• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন পঙ্গু করে দিচ্ছে গেস্টরুম!

  মুহাম্মদ হাসান মাহমুদ

১৯ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৫২
বিশ্ববিদ্যালয়
গেস্টরুম (ছবি: সংগৃহীত)

আমরা গেস্টরুম বলতে সাধারণত অতিথি কক্ষ বুঝি, যেখানে অতিথিদের বসা, বিশ্রাম নেওয়া, আপ্যায়ন এর ব্যবস্থা করা হয়। আসলে আমি এখন যে গেস্টরুমের কথা বলব সেটি আসলে এটি নয়, সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টরুম। অনেক অসফলতা পেছনে ফেলে, অনেক মেধাবীদের পেছনে ফেলে প্রতিটি পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। আর তখনই সে পরিচিত হয় এ গেস্টরুম নামক কালচারের সাথে। বিশেষ করে যারা প্রথম বর্ষে হলে ওঠেন।

গেস্টরুমের যে প্রয়োজন নেই এমন টি নয়, অনেক ক্ষেত্রেই গেস্টরুমের প্রয়োজন আছে। গেস্টরুমের মাধ্যমে একটি সম্পর্ক তৈরি হয় সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে। বিপদে পাশে দাঁড়ায় সিনিয়ররা, টিউশনের ব্যবস্থা করে দেন বা অন্য কোনো উপায় বের করে দেন যাতে তারা পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে।

বাস্তবিক জীবন সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া যায়, আমরা কোথায় আছি, কী করছি সে সম্পর্কে সব কিছু জানা এবং সতর্কতা অবলম্বন করার একটি শিক্ষা পাওয়া যায়। শৃঙ্খলা বোধের শিক্ষা তৈরি হয়। জুনিয়র সিনিয়রের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয় সে শিক্ষা লাভ করা সম্ভব হয়। সালাম বিনিময়ের শিক্ষা তৈরি হয়। ইতিহসের চর্চা করতে জোর করা হয়। বন্ধুদের ভেতরে সর্বদা সুসম্পর্ক বজায় রাখার, কারও সাথে শত্রুতা না করার শিক্ষা দেওয়া হয়। কোনো সমস্যা হলে সবাই একত্রে পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়াও হয়। কোনো বন্ধু অসুস্থ হলে তার পাশে থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়। কথা বলার সময় কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে তাকাতে হয় শিক্ষক থেকে শুরু করে সবার সাথে এ শিক্ষা দেওয়া হয়। চোখের ইশারায় কী ইঙ্গিত দেওয়া হয়, কী বলা হয় এগুলো বুঝার শিক্ষার দেয়া হয়। সর্বোপরি, যে কোনো জায়গায় যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে চলার শিক্ষা লাভ করা সম্ভব হয় গেস্টরুমের মাধ্যমে।

এবার নেতিবাচক দিকে একটু তাকানো যাক, একটি গোলাপে যখন কলি ধরে, সকল সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়, তখনই যে জেলখানায় বন্দি হয় সেটি হলো- গেস্টরুম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যত রকম খারাপ আচরণ করা হয় তা এ গেস্টরুমে। মা-বাবাকে তুলে যেসব অশ্লীল ভাষায় গালি দেওয়া হয়, তা না শুনলে কেউ বুঝবেন না।

তারপরে কথা না শুনলে গায়ে হাত তোলা, কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও কথা না শুনলে-কোনো সমস্যার কারণে শুনতে না পারলে কিংবা বড় ভাইদের স্বার্থের বিরুদ্ধে হলে যে কোনো ধরনের ট্যাগ লাগাতে দ্বিধাবোধ করা হয় না। হল থেকে বের করে দেয়, আর প্রায় সময়ই প্রশাসন তাদেরকে সাপোর্ট দেয়। একে তো ৩০ থেকে ৪০ জন এক রুমে থাকতে হয় তারপর আবার সর্বদা মানসিক চাপে রাখা হয়।

সালাম না দিলে গায়ে হাত তুলা হয়। সব সময় ফর্মাল এবং ভালো ভালো পোশাক পড়তে বাধ্য করা হয়। অনেক সময় প্রোগ্রাম থাকায় ক্লাস না করতে বাধ্য করা হয়। ওদিকে উপস্থিতি কম হলে শিক্ষকরা পরীক্ষা দিতে দেন না শতকরা হিসেবে ৬০ শতাংশে নিচে উপস্থিতি হলে, আর ৭৫ শতাংশের ওপরে না হলে উপস্থিতির ওপর যে নম্বর থাকে তা দেওয়া হয় না।

অনেক সুযোগ সুবিধা সীমিত করে দেওয়া হয়, সিনিয়ররা যে সুযোগ সুবিধাগুলো ব্যবহার করেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা সেগুলো ভোগ করতে পারেন না। পড়াশোনা বাদ রেখে যে সময়-যেখানে বেঁধে দেওয়া থাকে সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের আগে উপস্থিত থাকা প্রতিদিনের রুটিন। না যেতে পারলে ট্যাগ-মারধর খেতে হয়। প্রতিদিন গেস্টরুমে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। তারপর আরও অন্যান্য বিষয়ে সময় দিতে গিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময়ই বড় ভাইদের পেছনে চলে যায়, ফলে পড়াশোনা হয় না। রেজাল্টও তেমন ভালো হয় না। ডিপার্টমেন্টের পড়াই পড়া হয় না, অন্যান্য জ্ঞান চর্চার কথা তো বাদই দিলাম।

বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ এমনটা ঘটছে। বিশেষ করে যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হল রয়েছে। যে ছেলেটি শুভ্র মন নিয়ে, শুভ্র চিন্তা, শুভ্র স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, হলে ওঠা মাত্রই তার সে সব স্বপ্ন নিমেষেই ধুলিসাৎ হয়ে যায়। অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। সিনিয়ররাও ধূমপান করতে সর্বদা উৎসাহিত করে। যদিও প্রথম কয়েকদিন নিষেধ করে। কিন্তু মাস খানেকের ভেতরেই তারাই জোর করে ধূমপানের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ, জ্ঞান চর্চার জায়গা সেটি হয়ে পড়ে মাদকের কারখানা, সেটি হয়ে পড়ে মারামারি-গ্যাঞ্জাম বাঁধানো শেখার জায়গা। ছেলে মেয়ে কেউই এক্ষেত্রে বাদ পড়ে না। আর প্রশাসন এক্ষেত্রে অনেকটাই নিস্তেজ, সর্বদা মুমূর্ষু রোগীর মতো, যেন তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই।

আমার মনে হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে এভাবে জেলখানার মাধ্যমে ম্যানার শেখানো দরকার হয়। গেস্টরুমের উপকারিতা খুবই সামান্য। তাই ম্যানার শিখানোর নামে এ সকল আচরণ দ্রুত বন্ধ করা উচিত। গেস্টরুম বহু শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন পঙ্গু করে দিচ্ছে মানসিকভাবে, মেধা-প্রতিভা নষ্ট করে, শারীরিক প্রহার করে, ভীতি ঢুকিয়ে দিয়ে। দিন দিন মেধাবী স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। কেউ আত্মহত্যা করছে কেউ বা আবার পড়াশুনা ছেড়ে দিচ্ছে কিংবা চোখ হারিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে।

যে সকল শিক্ষার্থীরা অস্বচ্ছল বাধ্য হয়ে হলে থাকেন, তাদের দ্বারা জাতির কোনো উপকার হবে না ক্ষতি ছাড়া। কারণ তারা তাদের এ কষ্টগুলোর পুষিয়ে নিতে ভবিষ্যতে যে সময় তারা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন করবে সুযোগ পেলেই দুর্নীতি করবে এটি স্বাভাবিক। দেশের স্বার্থে মেধাবীদের স্বার্থে দেশকে এগিয়ে নিতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা, হলের আবাসিক শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা সবাই দৃঢ় পদক্ষেপ নিন, একটু জেগে ওঠুন, দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে। কেননা একটি জাতির উন্নতি শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হয়। একটি দেশকে পঙ্গু করতে, পিছিয়ে দিতে শিক্ষিত (যারা জ্ঞান চর্চা করে) তাদেরকে হত্যা করেই সম্ভব হয়। যেটা গেস্টরুম করছে।

লেখক : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার ক্যাম্পাসের নানা ঘটনা, আয়োজন/ অসন্তোষ সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড