’ আর তখনই তিনি নিজেকে প্রথমবারের মতো হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করেন। বুঝতে পারেন তার সেই পুরনো সাজানো গোছানো জীবন আর নেই নিমিষের মধ্যেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সবকিছু।
তিনি তখন মুখ ঢুকড়ে কাঁদতে থাকে আর ভাবতে থাকেন, তিনি হয়ত আর পুরনো জীবনে ফিরে যেতে পারবেন না, পঙ্গুত্বকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে হবে সারাটি জীবন, তার স্বপ্নগুলো বুঝি এখানেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় অ্যাপোলো হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় চলতে থাকে তার উন্নত চিকিৎসা। দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকাকালীন দুই বার মাথা ও তিনবার পায়ের সার্জারিসহ চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার প্রায় ১৮-২০ লক্ষ টাকা বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কান্না জড়িত কণ্ঠে সুবর্ণা বলেন ‘তার জন্ম হয়েছে দুই বার, একবার পিতামাতার ঘরে আর অন্য বার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।’
আসলেই সেই দূরন্তপণা সুবর্ণা কী ফিরে আসতে পেরেছে তার স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় জানতে চাইলে বলে’ এখন সে আগের চেয়ে মোটামুটি সুস্থ। তবে বেশি সময় হাঁটলে একটু সমস্যা হয়, মাঝে মাঝে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব হয়। কোনো বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিন্তাও করতে পারেন না।
এত প্রতিকূলতার মাঝেও সুর্বণা স্বপ্ন দেখেন ভার্সিটির শিক্ষক হবার। সে জানায় হাসপাতাল থেকে ফেরার ৭ দিনের মাথায়ই পরিবারের একমাত্র অবলম্বন তার স্বামী আশিস কুমার মণ্ডলকে উপাচার্যের নির্দেশে মাস্টার রোলে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্বল্প বেতনের চাকরির উপার্জন দিয়ে শত অভাব অনটনের মাঝেও সে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে আর প্রহর গুণছে তার স্বামীর চাকরি স্থায়ী হবার।
পরিশেষে সে জানায়, চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে উপাচার্য, তার নিজ বিভাগের আনিসুর রহমান, মজনুর রশিদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে যাদের ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণায় আজ সে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। উল্লেখ্য, সুবর্ণার ঘটনার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এখন চারটি গতিরোধক নির্মাণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘গেল দুই বছর আগে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুবর্ণা মজুমদার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হলে আমরা তাকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে তাকে পঙ্গুত্ব থেকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আনতে সক্ষম হই। তার চিকিৎসা বাবদ প্রায় ১৭ লক্ষ টাকা আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিয়েছি। যা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
শুধু সুবর্ণাই নয়, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য তহবিল খুলেছি সেখান থেকে আমরা অনেক অসহায় শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চিকিৎসা তহবিলে এখন প্রায় দুই কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক অন্য নজির। সুবর্ণার পারিবারিক অবস্থা অস্বচ্ছল হওয়ায় তার স্বামীকে তৎক্ষণাৎ চাকরির ব্যবস্থা করে দেই। সে এখন মাস্টার রোলে আছে তাকে আগামীতে অবশ্যই স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে।’
লেখক : শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড