নুরুজ্জামান খান
জনশ্রুতি আছে রাজশাহী জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সর্বনাশা পদ্মা নদী। যৌবন হারিয়ে আজ অনেকটা নিস্তেজ নদীটি। এ নদীর কূল ঘেঁষে রাজশাহী নগরীর মতিহার থানা। মতিহারের বুকে দিয়ে বয়ে গেছে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক। মহাসড়কের একটু পূর্ব দিকে আসতেই চোখে পড়বে মতিহারের সবুজ চত্বর খ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ হিসাবে স্বীকৃত।
লেখাপড়া, শিক্ষা-গবেষণায় দেশে যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম তেমনি রয়েছে এর স্মরণীয় অতীত ইতিহাস। তাই তো অনেকে একে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন। কেউ বলেন প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ আবার কেউ বলেন শহীদের রক্তস্নাত পূণ্যভূমি। ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে জন্ম হয় ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ জন্মের পূর্বের সকল আন্দোলনে তার অসামান্য অবদান রেখেছিলো। ‘৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬ ছয়দফা বাস্তবায়ন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ইতিহাস তারই সাক্ষী।
গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের বাঁচাতে (১৯৬৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিতে শহিদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর সৈয়দ ড. মো. শামসুজ্জোহা। যাকে সবাই দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে জানেন। এছাড়াও রয়েছেন- শহীদ ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আব্দুল কাইয়ূম, হবিবুর রহমান প্রমুখ। যাদের রক্তেও এ ক্যাম্পাস রঞ্জিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনাকারী ভাস্কর্য। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে একটু সামনে যেতেই বামদিকে চোখ পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্য। যেটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত একটি নিদর্শন। এর তাৎপর্য হলো বাঙ্গালির মাথা উঁচু করে বাঁচে। এরা ভীরু বা শিকলবন্দী জাতি নয়। আর একটু সামনে গেলে দেখা যায়, প্রশাসন ভবনের সামনে বড় একটি মাজার। যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ ড. সৈয়দ মো. শামসুজ্জোহার মাজার। এখন এটি জোহা চত্বর নামে পরিচিত। প্রশাসন ভবনটির পশ্চিম দিকে নির্মাণাধীন রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক।
জোহা চত্বরের একটু পূর্বে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালায় রয়েছে শহীদদের অসংখ্য নিদর্শন যা নিজে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না কী ঘটেছিলো সে সময়! এর বাইরে রয়েছে একটি গাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। যে গাড়িটিতে করে পাকিস্তানীরা দেশের সেনা সন্তানদের তুলে নিয়ে শহীদ করেছিলো। তার পাশেই শেরে বাংলা ফজলুল হক হল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল। হল দুইটির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা সামনে গেলে সামনে একটি আবাসিক হল দেখা যায়।
হলটির নাম শুনলেই যেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজশাহীর শহীদ পরিবারের সকলেই আঁতকে ওঠেন। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার নামে গড়ে ওঠে এই হলটি। এটিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী তাদের মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করত। রাজশাহী অঞ্চলের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের তুলে এনে এখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো।
এরপর হলটির পাশ দিয়ে আর একটু হেটে পূর্বদিকে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি। জোহা হলে আটকে রাখা দেশপ্রেমীকদের নির্মমভাবে এখানে শহীদ করা হতো। তাদের স্মরণে ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত করা হয়েছে একটি স্তম্ভ।
মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক পাক বাহিনীর হাতে প্রাণ বিসর্জনকারী এসব মৃত্যুহীন শহীদরা এই গণকবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অ্যধাপক এম সাইদুর রহমান খান।
মুক্তিযুদ্ধকালীন দৈনিক বাংলা পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আহমদ সফিউদ্দিন সে সময়ের বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে বলেন, দু‘সপ্তাহ পাকিস্তানীদের দখলমুক্ত থাকার পর ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে পাকিস্তানী বাহিনী। তখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে সাব-ক্যাম্প স্থাপন করে। এর কিছুদিন পর তারা জোহা হলে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করে। রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে আনা হতো ক্যান্টনমেন্টে। যুদ্ধে বাঙ্গালিদের পক্ষে অবদান রাখার অপরাধে প্রহসনমূলক সামরিক আইনে বিচার করা হতো। বিচারের নামে তাদের অমানুসিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো।
তিনি আরও জানান, তাদের এই নির্যাতনে শহীদ হন তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান ও ভাষা বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার। আরও কিছুদিন পর ‘৭১-র ডিসেম্বর মাসে পদ্মার চরে আরেক অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ূমসহ ২৭ জন বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। সে সময় মেজর ইয়াসিনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসলে জোহা হলের পুর্বপাশে একজায়গায় তিন হাজারের অধিক মানুষের মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়।
আবেগাপ্লুত হয়ে বর্ষীয়ান এ সাংবাদিক বলেন, জোহা হলের পাশের পুকুরের পাড়ে তখন শত শত লাশ পড়ে থাকত। মানুষের মাংস খেয়ে এলাকার কুকুরগুলো পাগল হয়ে গিয়েছিল। হানাদার বাহিনী পাগল কুকুরের ক্ষতি থেকে বাঁচতে অসংখ্য কুকুরকে গুলি করে হত্যা করেছিল।
আহমদ সফিউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যত উপাচার্য এসেছেন সকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তি বলে দাবি করেন। আশ্চর্যের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি হয়নি। আমরা বিভিন্ন সময় জোহা হলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থাপনের দাবি জানিয়ে এসেছি। কিন্তু কোনো প্রশাসন তা করেননি। একটি জাদুঘরই পারতো শিক্ষার্থীদের ইতিহাস জানানোর মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড