• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ক্লাসে ফিরছেন ঢাবি শিক্ষক রুশাদ ফরিদী

  ক্যাম্পাস ডেস্ক

১৯ জানুয়ারি ২০২০, ১০:২১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাবি শিক্ষক রুশাদ ফরিদী (ছবি : সংগৃহীত)

দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে ক্লাসে ফিরছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী।

গত বৃহস্পতিবার অর্থনীতি বিভাগের অ্যাকাডেমিক সভায় তাকে মাস্টার্সের টাইম সিরিজ অ্যানালাইসিস কোর্সটি পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ দিকে চলতি মাসের ৩ তারিখ ক্যানসার আক্রান্ত প্রিয় বোনকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন ওই শিক্ষক। মৃত্যুর আগে বোন রুশাদ ফরিদীকে বিভাগের সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি মিটিয়ে ফেলার জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন। কিন্তু আজ ক্লাসে ফেরার সুখবরটি বোনের কাছে দিতে না পেরে মর্মাহত ওই শিক্ষক। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি।

দৈনিক অধিকারের পাঠকের জন্য তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে ফেরা নিয়ে গত বেশ কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনা প্রবাহে এই নিয়ে আর কিছু লেখালিখি করার মতন মানসিক স্থিরতা ছিল না। সেই সাথে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া পারিবারিক ট্র্যাজেডিও মনের উপর একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল। সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি।

যাই হোক সব মিলিয়ে শেষ মেষ একটা ভাল খবর আছে। সেটা হলো যে আমি অবশেষে ক্লাসে ফিরছি। কাল থেকে ক্লাস শুরু হচ্ছে। মাস্টার্সের একটি ক্লাস Time series analysis, কালকে সকাল এগারোটায়।

ক্লাসে ফিরে আসার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে আমার মেজো বোন লাজুল লায়লা লুনার কথা। ও আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র ও নম্র। ওকে কেউ কখনো চিৎকার করে কথা বলতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। আমি খুব একটা দেখি নাই।

লুনা (আমি বেয়াদব ছোট ভাই, বড় বোনদের নাম ধরেই ডাকি) ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রথম ব্যাচে ভর্তি হয়। তারপর অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করে। এর আগে অনার্স পাশ করে ওয়াসাতে কিছুদিন কাজ করে। এরপর একমাত্র সন্তান আরিয়ানের জন্ম হয়। আরিয়ান একজন ‘স্পেশাল চাইল্ড’। যার ফলে লুনার আর প্রফেশনাল ক্যারিয়ার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নাই। সন্তানের দেখা শোনাতেই তাঁর জীবনের বাকিটা অতিবাহিত হয়।

আরিয়ানের সমস্যা সমাধানের জন্য লুনা কানাডায় একটা লম্বা সময় একা একা কাটায়। সেখানে আরিয়ানকে দেখা শোনা করে সংসারের বিভিন্ন বিষয় সামলানো অত্যন্ত কঠিন ছিল। একটা ভয়ংকর নিঃসঙ্গ যুদ্ধ সে তখন চালিয়ে গিয়েছিল। ওর হাজব্যান্ড, আমার দুলাভাই খন্দকার আসাদ উল্লাহ, যথাসম্ভব সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রায়ই গিয়ে লম্বা সময়ের জন্য থেকেছেন। কিন্তু মধ্য বয়সে এসে ওখানে স্থায়ীভাবে নতুন ক্যারিয়ার শুরুর মতন অবস্থা উনার ছিল না।

আরিয়ানের ওখানে তেমন বড় ধরনের উন্নতি না ঘটায় শেষমেষ লুনা আবার দেশে চলে আসে কয়েক বছর আগে। এরপর ভালই চলতে থাকে মোটামুটি সব কিছু। আরিয়ান স্পেশাল চাইল্ডদের একটা স্কুলে ভর্তি হলো। অনেকদিন পরে ওদের সংসারে একটা স্ট্যাবিলিটি আসল।

এরপরে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমাদের সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। লুনা সম্পূর্ণ নিরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। তখন একটা রুটিন চেক আপ করতে যেয়ে ধরা পড়ে ওর ক্যানসার। বিদেশে যেয়ে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা গেল যে স্টেইজ ফোর ব্রেস্ট ক্যানসার।

এরপরের ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আর বলতে চাই না। লুনা ছিল একটা প্রকৃত ফাইটার। গত ডিসেম্বরে বিদেশে শেষবারের মতন গেল, ডাক্তার তখন তাকে সরাসরি বলল তোমার হাতে হয়তো একমাসেরও কম সময় আছে। আমার দুলাভাই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল কিন্তু ও কাঁদেনি। উল্টো সহজ স্বাভাবিকভাবে ডাক্তারের সাথে কথা বলে চলে এসেছে।

পুরো ক্যানসারের এই সময়টাতে নিজে এসে কখনো আমাদের এই নিয়ে কথা বলত না। আমরা জানতে চাইলে কিছু কিছু বলত। ওর সব রাগ অনুযোগ অবশ্য আমার দুলাভাই, আসাদ ভাইয়ের উপর ঢালত। আসাদ ভাই শুধু ওর স্বামী ছিল না, ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধুও ছিল। আসাদ ভাই ছিল ইতিহাসের ছাত্র, ওদের একই ব্যাচ অথবা কাছাকাছি ব্যাচের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ছিল তারা একে অপরের বন্ধু। শেষের দিনগুলোতে আসাদ ভাই লিটারেলি ২৪ ঘণ্টা লুনার পাশে ছিল। লুনা যখন এই জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ, শুক্রবারে, অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল আসাদ ভাই ওর হাত ধরে ছিল।

আমার আব্বা আমার মাকে হারিয়েছে আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে লুনা ছিল তার অন্যতম প্রিয় সন্তান। বৃদ্ধ বয়সে এসে এই শোক সামলানো তার জন্য অনেক কঠিন হয়ে গেছে।

দীর্ঘদিনের সাথী, বন্ধু আর স্ত্রীকে হারিয়ে আসাদ ভাইয়ের অবস্থা আমরা বুঝতেই পারি। কিন্তু উনার সেই শোক পালন করারও অবস্থা নাই। আরিয়ানের বয়স টিন এইজের শেষের দিকে হলেও ওর আচরণ এখনো তিন চার বছরের বাচ্চাদের মতন। শুধু সেটা হলেই হতো, কিন্তু আরও অনেক কিছু সমস্যা আছে যেটা এই ধরনের স্পেশাল চাইল্ডদের থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই আরিয়ানকে কীভাবে সামলানো যেতে পারে এটাই হয়ে গেছে উনার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যাই হোক, কারও জন্যই কিছু থেমে থাকে না, কোনো না কোনো ভাবেই সবার জীবন হয়তো এগিয়ে যাবে।

কিন্তু লুনার জীবন পুরোপুরি থেমে গেছে। জীবনের একটা বড় সময় সে পড়াশোনা, সংসার, সন্তান নিয়ে যুদ্ধ করেছে। জীবনের শেষদিনগুলোও কেটেছে এক দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে সংগ্রাম করে। হয়তো ক্যানসার জিতে গিয়েছে, কিন্তু লুনার স্পিরিট হারেনি। শেষদিন পর্যন্ত সে ভেঙে পড়েনি। এক মিনিটের জন্যেও তাকে আমরা কাঁদতে দেখিনি।

লুনা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই খুবই চিন্তিত ছিল। ও প্রায়ই আমাকে বলত একটু সবার সঙ্গে মানিয়ে চলতে, মিটমাট করে ফেলতে। বিশ্ববিদ্যালয় আর বিভাগ আমার এই বিষয়টি আগে সমাধান করে ফেললে, আদালতের রায় চলে আসার পর যেটা উনারা চাইলে সহজেই করতে পারতেন, তাহলে হয়তো আমার এই বোনটা আরেকটু শান্তি নিয়ে চলে যেতে পারত।

লুনা এখন কোথায় আছে জানি না, কিন্তু আমি জানি সে অবশ্যই ভালো আছে। কারণ এই পৃথিবী তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। ভাল থাকাটা তার এখন অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রাপ্য।’

প্রসঙ্গত, সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণের অভিযোগে ২০১৭ সালে রুশাদ ফরিদীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এর আগে ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন : অনশন ভাঙলেন শিক্ষার্থীরা

এর এক সপ্তাহের মাথায় ১৯ জুলাই সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট করেন তিনি। এরপর গত বছরের ২৫ আগস্ট বাধ্যতামূলক ছুটির বিষয়টি অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। তা সত্ত্বেও বিভাগে ফিরতে না পেরে ২৭ নভেম্বর থেকে একাই আন্দোলন শুরু করেন রুশাদ ফরিদী।

ওইদিন ফেসবুকে ‘আমি শিক্ষক, আমাকে ক্লাসে ফিরে যেতে দিন’ লেখাসংবলিত একটি ছবি পোস্ট করে কর্মসূচি শুরু করেন তিনি। চলমান ওই প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই পরে সিঁড়িতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছিলেন এই শিক্ষক।

ওডি/এমএ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড