• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

চবি’র প্রথম ভাস্কর্য ‘জয় বাংলা’

  মাহবুব এ রহমান

১০ নভেম্বর ২০১৮, ১১:২১
ভাস্কর্য
‘জয় বাংলা’ (ছবি : জুমন আকবর)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আয়তনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। ছোট-বড় সবুজ পাহাড়বেষ্টিত ক্যাম্পাস। প্রকৃতি যেন দু’হাত ভরে সাজিয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। শহর থেকে ক্যাম্পাস প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে। তাই শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ১৯৮০ সালে চালু হয় শাটল ট্রেন। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্যটা এখানেই।

যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব ট্রেন। কিন্তু বর্তমানে তা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই পৃথিবীর একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়। দুটো শাটলের পাশাপাশি আছে ১টি ডেমুও। প্রতিদিন প্রায় দশ থেকে বার হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় যাতায়াতের মাধ্যম এই শাটল ট্রেন। শাটল দেখতে শুধু যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন তা কিন্তু নয়। বিদেশ থেকেও শাটল দেখতে চবিতে আসার অনেক নজির আছে।

শাটলই হলো চবি’র প্রাণ। অনেকে এই শাটলকে ‘ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয়’ও বলেন। আড্ডা, গল্প, গান,পড়ালেখা কী নেই এই শাটলে! বিভিন্ন বগিতে সবাই একসাথে গান গেয়ে মাতিয়ে রাখেন পুরো ট্রেন। এবার চবি’র সৌন্দর্য আর ঐতিহ্যে যোগ হলো নতুন মাত্রা।

বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বা একাদিক ভাস্কর্য থাকলেও প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরেও চবিতে ছিল না কোনো ভাস্কর্য। সেই দুঃখটা এবার ঘুচেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অপরাজেয় বাংলা’, ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, ‘রাজু ভাস্কর্য’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘নূর হোসেন ভাস্কর্য’ ও ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাস্কর্য’, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংশপ্তক’, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্ফুলিঙ্গ’, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গুচ্ছ ভাস্কর্য ’সহ দেশের প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেরিতে হলেও চবিতে নির্মিত হয়েছে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্য।

ভাস্কর সৈয়দ মো. সোহরাব জাহান। চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬ সালের নভেম্বরে সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের আগেও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ‘আমরা চবিয়ান’ শীর্ষক ব্যানারে ‘৫২ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধিকার আদায় ও স্বাধীনতা সংগ্রামে গণমানুষের অংশগ্রহণের স্মৃতিস্বরূপ ক্যাম্পাসে ভাস্কর্য নির্মাণের দাবি তোলেন। একটু দেরিতে হলেও অবশেষে বাস্তবায়ন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরের মধ্যবর্তী চৌরাস্তার মধ্যখানে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে।

লাইভ কাস্টিং মেথডে তৈরি করা হয়েছে এ ভাস্কর্যটি, যা বাংলাদেশে প্রথম। ধূসর রঙের আস্তরণে মার্বেল ডাস্ট ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রোদ বৃষ্টিতেও ভাস্কর্য মলিন হবে না। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ ও সমান অংশগ্রহণ বুঝানো হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের ভূমিকাও উপজাতি এক নারীর অবয়বে উপস্থাপন করা হয়েছে।

মূল বেদীসহ নির্মিত ভাস্কর্যটির উচ্চতা ২০ ফুট, প্রস্থ ১৮ ফুট। এর মধ্যে ওপরের স্তরে তিন মুক্তিযোদ্ধার উচ্চতা ১১ ফুট এবং নিচের স্তরে প্রতিটি মানব অবয়বের উচ্চতা সাড়ে ৫ থেকে ৬ ফুট। প্রকল্পটির নির্মাণে ব্যয় ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে চবির নিজস্ব তহবিল থেকে ১০ লাখ ও বাকি ১০ লাখ টাকা ব্যক্তি অনুদান।

ভাস্কর্য দৃশ্যমান দেখে খুশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক শিক্ষার্থীবৃন্দ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জয় বাংলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে, এটি অত্যন্ত আনন্দের। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মানুষ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বীরত্ব ও গৌরব গাঁথাই তুলে ধরছে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্তমান ও ভবিষ্যতে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসার এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের সমৃদ্ধ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরবে বলেই বিশ্বাস করি। ভাস্কর্য নিয়ে এভাবেই অভিমত ব্যক্ত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহসানুল কবির পলাশ।

অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দেওয়ান তাহমিদ বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে বড় ক্যাম্পাস। দীর্ঘদিন এখানে মৌলবাদী রাজনীতির আধিপত্য ছিল। সে পরিস্থিতির বদল হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ভাস্কর্য ছিল না। এ অভাব অনুভব করে ‘৫২ থেকে ‘৭১ সংগ্রামের গণমানুষের ভাস্কর্য চাই’ দাবিতে ‘আমরা চবিয়ান’ প্ল্যাটফর্ম থেকে ২০১৬ সালে কিছু শিক্ষার্থী আন্দোলন করেছিল। আমরা চেয়েছিলাম চবি’র সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই এ ভাস্কর্যের কাজ শুরু হোক। কিছুটা দেরিতে হলেও আমারদের সেই আন্দোলনের ফসল এখন ‘জয় বাংলা ভাস্কর্য’ নামে দৃশ্যমান। যে কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সংগ্রাম যে অনিবার্য, এ ভাস্কর্য তারই প্রতীক হয়ে টিকে থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হেনা আক্তার বলেন, এত দীর্ঘ একটা সময় ক্যাম্পাসে ভাস্কর্য না থাকায় একটা অপূর্ণতা ছিল। অবশেষে তা পূরণ হয়েছে। সত্যিই অনেক খুশি ও গর্ব হচ্ছে।

রাতের আধারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ‘ জয় বাংলা’

অন্ধকারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ‘জয় বাংলা’

বহুল প্রত্যাশিত ভাস্কর্যটি গেল ২৫ অক্টোবর( বৃহস্পতিবার) উদ্বোধন করা হয়। নবনির্মিত ভাস্কর্যটির শুভ উদ্বোধন করেন উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

উদ্বোধনকালে উপাচার্য বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের ঠিকানা। বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ‘৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ বীর বাঙালির অসীম ত্যাগের মহিমা এ প্রজন্মের সন্তানদের কাছে চির অম্লান করে রাখার প্রত্যয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে।

আমাদের সকলকে ইতিহাসের এ সত্যতা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। ‘জয় বাংলা’ শুধুমাত্র একটি শ্লোগান নয় বরং অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতনকে পদদলিত করে বীর বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের একটি সাহসী উচ্চারণ। বিগত তিন বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের শহীদ সদস্যদের চির অম্লান করে রাখার প্রয়াসে বিভিন্ন স্থাপনা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নব নির্মিত ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি বাঙালির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রজন্মের সন্তানদের স্বদেশপ্রেম, সাহস ও শক্তি যোগাবে।

আপনার ক্যাম্পাসের নানা ঘটনা, আয়োজন/ অসন্তোষ সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড