আবু সালেহ্
বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, সাহিত্যে-প্রেম আর মিলনের ঋতু বলে আগমন হয় বসন্তের। বসন্ত মানে সকল জঞ্জাল দূর করে নতুন প্রাণের সঞ্চার, নব উদ্যমে নতুন ভাবে জেগে ওঠা, নতুনভাবে শুরু করা। হলুদ রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে মৃদু হাওয়ায় প্রিয় মানুষের হাত ধরে হাঁটা।
বসন্তের আগমনের জন্য অপেক্ষায় অধির আগ্রহে বসে থাকতেন ইংরেজী সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যতম রোমান্টিক কবি পার্শি বিশি শেলি, তিনি তার বিখ্যাত কবিতায় পুরাতনের মূর্ছনা ও বসন্তের বন্দনায় বলেন, ‘শোন, ঝড়ো পশ্চিমের উদ্দাম বাতাস/তুমি শরতের বয়ে চলা গভীর নিঃশ্বাস। ঝরে পড়া পাতাদের কর তুমি তাড়া / ওঝার যাদুতে যেন ছোটে অশরীরি অশুভ প্রেতেরা। হলুদাভ, কালো, ফিকে জ্বরতপ্ত লাল/রোগাক্রান্ত মানুষের মতো পাতাদের রং আর গাল। বসন্তের সুনীল বাতাস আসবে কখন? তূর্যধ্বনি বাজাবে তখন।’
বসন্ত নিয়ে বংলার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরাদেরও কম ছিল না, যুগে যুগে লেখে গেছেন অনেক গান, গল্প ও কবিতা।
কবি মহাদেব সাহা লিখেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি গোপন কটাক্ষই অনিঃশেষ বসন্তকাল।’ লোক কবি শাহ আব্দুল করিম গেয়েছিলেন, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো/বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...।’
বসন্তের প্রথম দিনে মনের খুশিতে কেউ আবৃতি করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার চরণ, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত।’
কেউ বা আমার মনোযোগ আকর্ষণে মায়াবী সুরে গেয়ে চলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...।’
আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা/কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে/মধুর অমৃত বাণী, বেলা গেলো সহজেই/মরমে উঠিল বাজি; বসন্ত এসে গেছে/থাক তব ভুবনের ধুলিমাখা চরণে/মথা নত করে রব, বসন্ত এসে গেছে/বসন্ত এসে গেছে। অনুপম রায়ের লেখা এ গানের মতো বসন্ত দোলা দিয়েছে প্রতিটি জুটির হৃদয় ও মননে ।
ফাগুনের প্রথম দিনে হলদে রঙের রাজত্ব ছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আমতলার বাংলা মঞ্চে ছিল বসন্তবরণের মূল অনুষ্ঠান। নাচে-গানে বরণ করে নেওয়া হয় বসন্তকে। বের করা হয় শোভাযাত্রা। বাংলা বিভাগ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের পেছনে মার্কেটিং বিভাগের উন্মুক্ত মঞ্চে ছিল বসন্ত উৎসব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বসন্ত কথন, প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আদিবাসী শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা, দলীয় নৃত্য, দলীয় ও একক সঙ্গীত, দলীয় ও একক আবৃত্তি এবং বাউল সঙ্গীত, নাটিকা ‘অবাধ জল পান’ মঞ্চায়িত এবং ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শীর্ষক ক্যারিয়োগ্রাফি প্রদর্শন।
বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে, ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে। কুমার বিশ্বজিতের এই গানের সুর সুমিষ্ট কণ্ঠে ললনাদের নৃত্যের সাথে বেজে উঠে আমতলার মঞ্চে।
বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত বসন্ত উৎসবে প্রধান অতিথি যোগদান করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যপক ড. মো. হারুন-উর-রশিদ আসকারী। এ সময় তিনি বলেন, বসন্তকে বাঁচাতে হলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ মোকাবেলা করতে হবে। একুশ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ। এটা মোকাবেলা না করতে পারলে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে না আনতে পারলে আমাদের ঋতুরাজ বসন্ত হারিয়ে যাবে।
ড. রাশিদ আসকারী বলেন, আমরা বসন্ত উৎসব পালন করি, কিন্তু উৎসব পালনের পাশাপাশি বসন্তের যে প্রকৃতি, এটি যাতে বিপন্ন না হয় এবং ক্রমাগত বিলীন হয়ে না যায় সে বিষয়ে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির এবং কিছু কর্তব্য কর্মের আবশ্যকতা রয়েছে।
তিনি বলেন, হাজার বছরের বাঙালি-ইতিহাসে আমাদের একটি গৌরবের বিষয় হলো আমাদের দেশের মতো ঋতু বৈচিত্র পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি ঋতুর রয়েছে নিজস্ব রূপ, রস, গন্ধ এবং রয়েছে আলাদা-আলাদা পরিবর্তন ও বৈশিষ্ট। ছয় ঋতুর রূপ, রস এবং গন্ধ আমাদের পূর্বসূরীরা উপভোগ করেছেন, কিন্তু কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে একুশ শতকের পৃথিবীতে আমাদের সন্তানেরা ঋতুর এই স্বাদ পায় না।
বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহা. সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শাহিনুর রহমান বলেন, প্রকৃতির দিক থেকে বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়। আমাদের যতগুলো ঋতু আছে তারমধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, মানুষের জন্য বন্ধু পরায়ন এবংঅত্যন্ত আনন্দের ঋতু হচ্ছে বসন্ত বসন্ত সুবাতাস দেয়, মানুষকে আনন্দ দেয়, মানুষের কষ্টকে নিঃশ্বেষ করে দেয়এবং মানুষের জীবন ফুলে ফলে সুশোভিত করে তোলে। তাই বসন্তকে আমরা বলি সুসময়।
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বাকী বিল্লাহবিকুলের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সরওয়ার মুর্শেদ রতন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বসন্ত উৎসব উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. রবিউল হোসেন। এর পূর্বে রবীন্দ্র-নজরুল কলা ভবন থেকে একবর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বাংলা মঞ্চে শেষ হয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড