• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ভাইয়ের রেজাল্টে কাঁদলেন বোন 

  আয়াজ উর রাহমান

১৮ জুলাই ২০১৯, ১৭:৩৮
নটরডেম কলেজ
নটরডেম কলেজের ছাত্র শাহ্‌ নেওয়াজ এর রেজাল্টে আবেগাপ্লুত বোন (ছবি : আল আমিন পাটওয়ারী, দৈনিক অধিকার)

প্রতিটা মানুষের স্বপ্ন পূরণের পেছনে কারো না কারো অবদান থাকে। আমার জীবনে অবদান সবচেয়ে বেশি আমার মা আর বোনের। প্রতিটা মুহূর্তে তারা আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন ভীষণভাবে। আমার এই সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান যে দুইজন মানুষের (আমার মা এবং বোন), তাদের নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখতে চাই। স্বপ্ন পূরণের এই গল্পগুলো বলছিলেন নটরডেম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এইচএসসি) সদ্য জিপিএ ৫ প্রাপ্ত মোহাম্মদ শাহ্ নেওয়াজ হোসেন।

দিনাজপুরের কসবা থেকে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট নিয়ে ঢাকায় আসা শাহ্ নেওয়াজ কখনো ভাবেননি তিনি দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের মাঝে অন্যতম নটরডেম কলেজে পড়বেন। মুখে বিজয়ীর হাসি নিয়ে তিনি বলেন, ‘এক সময় নটরডেম শব্দটাই সঠিকভাবে বলতে পারতাম না। বলতাম, নটরড্রাম। আজ আমি সেই নটরডেমের ছাত্র। এখান থেকে খুব ভালো একটা রেজাল্ট নিয়ে বের হতে পারছি। এ সবকিছুর পেছনে অবদান আমার মা আর বোনের। নটরডেমে ভর্তির শুরুর দিন থেকে আজ অবধি এমন কোনো দিন নেই যেদিন তারা আমার জন্য কিছু করেননি।’

নিজের কৃতিত্বের পেছনে বোনের অবদানের কথা উল্লেখ করে শাহ্ নেওয়াজ বলেন, ‘মানুষের বোন হয়ত শুধু বোন হয়। আমার বোন কোনো অংশে আমার মায়ের চাইতে কম নয়। আপু বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থাকতেন। সেখান থেকে তিনি আমার জন্য সময় আর অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন আমার সাথে থাকবেন বলে। আমি শুরুর দিকে এক মাসের মত হোস্টেলে ছিলাম। কিন্তু সেখানে থাকা আমার জন্য সম্ভব হয়ে উঠছিল না। পরে একটা বাসা নিলাম। সেখানে আপু তার নিজের সংসার রেখে আমার কাছে এসে থাকতেন। বাড়িতে ছোটবোন থাকায় আমার মা সবসময় আমাদের কাছে আসতে পারতেন না।

‘আমি যদি কখনো বাসা থেকে না খেয়ে আসতাম, আপু কলেজে এসে আমাকে খাইয়ে যেতেন। প্রচণ্ড রোদের মাঝে ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখতাম আপু ঠাণ্ডা পানির শরবত বানিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বৃষ্টিতে অপেক্ষা করেছেন ছাতা মাথায়। এগুলো মানুষের মায়েরা করে, আর আমার জন্য করেছেন আমার বোন। তার এই অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার ঋণ শোধ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু একটাই চাওয়া, আমি যেন আমার মা আর বোনের জন্য কিছু না কিছু করতে পারি।’

সহপাঠীদের যাদের রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি তাদের উদ্দেশে শাহনেওয়াজ বলেন, সবার রেজাল্ট মনমতো হয় না। তবু এ সময় ভেঙে পড়া যাবে না। ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এই পুরোটা সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। রেজাল্টের কথা না ভেবে আমাদের এখন পড়াশোনায় আবারও মন দেয়া উচিৎ। জিপিএ ৫ না পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে, ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়েছেন। তাদেরকে অনুপ্রেরণা বানিয়ে আমরা নতুন উদ্দ্যমে পড়াশোনা শুরু করতে পারি।

ছেলের সাফল্যে ভীষণ আনন্দিত শাহ নেওয়াজের মা। ছেলের রেজাল্টের জন্য আগেরদিন দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন তিনি। ছেলের আনন্দের সময় তিনি শুধু পাশে থাকতে চেয়েছেন।

জিপিএ ৫ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা মা-ছেলের আবেগঘন মূহুর্ত (ছবি : দৈনিক অধিকার)

তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম এই যে দিনাজপুর থেকে ঢাকার নটরডেম-কেমন ছিল এই যাত্রা। আবেগঘন হয়ে শাহনেওয়াজের মা জানান, ছেলেকে যখন প্রথম ঢাকায় পাঠাই তখন কিছুটা চিন্তাতে ছিলাম। ১৭/১৮ জন ছেলের সাথে এক বাসায় কীভাবে ছেলে থাকবে সেটা নিয়েই ভাবনা ছিল বেশি। ওকে আমি কখনো একা কোথাও পাঠাইনি, রাখিনি। পরে যখন দেখলাম ওখানে ওর থাকতে সমস্যা হচ্ছে, রুমমেটদের সাথে মানিয়ে চলতে পারছে না তখন যোগাযোগ করলাম মেয়ের জামাইয়ের সাথে। তাকে সব খুলে বললাম। তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মেয়েকে নিয়ে এলাম ছেলের কাছে। দুই-ভাইবোন মিলে এক বাসায় থাকত ওরা। আমার মেয়ে তার সংসার রেখে আজ প্রায় তিন বছর আমার ছেলের সাথে থাকছে। এজন্য মেয়ের শ্বশুর বাড়ির প্রতি আমি অশেষ কৃতজ্ঞ।

আমার ছোট মেয়েটিও কেবল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। ওকে বাড়িতে বাবার কাছে রেখে আমি প্রায়ই ঢাকায় আসতাম ওদেরকে দেখতে। শাহনেওয়াজের বাবা ছোট একটা ব্যবসা করেন। আমি নিজেও একটা চাকরি করছি। কষ্ট করেই ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ছেলেকে কখনোই অসৎ সঙ্গে মিশতে দেননি তিনি। স্কুল, কোচিং সব জায়গায় তিনি সাথে করে নিয়ে গেছেন, নিয়ে এসেছেন। স্কুলের সবাই তাকে ভীষণ ভালোবাসে। এখনও তারা নিয়মিত শাহনেওয়াজের খোঁজ নেন বলে জানালেন তিনি।

সামনে ভর্তিযুদ্ধ। এরপরই ছেলেকে ভর্তি হতে হবে কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতদিন ছেলের সাথে থাকলেও সামনে চলার পথ একাই তৈরি করতে হবে ছেলেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহনেওয়াজের মা বলেন, ‘ছেলে এখন বড় হয়েছে। সময়, জায়গা বুঝে চলতে শিখেছে। যখন ওর ভুল পথে যাওয়ার বয়স ছিল সে সময় পুরোটাই ওকে সামলিয়ে রেখেছি। আমার বিশ্বাস, প্রতি পদে এখন আর ছেলের সাথে না থাকলেও আমার চলবে। সে তার জীবন নিজেই সামলিয়ে চলতে পারবে। একা চলা কঠিন হলেও আশা করি সমস্যা হবে না।’

শাহ নেওয়াজ তার এই বিশাল সাফল্যের সবচেয়ে বড় অংশীদার যাকে মানেন তিনি তার বোন আফসানা মিমি লিঞ্জা। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ভাইয়ের রেজাল্ট নিয়ে অনুভূতি। অনুভূতি জানাতে গিয়ে বেশ আবেগ্লাপুত হয়ে পড়েন তিনি। আদরের ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে জানান, ‘আজ এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হলো। আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। আমি শুধু ভাইয়ের এই ভালো রেজাল্টটাই চেয়েছিলাম।’

ছোট ভাইয়ের সামনের জীবনের সাফল্য কামনা করে লিঞ্জা বলেন, ও জীবনে যা চায় তার সব যেন পায় এটাই দোয়া। ওর সকল স্বপ্ন পূরণ হোক। বোন হিসেবে ওর কাছে আমার আর চাওয়ার কিছু নেই।

ওডি/এআর

আপনার ক্যাম্পাসের নানা ঘটনা, আয়োজন/ অসন্তোষ সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড