মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
পুরুষ শাসিত আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ব্যাধি 'নারী নির্যাতন'। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই আর দশজন মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরা কাজ করে যাচ্ছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই নারীদের জীবনমানে অকল্পনীয় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা তো কমেইনি বরং নিত্যনতুন কৌশল ও পন্থায় নারীর প্রতি পাশবিকতা এবং নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এমনকি নিজ ঘরেই নিগৃহীত হচ্ছেন তারা৷ সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে নির্যাতিত, অবহেলিত, বিচারহীন হাজারো নারীর আর্তনাদের গল্প। নারী নির্যাতন বন্ধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় দৈনিক অধিকারের।
নারী নির্যাতন বন্ধে সুবিচার জরুরি
চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইসরাত জাহান। তিনি মনে করেন, হাজারো দুঃখ-কষ্ট লুকিয়ে থাকা এক শব্দ নারী। নারী মানে হাজারো স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া এবং স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে লড়াই করে যাওয়া এক টুকরো আত্মবিশ্বাস। এটি শুধুমাত্র একটি শব্দ নয় বরং এটির হাজার অর্থ এবং এতে লক্ষ-কোটি অনুভূতি বিদ্যমান।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই নারী শব্দটা বড়ই অবহেলিত। নিজের শখ, আহ্লাদ, ইচ্ছে বিসর্জন দেওয়া এই নারী বর্তমানে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে হাজারো প্রতিবাদ, হাজারো বিক্ষোভ হলেও তাও যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। নারী নির্যাতন বন্ধে আইন থাকা সত্ত্বেও নির্যাতনকারীরা সেই আইনে বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের কানে যেন তালা।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমাদের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রতিবাদ করতেই হবে এবং কোনভাবেই এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। নারী নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে কথা হয় নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী লাইজু আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা এগিয়ে নেই। নারীরা মাঠ-ঘাট থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে পুরুষসম অবদান রাখছে। অথচ এই নারীই প্রতিনিয়ত ধর্ষিত ও নির্যাতিত হয়ে পত্রিকার শিরোনামে পরিণত হচ্ছে। যদিও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে আইনের কোন ঘাটতি নেই বলে জানা যায় তারপরও নির্যাতন বাড়ছেই।
আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও পদক্ষেপ নিলে নারী নির্যাতনের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি বাড়াতে হবে। কেন ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হলেও এখনও এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না?
আইন সংশ্লিষ্টরা কোনো গাফলতি করলে শাস্তির বিধান আছে, হাইকোর্টের রায় আছে। কিন্তু কেও শাস্তি পেয়েছে আজ পর্যন্ত এধরনের কোনো নজির নেই। প্রতিদিন পত্রিকা ভরে শুধু নারী নির্যাতনের খবর আসে, এর শাস্তির খবর আসে না। এর জবাবদিহিতাই হবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের একমাত্র হাতিয়ার। তাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।
বন্ধ হোক নারী নির্যাতন
বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সম-অধিকার রয়েছে উল্লেখ করে নরসিংদী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী কামরুন্নাহার আঁখি বলেন, এখনো অনেক ক্ষেত্রে নারীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পায় না, বরং প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রেও নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং যাতায়াতে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারী নির্যাতনের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে যৌতুক প্রথার প্রচলন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন অনেক নারী। তাই যৌতুকের মতো এমন একটি সামাজিক ব্যাধিকে বন্ধ করতে হবে। বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। তবুও বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতন। আইন থাকা সত্বেও নারী নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে প্রণীত আইনগুলোর বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা।
পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যক্তি সচেতনতা থেকে শুরু করে এই বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব শুধু পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশই নয় বরং ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারেরই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে।
কর্মমুখী শিক্ষা ও সচেতনতা প্রয়োজন
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোছাঃ জেলি খাতুন মনে করেন, নারী পুরুষ সবাই সমাজের অগ্রগতি সাধন করতে পারে। সমাজের উন্নতি সাধন করতে শুধু পুরুষেরা কাজ করে অগ্রগতি সাধন করবে এমন চিন্তা ধারা ঠিক নয়। নারী ও পুরুষ একজনকে আরেক জনের সহযোগী ভাবা উচিত, প্রতিযোগী নয়। নারীরা আজ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কাজ করছে তারাও এগিয়ে যাচ্ছে তবুও এখনো আমাদের সমাজে নারীরা নির্যাতিত। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে নারীদের সচেতন করে তুলতে হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রথমত প্রয়োজন নারীদের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। যদিও নারীরা এখন অনেক এগিয়ে আছে তবে শুধু সার্টিফিকেট নয় শিক্ষা হোক কর্মমুখী, থাকুক নিজেদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ। বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, 'স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটি বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ মাপেন সেলাই করিবার জন্য! রান্নাঘরের চাল চুলো আর বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থের এই ছোট্ট পরিসরে নিজেদের বন্দি রাখলে চলবে না, তাদের কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
নিজের দায়িত্ব নিজেকে বহন করে যোগ্য করে তোলার জন্য সুযোগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমাদের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রতিবাদ করতেই হবে এবং কোনোভাবেই এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। নারী নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
প্রতিটি দিনই হোক নারী নির্যাতনমুক্ত
ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ফারদিন কবির মাহিয়ার মতে, বর্তমান সময়ে আশঙ্কাজনক হারে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে এমনকি বাসা, স্কুল- কলেজ, মাদ্রাসা বা কর্মস্থলে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতায় এসে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের নারীরা প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এটা বড়ই দুঃখজনক।
বিচারহীন বা ন্যায়বিচারের অভাব একটি সমাজ ধীরে ধীরে অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে। এ অপরাধ প্রবণতা দূর করতে হলে সর্বাগ্রে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সেই সাথে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও পদক্ষেপ নিলে নারী নির্যাতনের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করতে হবে। দ্রুততম সময়ে প্রতিটি নারী নির্যাতনের ন্যায্য বিচার করতে হবে এবং বিশেষ বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার প্রতি জোর দিতে হবে। সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, জোরালো অবস্থান নিতে হবে এবং আওয়াজ তুলতে হবে। যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ নারীর জন্য লজ্জার বিষয় নয় বরং এ লজ্জা নির্যাতনকারী ও ধর্ষণকারীর। প্রতিটি দিন হোক নারী নির্যাতনমুক্ত।
আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি
কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী স্বর্ণা রোজ বলেন, বর্তমান সময়ে নারী নির্যাতন অনেক বেশি দেখা যায়। এ যুগে নারী নির্যাতন একটি অভিশাপস্বরুপ। প্রতিদিন অহরহ নারী নির্যাতনের ঘটনা শুনা যায় ভোর হতে না হতেই। নারী নির্যাতনের এসব ঘটনা গণমাধ্যমে ছড়িয়েই আছে। এসব ঘটনা যেমন নারীর জন্য প্রভাব পড়ে তেমনি একটি পরিবার ও দেশের ওপরও পড়ে। তবে বেশি পড়ে নারীদের ওপর।
বর্তমানে সমাজে নারী উত্যক্তকরণ অর্থাৎ ইভটিজিং একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ইভিটিজাররা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। তাদের অশালীন মন্তব্য, উপহাস, তুচ্ছ করা , শালীন আচরণ করা। নারীকে প্রাপ্য সম্মান করতে হবে। একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে চাই এগুলা প্রতিরোধ করতে। প্রতিবাদ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষীকে ধরিয়ে দিতে হবে।
অপরাধী অপরাধীই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যাপকহারে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন বিরোধী সেল গঠন করতে হবে। যেকোনো মূল্যে এ অবস্থা থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে হবে। যদি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি তাহলেই কমবে আমাদের "নারী নির্যাতন"।
ওডি/নিমি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড